আল্লাহ্ ভীতি অর্জনই রোজার মূল শিক্ষা

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ১৪ জুলাই, ২০১৩, ০৩:০২:৩৮ দুপুর



রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তিকে অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হয়। এ জন্য মাহে রমজান ও তাকওয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরবি ‘তাকওয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আল্লাহভীতি, পরহেজগারি, দ্বীনদারি, ভয় করা, বিরত থাকা, আত্মশুদ্ধি, নিজেকে কোনো বিপদ-আপদ বা অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা প্রভৃতি। শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার বর্জন করে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী মানবজীবন পরিচালনা করার নামই তাকওয়া। ইসলামে তাকওয়ার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান কোনো কাজ নেই। দ্বীনের প্রাণশক্তিই তাকওয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকি।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩)

রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে তাকওয়া ও হূদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। হূদয়ের এক বিশেষ অবস্থার নাম তাকওয়া, যাতে আল্লাহর হুকুম পালন ও নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। তাকওয়ার মাধ্যমেই বান্দা ইহকাল ও পরকালে মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে পরম সম্মানিত হয়। যত প্রকার ইবাদত-বন্দেগি ও ইসলামের বিধি-বিধান রয়েছে, সবকিছুর মূলে তাকওয়ার অনুপ্রেরণা। তাকওয়া অর্জনের পর মানুষের হূদয় আল্লাহর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। এমনিভাবে রমজান মাসে তাকওয়াভিত্তিক চরিত্র গঠনে রোজাদার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

মহান সৃষ্টিকর্তার ভয়ে সমাজে সব ধরনের মন্দ ও অশ্লীল কথা ও কাজকর্ম পরিহার করে ভালো ও উত্তম কথাগুলো প্রকাশ করা, সকল প্রকার খারাপ ও নিন্দনীয় কাজ বর্জন করে কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক যাবতীয় উত্তম কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা এবং অশুভ ও ক্ষতিকর চিন্তা-ভাবনা বিনষ্ট করে শুভ ও কল্যাণকর চিন্তা ধারণ করার নামই তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। যিনি মুত্তাকি বা পরহেজগার হবেন, তিনি যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবেন এবং ভালো কাজের অনুশীলন করবেন। সত্যবাদিতা, আমানতদারি, ধৈর্য, ন্যায়বিচার বা আদল, ইহসান প্রভৃতি যত রকমের অনুপম মানবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তিনি সেগুলোর অধিকারী হতে চেষ্টা করবেন। তিনি সর্বদা সৎ কাজ করবেন এবং অপরকে সৎ কাজের প্রতি বিনীতভাবে আহ্বান জানাবেন। আর নিজে অসৎ কাজ থেকে সর্বদা বিরত থাকবেন এবং অন্য সবাইকে অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে সচেষ্ট হবেন। তিনি সময়মতো নামাজ আদায় করবেন, জাকাত প্রদান করবেন এবং মাহে রমজানে সিয়াম সাধনা তথা রোজাব্রত পালন করবেন।

বছরের এক মাসব্যাপী রোজা পালনের উদ্দেশ্য নিছক উপবাস থাকা নয়, এর মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। ফলে সমাজজীবনে মানুষ অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে এবং ন্যায় কাজ করার জন্য এগোতে পারে। মানুষের মধ্যে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের লক্ষ্যে মাহে রমজানের পূর্ণাঙ্গ একটি মাস রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। মানুষ যাতে তাকওয়া অর্জন করতে পারে, আল্লাহভীতির গুণাবলি অর্জন করতে পারে, দুনিয়ার সব কাজে আল্লাহকে উপস্থিত পাওয়ার মতো বোধশক্তি অর্জন করতে পারে, এর জন্যই রোজা। মুত্তাকির বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা মুত্তাকি বা খোদাভীরু হতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)

এখন প্রশ্ন হতে পারে, রোজা কীভাবে মানুষকে মুত্তাকি বানায়? এর উত্তরে বলা যায়, অন্য সব ইবাদত যেমন নামাজ কিংবা দান, খয়রাত, সাদকা ইত্যাদিতে ‘রিয়া’ তথা লোক দেখানোর বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকে; কিন্তু রোজার মধ্যে এসবের কোনো স্থান নেই। কেননা রোজাদার ব্যক্তি রোজা আছে কি না, তা সে ছাড়া অন্য কেউ জানে না। সিয়াম পালনকারীর সামনে সুস্ব্বাদু ও লোভনীয় খাবার উপস্থ্থিত থাকা সত্ত্বেও স্রষ্টার প্রতি দায়িত্বশীলতার কারণে সে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। ক্ষুধা-পিপাসা ও খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছাকে আধ্যাত্মিক সাধনা বলে নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো রোজাদার যদি লোকচক্ষুর অন্তরালে কোনো খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ করেন বা কিছু পান করেন বা নিষিদ্ধ কোনো খারাপ কাজ করে বসেন, তাহলে তা মানুষের জানার নয়। কিন্তু খাঁটি রোজাদার বা পরহেজগার ব্যক্তি তা করেন না।

যদি কেউ আন্তরিকভাবে রোজার প্রতিটি সুন্দরভাবে বিন্যস্ত আমল বা বিধি-বিধান পালন করেন, তাহলে তাঁর মধ্যে অবশ্যই তাকওয়া আসবে। রোজা মুত্তাকির জন্য এক অফুরন্ত নিয়ামতস্বরূপ। তাকওয়া হচ্ছে মনুষ্যত্ব অর্জনের সর্বপ্রথম ও সর্বোত্তম অবলম্ব্বন। রোজা রাখার মধ্য দিয়ে মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বাস জন্মে এবং আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়ে রোজাদারের অন্তর উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মুত্তাকি ক্ষুধা, পিপাসা, কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে রোজা পালনে ব্রতী হন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের রোজা পালন করতে গিয়ে রোজার সীমারেখা বুঝে নেবে এবং যে কর্তব্য রোজার ভেতর পালন করা বাঞ্ছনীয়, তা সুচারুভাবে পালন করে চলবে, তার এরূপ রোজা তার বিগত গুনাহের ক্ষমার কাফ্ফারা হয়ে যাবে।’ (বায়হাকি)

ইসলামে রোজার যে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আত্মশুদ্ধি লাভ ও তাকওয়া অর্জনের মূলমন্ত্র। মাহে রমজানসহ মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। একজন রোজা পালনকারী ও তাকওয়া অবলম্বনকারী মুমিন মুসলমান সমাজে কোনো প্রকার অশ্লীল ও অবৈধ কাজ করবেন না, কাউকে প্রতারণা করবেন না, কারও অপকার বা অনিষ্ট সাধনের চিন্তাও করবেন না, বরং সর্বদা পরোপকারে লিপ্ত থাকবেন এবং পবিত্র কোরআন ও হাদিসের নির্দেশ মোতাবেক জীবন যাপন করে জান্নাত লাভের পথ সুগম করবেন।

আসুন, আমরা সবাই যদি তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য সত্য ও ন্যায়ের পথে চলি, মানুষ হিসেবে মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলোর প্রতি আত্মসচেতন হই, আল্লাহর নির্দেশ মান্য করি, সমাজে অন্যায়-অসত্য ও অকল্যাণের পথ বর্জন করে চলি, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা মুত্তাকি হতে পারব।

বিষয়: বিবিধ

১১৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File