তিরিশটি আমল যা হৃদয়স্পর্শী

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ০৫ মার্চ, ২০১৪, ১১:২৫:০৯ সকাল



১- আল্লাহ তায়ালার ওপর ঈমান আনা

আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনার অর্থ শুধু আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব স্বীকার করা নয়; বরং অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে অনাদি, অনন্ত, চিরঞ্জীব তা স্বীকার করা। তার সিফাত অর্থাৎ মহৎ গুণাবলি স্বীকার করা এবং তিনি যে এক, অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান ও দয়াময় এটাও স্বীকার করা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের যোগ্য নয় একথা বিশ্বাস করা।

২- সবই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট এর ওপর ঈমান রাখা

প্রত্যেক মুসলমানকে এ বিষয়ে অকাট্য বিশ্বাস ও ঈমান রাখতে হবে যে, ভাল-মন্দ ছোট বড় সমস্ত বিষয় ও বস্তুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ নেই।

৩- ফেরেশতা সম্পর্কে ঈমান রাখা

ফেরেশতাগণ নিস্পাপ, তারা আল্লাহর প্রিয় ও ফরমাবরদার বান্দা। কোন কাজেই তারা বিন্দুমাত্র নাফরমানি করে না এবং তাদের আল্লাহপ্রদত্ত ক্ষমতাও অনেক বেশি। আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর অনেক জিম্মাদারি অর্পণ করেছেন।

৪- আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে ঈমান রাখা

পবিত্র কোরআন সম্পর্কে এরূপ ঈমান রাখতে হবে, এ মহান কিতাবটি কোন মানুষের রচিত নয়; বরং তা আদ্যোপান্ত আল্লাহ তায়ালার কালাম বা বাণী। পবিত্র কোরআন অক্ষরে অক্ষরে অকাট্য সত্য। এতদ্ভিন্ন পূর্ববর্তী নবীগণের প্রতি যেসব বড় বা ছোট কিতাব নাযিল হয়েছিল, সবই অক্ষরে অক্ষরে সত্য ও অকাট্য ছিল। অবশ্য পরবর্তী কালে লোকেরা ঐসব কিতাব বিকৃত ও পরিবর্তন করে ফেলেছে। কিন্তু কোরআন শরিফকে শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিতরূপে সংরক্ষণ করার ভার স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই নিয়েছেন। সেই হিসেবে পবিত্র কোরআনকে কেউ বিকৃত করতে পারবে না।

৫- পয়গাম্বরগণ সম্বন্ধে ঈমান রাখা

বিশ্বাস রাখতে হবে, নবী বা পয়গাম্বর বহু সংখ্যক ছিলেন। তারা সকলেই নিষ্পাপ ও বেগুণাহ ছিলেন। তারা স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ আদায় করে গিয়েছেন। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার আনীত শরিয়তই আমাদের পালনীয়।

৬- আখেরাত সম্বদ্ধে ঈমান রাখা

আখেরাতের ওপর ঈমান রাখার অর্থ এই, কবরের সওয়াল-জওয়াব ও ছওয়াব-আযাব বিশ্বাস করা, হাশরের ময়দানে আদি হতে অন্ত পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সকল মানুষ একত্রিত হবে, নেকি ও গুণাহ পরিমাপ করা হবে ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ কিয়ামত সম্বন্ধে যত কথা কোরআন ও হাদিসে এসেছে, সব বিশ্বাস করা জরুরি।

৭- তাকদির সম্বন্ধে ঈমান রাখা

তাকদির সম্বন্ধে কখনো তর্ক-বিতর্ক করবে না, বা মনে সংশয় সন্দেহ স্থান দিবে না। দুনিয়াতে যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে বা হবে সবই মহান আল্লাহর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধীন ও হুকুমের তাবেদার। আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতায়ই সবকিছু হয়। অবশ্য আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও কাজের ইখতিয়ার দিয়েছেন। মানুষ নিজের ইখতিয়ার ও ইচ্ছায় ভাল-মন্দ যা কিছু করবে, আল্লাহ তার প্রতিদান দিবেন।

৮- বেহেশতের ওপর ঈমান রাখা

পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে বেহেশতের কথা উল্লেখ আছে। আল্লাহ তায়ালা নেককার মুমিন বান্দাদেরকে বেহেশতে তাদের আমলের যথার্থ প্রতিদান ও পুরস্কার দিবেন। তারা ঈমান ও নেক আমলের বদৌলতে চিরকাল বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামত ও শান্তি ভোগ করবেন। বেহেশতের বাস্তবতা সম্পর্কে দৃঢ় ঈমান রাখতে হবে।

