‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রস্তুতি হচ্ছে আশুরার শিক্ষা’

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ১১ নভেম্বর, ২০১৩, ১১:৩১:৩২ সকাল



“শোকাবহ মহররমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শপথ নিতে হবে। আর এ প্রতিবাদের সময় সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রয়োজন হলে ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর মত জীবন বিসর্জন দিতে হবে; শাহাদাতবরণ করতে হবে। আর শাহাদাতের সংস্কৃতিকে সমাজের মধ্যে উজ্জীবিত করতে হবে, তাহলেই বর্তমান যুগের ইয়াজিদদের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।” এসব কথা বলেছেন আল-মুস্তফা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা) শিক্ষা বিভাগের প্রধান ও বাংলাদেশ তিতুমির একাডেমির পরিচালক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মো. আশরাফউদ্দিন খান।

প্রশ্নঃ কেন কারবালার মজলুম বীরগণ মানব জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছেন? কেন শহীদদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে বিশ্বনবী (স.) বলেছেন যে, 'হুসাইন আমার অংশ এবং আমি হুসাইনের অংশ?

মো. আশরাফ উদ্দিন খান: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আমরা যদি ইসলামের গোড়ার দিকে বা ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে আমাদের সামনে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারবালার এই কালজয়ী বিপ্লব ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রথমে দেখতে হবে সেখানে কারা অংশগ্রহণ করেছিলেন? আমরা দেখতে পাই কারবালা মিশনের শিরোমণি ছিলেন ইমাম হুসাইন (রাঃ) এবং তার সঙ্গীসাথী এবং তার পবিত্র আহলে বাইত বা পরিবারবর্গ। ইমাম হুসাইন (রাঃ) ছিলেন রাসূল (স.) এর অতি প্রিয়জন। আর রাসূল (স.) ইমাম হুসাইন (রাঃ) সম্পর্কে বলেছেন: ‘হুসাইন আমা হতে আর আমিও হুসাইন হতে’।

ইমাম হুসাইন (রাঃ) এত মর্যাদাবান হওয়ার পরও যখন তিনি রাসূল (স.)এর দ্বীনকে বিকৃতি থেকে রক্ষা এবং তা মানবজাতির জন্য সংরক্ষণ করতে কিয়াম (পাপিষ্ঠ এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ) করলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মর্যাদা আরো বহুগুণে বেড়ে গেল। কারবালার ময়দানে তিনি শুধুমাত্র নিজেই শাহাদাতবরণ করেননি, সেইসঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এমনকি ৬ মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশুও শাহাদতবরণ করেছেন। আর এ করুণ শাহাদাতের মাধ্যমে ইসলামকে তিনি রক্ষা করেছেন। অর্থাৎ তিনি চরম ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে ইসলাম নামক বৃক্ষকে রক্ত দিয়ে সঞ্জীবিত করেছেন।

রাসূল (সা.)এর সেই হাদিসের তাৎপর্য যদি আমরা খুঁজি তাহলে ইমামের সুউচ্চ মর্যাদার বিষয়টি উপলব্ধি করা যাবে। রাসূল (সা.) যখন বলেন, ‘হুসাইন আমার থেকে’- তখন এটি বুঝতে কষ্ট হয় না। কিন্তু যখন তিনি বলেন, ‘আমি হুসাইন থেকে’ তখন কথাটির তাৎপর্য বোঝা একটু কঠিন হয়ে যায়। এটি কিন্তু সহজ কথা নয়। কিভাবে রাসূল (সা.) হুসাইন থেকে হতে পারেন? এর কি অর্থ হতে পারে? এর অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য হল, ইমাম হুসাইন (রাঃ) চরম ত্যাগ ও কুরবানির মাধ্যমে যে ইসলাম উপহার দিয়েছেন তা কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। মানবজাতি সর্বদা ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর ত্যাগ ও কুরবানিকে উপলব্ধি করে ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে ইসলামকে সংরক্ষণ করবে; যুগযুগ ধরে মানুষ অনুপ্রাণিত হবে, এমনকি তারাও চরম ত্যাগ স্বীকার করবে ও প্রয়োজনে শাহাদাতের মাধ্যমে ও রক্তের মাধ্যমে ইসলামকে সঞ্জীবিত করবে।

প্রশ্নঃ কেন শহীদদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে বিশ্বনবী (সা.) মুক্তির তরণী তথা ‘সাফিনাতুন নাজাত' বলে উল্লেখ করেছেন?

মো. আশরাফ উদ্দিন খান: রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেন: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, ইন্নাল হুসাইন মিজবাহুল হুদা ও সাফিনাতুন নাজাত। অর্থাৎ ইমাম হুসাইন (রাঃ) হেদায়েতের আলোকবর্তিকা ও মুক্তি বা নাজাতের তরী। আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারব। কারবালার মরু প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রাঃ) নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবন বিসর্জন দেয়ার মাধ্যমে এমন এক পথের শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হলে মানব জাতি সত্যিকার মুক্তির তরীতে আরোহণ করতে পারবে। কারণ ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর আদর্শের অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে মুক্তি।

প্রশ্নঃ মুহররমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দর্শন বা প্রধান শিক্ষাগুলো কী?

মো. আশরাফ উদ্দিন খান: আমরা চিন্তা করলে বুঝতে পারব ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কারবালা বিপ্লব আশুরার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। যদিও বলা হয় এ মাসে অনেক ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর বিপ্লবের মাধ্যমে আগের সব ঘটনা ম্লান হয়ে গেছে বলে আমি মনে করি। এ বিপ্লবের দর্শন সম্পর্কে বিভিন্নস্থানে ইমাম হুসাইন (রাঃ) নিজেই বলেছেন: আমি চাই আমার নানার উম্মতকে সংস্কার করতে; কারণ, তারা বিচ্যুত হয়ে গেছে। আমি তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে এ বিপ্লব করছি। তিনি আরো বলেছেন: আমি সৎ কাজের আদেশ দিতে এবং অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে কিয়াম করেছি। আর এর জন্য প্রয়োজনে নিজ এবং নিজের পরিবারের জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবো না। আর তাই পাপাচারি ইয়াজিদ যখন ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাছে থেকে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) নিতে চেয়েছিল তখন তিনি বললেন: ইয়াজিদের মত একজন বিভ্রান্ত, মদখোর, জুয়াড়ি ও খুনির হাতে হুসাইন কখনো বাইত নিতে পারে না।

প্রশ্নঃ কিভাবে সাধারণ নাগরিকসহ আমাদের মুসলিম সমাজের সবার জীবনে মহরমের শিক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করা যায়? বিশেষ করে কারবালার মহান বিপ্লবের আলোকে ইসলামি চিন্তাবিদ ও শিক্ষিত মুসলিম সমাজের দায়িত্ব কী?

মো. আশরাফ উদ্দিন খান: ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর এ বিপ্লবের প্রতি পরতে পরতে মানবজাতির জন্য শিক্ষা রয়েছে। আর মুসলমানদের জন্য রয়েছে দর্শন। মুসলিম সমাজ তারা যদি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে তারা যেন ইমাম হুসাইন(রাঃ)এর বিপ্লবকে অনুসরণ করে। আগেও যেমনটি বলেছি, ইমাম হুসাইন (রাঃ) বলেছেন: মানবজাতিকে আমি সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে দূরে রাখার জন্য বিপ্লব করছি। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে যে অবস্থা বিদ্যমান যে অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার, সেটি পরিবর্তনের জন্য সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ সংক্রান্ত কুরআনের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হবে। এ শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই সমাজকে গড়তে হবে।

রেডিও তেহরান: প্রতিটি দিনই আশুরা ও প্রতিটি ময়দানই কারবালা। বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতি ও বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জাগরণের আলোকে এই নীতিবাক্যের গুরুত্ব ও প্রয়োগ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য বা পরামর্শ কী? বর্তমান যুগের ইয়াজিদদের সম্পর্কে আমাদের করণীয় কী?

মো. আশরাফ উদ্দিন খান: বর্তমান যুগে যারা ইয়াজিদের অনুসারী তাদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর অনুসারীদেরকে রুখে দাঁড়াতে হবে। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের শাসকরা সৎ শাসনের মাধ্যমে সমাজ পরিচালনা করে না। তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামি আদর্শের প্রতিফলন ঘটায় না। তারা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে সামাজ্যবাদের দালাল হয়ে মুসলমানদের শাসন ও শোষণ করছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর আদর্শকে গ্রহণ এবং সংগ্রাম করতে হবে। অর্থাৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। আর এ প্রতিবাদের সময় সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রয়োজন হলে ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর মত জীবন বিসর্জন দিতে হবে। শাহাদাতবরণ করতে হবে। আর শাহাদাতের সংস্কৃতিকে সমাজের মধ্যে উজ্জীবিত করতে হবে, তাহলেই বর্তমান যুগের ইয়াজিদদের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।

আমি বলতে চাই, বর্তমানের ইয়াজিদি শাসকদেরকে শাহাদাতের রক্তে ভাসিয়ে দিতে হবে। আমরা যদি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের দিকে তাকাই তাহলে আমরা সেই শিক্ষাকেই দেখতে পাবো। ইরানি জনগণ বিপ্লবের সময় জালেম সরকারের বিরুদ্ধে অর্থাৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আর ইরানি জনগণ সেটা করেছিল ইমাম হুসাইন(রাঃ)এর আদর্শে অনুপ্রেরিত হয়েই।

বিষয়: বিবিধ

১২৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File