যে সব কাজ মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে, যে পাপে ধ্বংস হয়েছিল হযরত নূহ (আঃ) এর কওম।
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ২২ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০২:৫৭:৪৪ দুপুর
হজরত নুহ (আ.) একজন বিশিষ্ট নবী ও রাসূল। মহান আল্লাহ তাকে পরম কৃতজ্ঞ বান্দা বলে আখ্যায়িত করেছেন। হাদিসে তাকে প্রথম রাসূল বলে অভিহিত করা হয়েছে। আল কোরআনের অনেক অংশ নুহ (আ.) এর আলোচনায় পূর্ণ। কোরআনে কারিমের ৪৩ স্থানে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নুহ (আ.) কে তার সম্প্রদায়ের হেদায়েতের লক্ষ্যে প্রেরণ করেছিলেন। নুহ (আ.) তাদের মাঝে ৯৫০ বছর দাওয়াতের কাজ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি নুহকে তার সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদের মাঝে অবস্থান করেছিল ৯৫০ বছর।’ (সূরা আল আনকাবুত : ১৪)। কিন্তু স্বল্পসংখ্যক লোক ছাড়া সবাই তার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। তারা শিরক, কুদর, ফিসকসহ সীমাহীন পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে মহান আল্লাহ তার সম্প্রদায়ের কাফেরদের মহাপ্লাবনের মাধ্যমে সমূলে ধ্বংস করেন।
যেসব অপরাধে লিপ্ত হওয়ার কারণে কওমে নুহ ধ্বংস হয়েছিল তা ছিল নিম্নরূপ-
শিরক তথা আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা
নুহ (আ.) এর সম্প্রদায় যেসব অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল শিরক। স্বীয় সম্প্রদায়ের প্রতি নুহ (আ.) এর সর্বপ্রথম যে দাওয়াত ছিল তা হলো শিরক বর্জন করে তাওহিদ অবলম্বন করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি নুহকে তার সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিলÑ আমি তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সতর্ককারী, যেন তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করো।’ (সূরা হুদ : ২৪-২৫)।
‘আমি তো নুহকে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের কাছে এবং সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়। আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো ইলাহ নেই।’
(সূরা আরাফ : ৫৯)।
কুফর তথা আল্লাহকে অস্বীকার করা
দ্বিতীয় যে গুনাহে তারা লিপ্ত ছিল তা হলো কুফর তথা আল্লাহর ওহিকে অস্বীকার। আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলত যা-সহ তোমরা প্রেরিত হয়েছ তা আমরা অবশ্যই অস্বীকার করি।’ (সূরা ইবরাহিম : ৯)।
আল্লাহর নবীকে মিথ্যাবাদী বলা
আল্লাহ বলেন, ‘আর নুহের সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করেছিলাম, যখন তারা রাসূলদের প্রতি মিথ্যা আরোপ করল তখন আমি তাদের নিমজ্জিত করলাম এবং তাদের মানবজাতির জন্য নিদর্শনস্বরূপ করে রাখলাম।’ (সূরা ফুরকান : ২৫)।
নবীর শিক্ষাকে ভ্রষ্টতা আখ্যা দেয়া
আল্লাহ বলেন, ‘তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা বলেছিল, আমরা তো তোমাকে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখছি। সে (নুহ) বলেছিল, হে আমার কওম! আমার মাঝে কোনো ভ্রান্তি নেই, বরং আমি তো জগৎসমূহের প্রতিপালকের রাসূল।’ (সূরা আরাফ : ৬০-৬১)।
নবীর কাজকে নিয়ে উপহাস করা
এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি নৌকা নির্মাণ করতে লাগলেন এবং যখন তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা তার কাছ দিয়ে যেত তাকে উপহাস করত।’ (সূরা হুদ : ৩৮)।
নবীকে পাগল বলা
আল্লাহ বলেন, ‘এদের আগে নুহের সম্প্রদায়ও অস্বীকার করেছিল- অস্বীকার করেছিল আমার বান্দাকে, আর বলেছিল এতো এক পাগল।’ (সূরা কামার : ৯)।
নবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া
এরশাদ হচ্ছে, ‘নুহ বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে অমান্য করেছে এবং অনুসরণ করেছে এমন লোকের যার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বাড়ায়নি। আর তারা ভয়ানক ষড়যন্ত্র করেছিল।’ (সূরা নুহ : ২১-২২)।
শাস্তি উপস্থিত করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া