৯- দোযখের ওপর ঈমান রাখা

পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে দোযখের উল্লেখ আছে। আল্লাহ তায়ালা কাফির, ফাসেক ও বদকারদেরকে জাহান্নাম তথা দোযখে তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত পরিণাম বা শাস্তি দিবেন। কাফিররা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। গুণাহগার ঈমানদাররা জাহান্নামে নির্দিষ্ট মেয়াদের শাস্তি ভোগের পর ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে যাবে। দোযখের বাস্তবতার ওপর ঈমান রাখতে হবে।

১০- অন্তরে আল্লাহর মহব্বত রাখা

অন্তরে মহান আল্লাহর প্রতি সর্বদা মহব্বত বদ্ধমূল রাখতে হবে। এমনকি দুনিয়ার সবকিছু থেকে আল্লাহ তায়ালার মহব্বত বেশি হতে হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন মজিদে ইরশাদ করেন -

‘যারা মুমিন আল্লাহর প্রতি তাদের মহব্বত প্রকট।’

১১- কারো সাথে ভালোবাসা ও শত্রুতা পোষণ কেবল আল্লাহর জন্যই রাখা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে, সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে।

(ক) যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বাধিক মহব্বত করবে।

(খ) কোন ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে মহব্বত করতে হলে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই করবে। অন্য কোন উদ্দেশ্যে করবে না।

(গ) কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে মন্দ জানতে হলে শুধু আল্লাহর ওয়াস্তেই মন্দ জানবে। (মুসনাদে আহমাদ)

১২- রাসূল (সা.)এর প্রতি মহব্বত রাখা, তার সুন্নতকে ভালোবাসা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি মহব্বত রাখা ঈমানের বিশেষ অংশ। এর অর্থ শুধু মহব্বতের দাবি করা বা নাত-গজল পড়া নয়, বরং এর সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্তব্য পালন করতে হবে। যথা:

১. অন্তর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভক্তি করতে হবে।

২. বাহ্যিকভাবে তার আদব বা তাজিম রক্ষা করতে হবে।

৩. রাসূলের ওপর দুরূদ ও সালাম পড়তে হবে।

৪. রাসূলের সুন্নত তরিকার অনুসরণ করতে হবে।

১৩- এখলাসের সাথে আমল করা

যে কোন নেক কাজ খালিসভাবে আল্লাহকে রাজি-খুশি করার নিয়্যতে করা ঈমানের দাবি। নিয়্যত খাঁটি হবে, মুনাফেকি ও রিয়া থাকতে পারবে না। মুমিনের সকল কাজ একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই হতে হবে।

১৪- গুণাহ থেকে তওবা করা

তওবা শুধু গদবাধা কতগুলো শব্দ উচ্চারণের নাম নয়; বরং গুণাহর কারণে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়ে তা থেকে সম্পূর্ণরূপে পরহেজ করা জরুরি। এক বুযুর্গ আরবিতে অতি সংক্ষেপে তওবার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন-

‘গুণাহের কারণে মনের ভিতর অনুতাপের আগুন জ্বলাকেই তওবা বলে।’

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন :

‘অনুতাপের নামই তওবা।’

১৫- অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখা

হযরত মুআয (রা.) থেকে বর্ণিত, ঈমানওয়ালার দিল কখনও আল্লাহর ভয় ছাড়া থাকে না, সবসময়ই তা আল্লাহর ভয়ে কম্পমান থাকে। কোন সময়ই সে আল্লাহ থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না।

১৬- আল্লাহ তায়ালার রহমতের আশা করা

কোরআন শরিফে আছে :

‘যারা কাফের তারাই শুধু আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়’। আল্লাহর রহমতের আশা রাখা ঈমানের একটি বিশেষ অংশ।

১৭- লজ্জাশীল হওয়া

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:

‘লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি বড় শাখা।’ (বুখারি, মুসলিম)

১৮- শোকরগুজার হওয়া

শোকর দুই প্রকার। (ক) আল্লাহর শোকর আদায় করা যিনি প্রকৃত দাতা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

‘তোমরা আমার শোকর আদায় কর, কুফরি করো না।‘

(খ) মানুষের শোকর আদায় করা। অর্থাৎ যাদের হাতের মাধ্যম হয়ে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত পাওয়া যায়, তাদের শোকর আদায় করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন,

‘যে ব্যক্তি মানুষের শোকর আদায় করল না সে আল্লাহ তায়ালার শোকর করল না।’

১৯- অঙ্গীকার রক্ষা করা

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর।’ (অর্থাৎ কাউকে কোন কথা দিয়ে থাকলে তা রক্ষা কর। )

২০- ধৈর্য ধারণ করা

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : ‘যারা সবর করে আল্লাহ তায়ালা তাদের সঙ্গে আছেন।’

২১- নম্রতা অবলম্বন করা

নম্রতা অর্থ নিজেকে সকলের তুলনায় অন্তর থেকে ছোট মনে করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নম্রতা অবলম্বন করে আল্লাহ তায়ালা তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’ (বাইহাকি)

২২- স্নেহশীল হওয়া

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দুর্ভাগা তার থেকেই দয়া ছিনিয়ে নেয়া হয়।

২৩- তাকদিরে সন্তুষ্ট থাকা

তাকদিরে সন্তুষ্ট থাকাকে ‘রেজা বিল কাজা’ বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর সকল ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করা। তবে আল্লাহর হুকুমে বিপদ আপদ বা দুঃখ-কষ্ট আসলে অসন্তুষ্ট না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, মনে কষ্ট লাগতে পারবে না, পেরেশানও হবে না। কষ্টের বিষয়ে কষ্ট লাগাটাইতো স্বাভাবিক। তবে আসল কথা হচ্ছে, কষ্ট লাগলেও বুদ্ধির দ্বারা ও জ্ঞানের দ্বারা তার মধ্যে কল্যাণ আছে এবং এটা আল্লাহ তায়ালারই হুকুমে হয়েছে মনে করে সেটাকে পছন্দ করা।

২৪- তাওয়াক্কুল অবলম্বন করা

আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আর আল্লাহ তায়ালার ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিৎ।’

২৫- অহংকার না করা

অহংকার না করা অর্থাৎ অন্যের তুলনায় নিজেকে নিজে ভাল এবং বড় মনে না করা ঈমানের অঙ্গ। তাবরানি নামক হাদিসের কিতাবে একটি হাদিস বর্ণিত আছে, তিনটি জিনিস মানুষের জন্য সর্বনাশকারী :

(ক) লোভ (খ) নফসানি খাহেশ ও (গ) অহংকার।

২৬- চোগলখুরি ও মনোমালিন্য তরক করা

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, চোগলখুরি ও কিনা মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। অতএব, কোন মুমিনের অন্তরেই এ গর্হিত খাসলত না থাকা উচিৎ। (তাবরানি)

২৭- হিংসা-বিদ্বেষ বর্জন করা

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন : ‘খবরদার! তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাক, কেননা অগ্নি যেমন কাঠকে ভস্ম করে ফেলে তদ্রূপ হিংসাও মানুষের নেকিকে ভস্ম করে ফেলে।’ (তাবরানি)

২৮- ক্রোধ দমন করা

আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারিমে ক্রোধ দমনকারীর প্রশংসা করেছেন। অনর্থক রাগ করা মারাত্মক গুনাহ। রাগ-ক্রোধ দমনে হাদিসে তাকিদ এসেছে। তবে ইসলামের ওপর কোন আঘাত আসলে সেখানে ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি প্রদর্শনই ঈমানের দাবি।

২৯- অন্যের অনিষ্ট সাধন ও প্রতারণা না করা

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে অর্থাৎ পরের মন্দ চায়, অপরকে ঠকায়, ধোঁকা দেয় তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। (মুসলিম)

৩০- দুনিয়ার প্রতি অত্যধিক মায়া-মহব্বত ত্যাগ করা

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবাসবে, তার আখেরাতের লোকসান হবে এবং যে আখেরাতকে ভালবাসবে তার দুনিয়ার কিছু ক্ষতি হবে। হে আমার উম্মত! তোমাদের মঙ্গলের জন্যই বলছি, তোমরা অস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে ভালবেসে চিরস্থায়ী আখেরাতকে নষ্ট করে দিও না। তোমরা সকলে চিরস্থায়ী পরকালকেই শক্তভাবে ধর এবং বেশি করে ভালবাস। (অর্থাৎ দুনিয়ার মহব্বত পরিত্যাগ করে আখেরাতের প্রস্তুতিতে আমলের প্রতি যথাযথ ধাবিত হও। (আহমাদ, বাইহাকি)

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে উল্লেখিত সিফাতগুলো অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

বিষয়: বিবিধ

১৩১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File