নুহ (আ.) তার সম্প্রদায়কে আল্লাহর যেসব শাস্তির ভয় দেখাতেন তারা তা উপস্থিত করানোর জন্য তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা বলল, হে নুহ! তুমি তো আমাদের সঙ্গে বিতন্ডা করেছ, তুমি বিতন্ডা করেছ আমাদের সঙ্গে অতিমাত্রায়; সুতরাং তুমি সত্যবাদী হলে আমাদের যার ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে আস।’ (সূরা হুদ : ৩২)।
নুহ (আ.) কে নির্যাতনের ভয় দেখানো
আল্লাহ বলেন, ‘হে নুহ! যদি তুমি বিরত না হও, তবে তুমি অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে নিহতদের মধ্যে শামিল হবে।’ (সূরা শুআরা : ১১৬)।
নবীকে রক্তাক্ত করা
রাসূল (সা.) বলেন, নবীগণের মধ্য থেকে একজন নবীকে তার সম্প্রদায় প্রহারে রক্তাক্ত করে ফেলেছে আর তিনি স্বীয় মুখমন্ডল থেকে রক্ত মুছে বলছিলেন, হে আল্লাহ! আমার সম্প্রদায়কে ক্ষমা কর। কেননা, তারা অজ্ঞ। (সহিহ বোখারি)।
হাদিস বিশারদদের মতে, তিনি হলেন নুহ (আ.)।
আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে অস্বীকার করা
এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা তাকে মিথ্যাবাদী বলেছে অতঃপর তাকে ও তার সাথীদের নৌকা দিয়ে রক্ষা করি, আর যারা আমার নিদর্শনাবলি অস্বীকার করেছিল তাদের নিমজ্জিত করি।’ (সূরা ইউনুস : ৭৩)।
জিদ ও অহঙ্কার
আল্লাহ বলেন, ‘তারা জিদ করতে থাকে এবং অতিশয় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে।’
নিম্নশ্রেণীর লোকজন অনুসারী হওয়ায় অনীহা দেখানো
তারা এসব লোকদের সংশ্রবে অনীহা প্রকাশ করেছিল। এরশাদ হচ্ছে, তারা বলল- আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব অথচ ইতর লোকেরা তোমার অনুসরণ করছে।
হককে পরাভূত করতে অসার তর্কে লিপ্ত হওয়া
এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা অসার তর্কে লিপ্ত হয়েছিল, তা দ্বারা সত্যকে ব্যর্থ করার জন্য। ফলে আমি তাদের পাকড়াও করলাম এবং কত কঠোর ছিল আমার শাস্তি।’ (সূরা মোমিন : ৫)।
নানাবিধ পাপ কাজে জড়িয়ে পড়া
এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি এর আগে ধ্বংস করেছিলাম নুহের সম্প্রদায়কে, তারা তো ছিল পাপাচারী সম্প্রদায়।’ (সূরা জারিয়াত : ৪৬)।
আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা
আল্লাহ বলেন, ‘আর এর আগে নুহের সম্প্রদায়কেও (তিনি ধ্বংস করেছিলেন) তারা ছিল অতিশয় জালিম ও সীমা লঙ্ঘনকারী। (সূরা নাজম : ৫২)।
আমরা যদি আমাদের সমাজের দিকে লক্ষ্য করি তবে আমরা দেখতে পাই, যেসব অপরাধের কারণে আল্লাহ নুহ (আ.) এর কওমকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন তা আমাদের মাঝে কোনো অংশেই কম নেই। বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা অধিক মাত্রায় বিরাজমান। যেমন- শিরকের বিষয়ে বলতে পারি, আমরা যদিও একাধিক ইলাহে বিশ্বাস করি না। কিন্তু অতিভক্তি দেখাতে গিয়ে মাজার পূজা, পীর পূজা ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা নানাবিধ শিরকি কর্মে লিপ্ত রয়েছি। একইভাবে নবীর শিক্ষা তথা দ্বীনি শিক্ষাকে আমরা উন্নতি ও প্রগতির অন্তরায় মনে করে নুহ (আ.) এর কওমের মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকি। সঙ্গে সঙ্গে দ্বীনি শিক্ষা, দ্বীনি লেবাস, দ্বীনি সিরত ও এগুলোর ধারক-বাহকদের আমরাও তাদের মতোই উপহাস করে থাকি এবং নির্বোধ-জ্ঞানহীন-কূপমন্ডুক মনে করি। নধবী ইলমের ধারকদের প্রতি ভয়ভীতি, জুলুম, নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের সে আচরণেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাই। সমাজে এমন কিছু লোকও দেখা যায়, যারা তাদের ব্যক্তিত্ব ও বড়ত্ব রক্ষা করতে গিয়ে দ্বীনদারদের মহব্বত থেকে দূরে থাকে। অনেকে দ্বীনের ব্যাপারে নানাবিধ তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত। কেউ বা গোপনে-প্রকাশ্যে দ্বীনের বাতিকে নির্বাপিত করার মহাষড়যন্ত্রে মশগুল। আর পাপ কাজ ও সীমা লঙ্ঘনে তো আমরা এতটাই অগ্রগামী হতে চলেছি যে, জাহেলি যুগও যেন আমাদের কাছে হার মানতে বাধ্য। এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে তওবা ও আত্মশুদ্ধিই মুক্তির একমাত্র উপায়। নচেৎ ধ্বংস আমাদের অনিবার্য। নুহ (আ.) এর কওমের ভয়াবহ পরিণতি আমাদের একথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিষয়: বিবিধ
১৭১৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন