ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ.... বিষয়ঃ যাকাত। সংগ্রহ!
লিখেছেন লিখেছেন কথার_খই ০৬ জুলাই, ২০১৫, ১২:২৯:৩৫ রাত
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুলাহ,
যাকাত বিধান ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। ঈমানী আর্থিক ফরজ ইবাদত। মুসলিম হিসাবে যাকাত কি, যাকাত কোন মালের দিব, যাকাত কত দিব, যাকাত কাকে দিব ইত্যাদি সম্মন্ধে সম্যক জ্ঞান যাকাত দাতা এবং যাকাত গ্রহিতা উভয়েরই থাকা বাঞ্চনীয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সে জ্ঞান আমাদের নাই। সহজ ও সংক্ষেপে যাকাত সংক্রান্ত সম্যক জ্ঞানের লক্ষে ইসলামিক ফউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বই বিশেষ করে বিশিষ্ট লেখক ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ আবদুর রহীম অনুদিতআন্তরজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী রচিত আরবী কেতাব ফিকহুয-যাকাত এর বাংলা ইসলামের যাকাত বিধান থেকে যাকাত নির্দেশিকাটি সংকলিত করা হলো। এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা যাকাত আদায়ে সামান্য সহায়ক হলে নিজেকে সার্থক মনে করবো।
নির্দেশিকাটির কোন ভুল ত্র“টি পরিলতি হলে দয়া করে নিম্ন ঠিকানায় জানিয়ে বাধিত করবেন। ইহার ফটোকপি, পুনঃমুদ্রন বা যে কোন ধরনের প্রচারে বাধ্যবাধকতা নাই, তবেকেহ স্বতস্ফুর্ত মূদ্রন বা প্রচার করলে তাকে স্বাগত জানানো হবে। আল্লাহ্পাক আমাদের তাঁর নির্দেশিত এবং রাসূলেপাক (সাঃ) এর প্রদর্শিত পথে, ইসলামী জীবন যাপনে তৌফিকদান করুন- আমিন।
আরজ গুজার,
-ঃ সূচীপত্র ঃ-
০১। যাকাতের সংগাঃ
০২। আল-কোরআন মজিদে যাকাতঃ
০৩। হাদীস শরীফ ও অন্যান্য গ্রন্থে যাকাতঃ
০৪। পূর্ববর্তী নবী রসূলের যুগে যাকাতঃ
০৫। যাকাত ও দানের পার্থক্যঃ
০৬। যাকাত ও করের পার্থক্যঃ
০৭। যাকাত কে দিবেঃ
০৮। যাকাতের নিসাব কাকে বলেঃ
০৯। সম্পদের নিসাব ও যাকাতের হারঃ
১০। যাকাত যে সম্পদের দিতে হবেঃ
১১। যাকাত যে সম্পদের দিতে হবে নাঃ
১২। উশর বা ফসলের যাকাতঃ
১৩। পশুর যাকাতঃ
১৪। ডেইরী, পোল্ট্রি ও মৎস্য খামারের যাকাতঃ
১৫। স্বামীস্ত্রীর সম্পদ বা অলংকারের যাকাত কে দিবেঃ
১৬। বিগত বৎসরের কাযা যাকাতঃ
১৭। যাকাত আদায়ের সময়ঃ
১৮। যাকাতের নিয়ত ঃ
১৯। যাকাত কাকে দেওয়া যাবেঃ
২০। যাকাত কাকে দেওয়া যাবে নাঃ
২১। যাকাত একজনকে কতটুকু দেওয়া যাবেঃ
২২। যাকাত বন্টনের এলাকাঃ
২৩। বর্তমান প্রোপটে যাকাত ও প্রস্তাবনাঃ
২৪। যাকাত প্রদানে উপকারঃ
২৫। যাকাত গ্রহনে সুফলঃ
২৬। বিভিন্ন দেশে যাকাত/উশরের ব্যবস্থাঃ
২৭। উপসংহারঃ
২৮। যাকাত হিসাবের ছকঃ
০১। যাকাতের সংজ্ঞাঃ
কোন মুসলমান ব্যক্তি কর্তৃক আল্লাহ্র সন্তুুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তার নিসাব পরিমান মাল বা সম্পদের পূর্ন এক চন্দ্র বছর ভোগ দখলের পর নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলে।
০২। আল-কোরআন মজীদে যাকাতঃ
যাকাত প্রদান আল্লাহ্র হুকুম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তায়ালা এর বিধান, আদেশ, রহমত, অধিকার, প্রাপক ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। নিম্নে কয়েকটি আয়াত উল্ল্যেখ করা হলোঃ
বিধানঃ এবং সালাত কায়েম করবে আর যাকাত প্রদান করবে, এই হচেছ দীনের মজবুত
বিধান ঃ বাইয়্যেনাহঃ ৫
আদেশঃ তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত দাও। বাকারাহঃ ৪৩ ও ১১০ (অংশ)
রহমত ঃ সালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর, রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে করে
তোমরা আল্লাহ্র রহমত পেতে পার। নূরঃ ৫৬
অধিকারঃ (১)ধনীদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। আয-যারিয়াত-১৯
(২)তাদের ধন-সম্পদে সুনির্দিষ্ট অধিকার আছে ভিখারী ও বঞ্চিতদের জন্য।
আল-মাআরিজঃ ২৪ ও ২৫
(৩) অতএব আতœীয়কে দাও তাদের প্রাপ্য (হক) এবং অভাব গ্র¯ত ও মুসাফিরকেও যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনা করে তাদের জন্য এটা শ্রেয়। রোমঃ ৩৮
প্রাপকঃ যাকাত কেবল ফকির মিসকিন ও তৎসংশ্লিষ্ঠ কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষন করা উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋনে জর্জরিত ব্যক্তিদের জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। তওবাঃ ৬০
পবিত্রতাঃ তাদের সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত ) গ্রহন করুন। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র , করবেন এবং পরিশোধিত করবেন । তওবাঃ ১০৩
ধন সম্পদ বৃদ্ধিঃ আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের জন্য যে যাকাত তোমরা দিয়ে থাকো তাহাই
বৃদ্ধি পায় এবং উহাই সমৃদ্ধশালী । রোমঃ ৩৯ (অংশ )
ধন সম্পদ ধ্বংস ঃ দুর্ভোগ (ধংস ) অনিবার্য ঐ সকল মুশরিকদের জন্য যারা যাকাত আদায় করে না এবং আখিরাতেও অবিশ্বাসী। হামিমঃ ৬ ও ৭ ( অংশ )
হুশিয়ারঃ আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপনতা করে, তাদের জন্য তা মঙ্গল এ যেন তারা কিছুতেই মনে না করে। আল-ইমরানঃ ১৮০
উশর বা ফসলের যাকাতঃ
(১) হে ঈমানদারগন। উপার্জিত সম্পদের উত্তম অংশ আল্লাহ্র পথে খরচ কর এবং তা
থেকেও খরচ কর যা আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি।
বাকারাহঃ ২৬৭ ( অংশ )
(২) বৃ যখন ফলবান হয় তখন এর ফল ভন কর এবং এর ফসল তোলার দিনে যে
বঞ্চিত তার হক আদায় কর এবং কখনো অপচয় করো না।
আল-আনআমঃ ১৪১ (অংশ )
০৩। হাদীস শরীফ ও অন্যান্য গ্রন্থে যাকাতঃ
(১) আব্দুল্লাহ ইবন মাসুউদ (রাঃ) বলেন আল-কোরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমানিত যে,যাকাত
ব্যবস্থা ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ তথা সুষ্পষ্ট ফরজ। যে ব্যক্তি ইহা অস্বীকার করবে বা
যথাযথভাবে আদায় করবে না নিশ্চিত ভাবে সে কাফির এবং ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
যাবে। (আল-মাজমু ইবন কুদামা-যাকাত-আবুল হাসান আল নাদভী )।
(২) যে যাকাত আদায় করে না তার কোন সালাত কবুল হয়না। তাফসীরে তাবারী
(৩) কেউ যদি আল্লাহর পূরস্কারের আশায় যাকাত দেয় তাহলে তাকে পুরস্কৃত করা
হবে।কিন্তু যে যাকাত দিতে অস্বীকার করবে তার কাছ থেকে শক্তি প্রয়োগ করে যাকাত
আদায় করতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী তার অর্ধেক সম্পত্তিও নিয়ে নেওয়া
হবে । বুখারী- নাসাঈ, বায়হাকী
(৪) স্থল ও জল ভাগে যে ধন-সস্পদ নষ্ট হয় তা শুধু যাকাত বন্ধ করার দরুন।বাজ্জার,
বায়হাকী,তাবরানী
(৫) যাকাত যে মালের সাথে মিশ্রিত হয় সে মালকে যাকাত অবশ্যই ধ্বংশ করে দেয়।ঃ
বাজ্জার,বায়হাকী
(৬) আমি আদিষ্ট হয়েছি এ জন্য যে, আমি যুদ্ধ করব লোকদের সাথে যতন না তারা
স্যা দেবে যে আল্লাহ ছাড়া কেহ ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল,নামাজ কায়েম
করবে ও যাকাত দিবে। : বুখারী,মুসলিম
০৪। পূর্ববতী নবী-রাসূলের যুগে যাকাতঃ
দীন ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত পরিপূর্ন ও ভারসাম্যমূলক জীবন ব্যবস্থা। এ ভারসাম্য রার জন্য যাকাতের গুরুত্ব ব্যাপক। ইসলামের পাঁচটি মৌলিক ইবাদতের মধ্যে যাকাতকে তৃতীয় বলে ঘোষনা করা হয়েছে। দীনের সকল মৌলিক নীতি সব যুগেই এক ও অভিন্ন। দীনের সূচনাতে হযরত আদম (আঃ) এর সময় শরীয়াহ বিধান ছিলনা। হযরত নূহ (আঃ) থেকে শরীয়াহ প্রবর্তন হয়। বিভিন্ন নবী ও রাসূলগনের যুগে শরীয়াহ বিধান ভিন্ন ভিন্ন থাকলেও সালাত ও যাকাতে কোন ভিন্নতা ছিল না। এ কারনেই পবিত্র কোরআনে হযরত ইব্রাহিম (আঃ), হযরত ইসহাক (আঃ), হযরত ইয়াকুব (আঃ), হযরত ইসমাইল (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এর নাম যাকাত সংক্রান্ত বিভিন্ন আয়াতে ল্য করা যায়। অর্থাৎ পূর্ববতী অনেক নবী ও রাসূলের যুগেও যাকাত বিধান ছিল।
০৫। যাকাত ও দানের পার্থক্যঃ
ইসলাম সহ বিভিন্ন ধর্মেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে সেবা, সাহায্য,দান, ইত্যাদির তাগিদ রয়েছে। ইসলামে দান, খয়রাত, ফেতরা, সাদকা, কাফ্ফারা ইত্যাদি নামেও আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা রয়েছে। এ সব ছাড়াও যাকাতকে ইসলামের বাধ্যতামুলক আর্থিক ইবাদত মালদারের জন্য ঘোষনা করা হয়েছে।
যাকাত দান
১) উৎপাদনশীল সম্পদের যাকাত দিতে হয় ১) যে কোন সম্পদ থেকে দান করা যায়
২) নির্ধারিত আটটি খাতে যাকাত দিতে হয় ২) দাতার ইচ্ছামত দান করা যায়
৩) মালদারকে যাকাত আদায় করতে হয় ৩) দান যে কেউ করতে পারে
৪) যাকাতের নিয়ৎ করতে হয় ৪) দানের নিয়ৎ প্রয়োজন নাই
৫) যাকাত ধনীর মালে গরীবের হক ৫) দান ব্যক্তির ইচ্ছাধীন
৬) ইসলামী রাষ্ট্রে যাকাত আদায় সরকারী
দায়িত্ব ৬) দানে সরকারী কতৃত্ব নাই
৭) যাকাতের নির্দিষ্ট সময় ও পরিমান
নির্ধারিত ৭) দানে ইহা প্রযোজ্য নয়
০৬। যাকাত ও করের মধ্যে পার্থক্যঃ
যাকাত কর বা ট্যাক্স নয়, ইহা উচুঁমানের ইবাদত। নবীকরীম (সাঃ) রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনে এ ব্যবস্থার প্রচলন করেন নাই। আল্লাহ্পাক পবিত্র কোরআনে বহুবার যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।
যাকাত কর/ট্যাক্স
১) যাকাত ইসলামের ফরজ আইন ১) কর সরকারী আইন
২) যাকাত মুসলমানের ধর্মীয় কর, যাহা
ঈমানী ও আর্থিক ইবাদত ২)ট্যাক্স, খাজনা রাষ্ট্রীয় কর ধর্মীয়
ইবাদত নহে
৩) যাকাত আল্লাহ্ পাক কর্তৃক নির্ধারিত এবং
পরিবর্তনশীল নয় ৩) কর রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত, প্রয়োজনে
পরিবর্তনশীল
৪) যাকাত শুধুমাত্র মুসলমান মালদার
নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য ৪) রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য
প্রযোজ্য
৫) যাকাতের অর্থ আল্লাহ্র নির্দেশিত ও নির্ধারিত খাতে ব্যয় করতে হয় ৫) কর সরকারের ইচ্ছামত বিভিন্ন খাতে খরচ হয়
৬) যাকাতের অর্থ নির্ধারিত শুধু আট খাতের
নাগরিক উপকার পায় ৬) কর সকল নাগরিকের উপকার তথা সেবা দেবার জন্য আদায় করা হয়
৭) যাকাত ধার্য্য হয় মালদারের বৎসরের
প্রয়োজনীয় খরচ বাদে অতিরিক্ত
সম্পদের উপর ৭) কর ধার্য হয় বাৎসরিক আয়ের
উপর। সাংসারিক খরচ যাই হোক
৮) উশর (যাকাত) কৃষকের কৃষিজাত দ্রব্যের
উৎপন্ন ফসলের উপর নির্ধারিত ৮)কর কৃষকের ফসল হোক বা না হোক জমির উপর বাৎসরিক কর দিতেই হয়
৯) যাকাত ধর্মীয় আইন, মালদার মুসলমান
ইহাতে গাফলতী করতে পারে না ৯) কর নাগরিক আবেদন করে মওকুফ করতে পারে
(১০) যাকাত সম্পদের পূর্ণ এক চন্দ্র বছর
মালিকানা থাকার পর দিতে হয় (১০)কর বাংলা বা ইংরাজী আর্থিক বৎসরে সরকারী ভাবে সম্পদের কর নির্ধারিত হয়।
০৭। যাকাত কে দিবেঃ
১) যাকাত দাতাকে মূসলমান হতে হবে।
২) প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ্য ও বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে।
৩) নিসাব পরিমান মাল বৎসরের সকল মৌলিক প্রয়োজনের পর অতিরিক্ত থাকতে হবে।
৪) যদি একক ভাবে কোন পন্য বা দ্রব্যের মূল্য নিসাব পরিমান না হয় কিন্তু ব্যক্তির
সবগুলো সম্পদ মিলে একত্রে সাড়ে ৫২ তোলা বা প্রায় ৬১৩ গ্রাম রুপ্য
মূল্যের সমান হয় তবে ঐ ব্যক্তির নিসাব পূর্ণ হবে। অর্থাৎ যাকাত দিতে হবে।
৫) এতিম, পাগল বা নাবালকের পে কেহ অভিভাবক নিযুক্ত থাকলে তাকে যাকাত
দিতে হবে।
৬) সাংসারিক প্রয়োজনে গৃহিত ঋন কর্তনের পর নিসাব পরিমান সম্পদ থাকলে যাকাত
দিতে হবে।
৭) স্বামী-স্ত্রীর সম্পদ একই পরিবারের গন্য হলেও মালিকানা ভিন্নহেতু পৃথকভাবে নিজ নিজ
সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
৮) নির্ধারিত যাকাত পরিশোধের পূর্বেই সম্পদের মালিক মারা গেলে যাকাত পরিশোধের
পর ওয়ারিশগন মালিক বলে গন্য হবে।
০৮। যাকাতের নিসাব কাকে বলেঃ
নিসাব বলা হয় শরিয়তের নির্ধারিত আর্থিক নিম্নতম সীমা বা পরিমানকে অর্থাৎ যে পরিমান সম্পদ-মাল-অর্থ কোন ব্যক্তির সাংসারিক সকল মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর পর বছর শেষে নির্দিষ্ট তারিখে ঐ ব্যক্তির মালিকানায় থাকলে যাকাত প্রদান করতে হয় তাকে ইসলামী পরিভাষায় নিসাব বলে। বিভিন্ন মালের নিসাব বিভিন্ন।
০৯। সম্পদের নিসাব ও যাকাতের হার ঃ
সম্পদের নাম নিসাবের পরিমান যাকাতের হার
স্বর্ণ সাড়ে ৭ তোলা বা ৮৮ গ্রাম প্রায়। ২.৫০%
রৌপ্য সাড়ে ৫২ তোলা বা ৬১৩ গ্রাম প্রায়। ২.৫০%
নগদ টাকা,পন্য বাবিভিন্ন ভাবে গচ্ছিত অর্থ/সম্পদ সাড়ে ৫২ তোলা বা ৬১৩ গ্রাম প্রায় রুপ্যের সমমুল্য। ২.৫০%
উট ৫টি চারন ভুমিতে বা ব্যবসার জন্য পালিত হলে। ১টি ছাগল
গরু / মহিষ ৩০ টি চারন ভুমিতে বা ব্যবসার জন্য পালিত হলে। ১টি ১বছরের গরু/মহিষ
গরু / মহিষ ৪০টি চারন ভুমিতে বা ব্যবসার জন্য পালিত হলে। ১টি ২বছরের গরু/মহিষ
ছাগল/ভেড়া ৪০টি চারন ভুমিতে বা ব্যবসার জন্য পালিত হলে। ১টি ছাগল/ভেড়া
ছাগল/ভেড়া ১২১টি চারন ভুমিতে বা ব্যবসার জন্য পালিত হলে। ২টি ছাগল/ভেড়া
কৃষি ফল ও ফসল পাঁচ ওয়াসাক বা প্রায় ৯৪৮ কেজি, বা প্রায় ২৫ মন বা যে কোন পরিমান । প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে উৎপন্ন ফসলে ১০%। সেচ বা আধুনিক পদ্ধতির উৎপাদিত ফসলে ৫%
খনিজ সম্পদ যে কোন পরিমান ২০%।
ঘোড়া ব্যবসার জন্য পালিত হলে ধোড়া সাড়ে ৫২% তোলা রুপ্যের সমমূল্যে হলে। ২.৫০%।
(পশুর যাকাত পালনের ধরন ও সংখ্যার উপর নির্ভরশীল, উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে বেশী হলে যাকাতের পরিমান বেড়ে যাবে)
১০। যাকাত যে সম্পদের দিতে হবে ঃ
১) হালাল ধন-সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
২) সম্পদ প্রবৃদ্ধিমান বা উৎপাদনশীল হতে হবে।
৩) চারনভূমিতে বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে পালিত পশুর যাকাত দিতে হবে।
৪) ব্যবসা পন্যের যাকাত দিতে হবে।
৫) নিজ ব্যবহারের অতিরিক্ত বাড়ী বা ফাটের যাকাত দিতে হবে।
৬) সোনা-রুপার যাকাত দিতে হবে।
৭) নগদ অর্থের যাকাত দিতে হবে।
৮) নিজ বা বর্গায় চাষকৃত কৃষি সম্পদের যাকাত বা উশর দিতে হবে। তবে পচনশীল
ফসলের নয়।
৯) খনিজ সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
১০) সামুদ্রিক সম্পদ, রেশম চাষ, মধু চাষ ইত্যাদির যাকাত দিতে হবে।
১১)যৌথ মালিকানার অংশ নিজ অংশের সহিত মিলে নিসাব পরিমান সম্পদ হলে যাকাত
দিতে হবে।
১২) ব্যবসায় ব্যবহৃত ট্যাক্সি, সি এন জি, রিকসা, বাস, ট্রাক, ট্রলার, নৌকা, লঞ্চ,
প্রভৃতির আয়েরও যাকাত দিতে হবে।
১৩) নিজ মালিকানায় বিদেশে সম্পদ থাকলে যাকাত দিতে হবে।
১৪) ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সঞ্চয়ী হিসাব, বীমা পলিসি, বিভিন্ন সঞ্চয় পত্র, ডিপিএস, এফডিআর, পেনশনস্কীম, আইসিবি ইউনিট, প্রাইজবন্ড সহ বিভিন্ন বন্ডের জমাকৃত অর্থের যাকাত দিতে হবে।
১৫) নাবালক সন্তানের নামের সকল সঞ্চয়ের জমাকৃত অর্থের যাকাত দিতে হবে।
১৬) শেয়ার সার্টিফিকেটের যাকাত দিতে হবে।
১৭) ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত জমি/প্লটের যাকাত দিতে হবে।
১৮) ফেরৎদানের নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ পুর্বক যে কোন প্রকার ঋন (কর্জে হাছানা)বা বাকীর
অর্থ ফেরৎ না পেলে ঋনদাতাকে বা বাকি বিক্রেতাকে ঋনফেরৎ বা বাকির মূল্য ফেরত
পাবার পর যথানিয়মে বর্তমান বৎসরের মূলধন হিসাবে যাকাত দিতে হবে।
১৯ ) বানিজ্যিক ডেইরি ফার্ম, পোল্ট্রি ফার্মের বা মৎস্য খামারে উৎপাদিত দ্রব্যের যাকাত
দিতে হবে।
২০ ) বানিজ্যিক বা ইন্ডাষ্ট্রি গড়ার জন্য গৃহীত ঋনের যাকাত দিতে হবে।
২১) ব্যক্তিকে ওয়াফকৃত সম্পদ অর্থাৎ যে ওয়াফকৃত সম্পদের মালিকানা পরিবর্তন হয়
এমন সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
২২) মিল কারখানায় উৎপাদিত পন্যের যাকাত দিতে হবে।
২৩) ব্যবসার উদ্দেশ্যে চাষকৃত মাছের যাকাত দিতে হবে তবে রেনু বা ডিম উৎপাদনকারী
মাছের জন্য প্রযোজ্য নয়।
২৪) নিজ অভিভাবকত্বে এতিম বা নাবালকের বিভিন্ন সঞ্চয় বা সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
১১। যাকাত যে সম্পদের দিতে হবে নাঃ
০১) ব্যবসার দোকান ঘরের যাকাত দিতে হবে না।
০২) বসতবাড়ীর জন্য কেনা এমন অকৃষি জমি/প্লটের যাকাত দিতে হবে না।
০৩) ব্যবসায় ব্যবহৃত কারখানা বা দালানের যাকাত দিতে হবে না।
০৪) বসতবাড়ী/ দালান/ফাটের যাকাত দিতে হবে না।
০৫) ব্যবহারের পোষাকের যাকাত দিতে হবে না।
০৬) ঘরের তৈজসপত্র, দোকানের আসবাবপত্রের যাকাত দিতে হবে না।
০৭) গৃহপালিত পশু, পাখির যাকাত দিতে হবে না।
০৮) ব্যবসার জন্য পালিত এক বৎসরের কম বয়সের পশুর যাকাত দিতে হবে না।
০৯) অফিস বা গৃহের ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির যাকাত দিতে হবে না, যেমন
আসবাবপত্র, টিভি, ফ্রিজ, খাট, ফ্যান, এসি, ক¤িপউটার, ফোন,ফ্যাক্স ইত্যাদি।
১০) যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র -শস্ত্রের যাকাত দিতে হবে না।
১১) পচনশীল কৃষিজাত দ্রব্যের যাকাত দিতে হবে না।
১২) বৎসরের মাঝে অর্জিত বা ব্যয়িত সম্পদের যাকাত দিতে হবে না।
১৩) নিজ ব্যবহৃত সকল ধরনের যানবাহনের যাকাত দিতে হবে না যেমন কার, জীপ,
রিকসা, মটর সাইকেল, ঘোড়া বা অন্যান্য বাহন।
১৪) মুনিমুক্তা, লোহিতবর্ন প্রস্তর, শ্বেতপাথর এবং সমুদ্রের আহরিত দ্রব্যাদির যাকাত দিতে
হবে না।
১৫) চাকুরিজীবীর অফিসে বা সরকারী ফান্ডে সঞ্চিত তার সকল অর্থ হস্তগত হবার পূর্বে
যাকাত দিতে হবে না।
১৬) সাংসারিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋন বা বাকীর অর্থ নিসাব পরিমান হলেও দাতা বা
গ্রহিতাকে যাকাত দিতে হবে না।
১৭) যে সকল পশু কৃষিকাজ বা বাহনের কাজ বা সাংসারিক অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়
তার সংখ্যা যতই হক সে সকল পশুর যাকাত দিতে হবে না।
১৮) ডেইরি ফার্মের দুধ উৎপাদনের পশু এবং পোল্ট্রি ফার্মের ডিম উৎপাদনের জন্য হাঁস
মুরগির সংখ্যা যতই হোক না কেন তার যাকাত দিতে হবে না। উৎপাদিত পন্যের
যাকাত দিতে হবে।
১৯) জনকল্যানমুলক কাজে ওয়াকফ্ কৃত সম্পদের যাকাত দিতে হবে না যেমনঃ মসজিদ,
মাদ্রাসা, এতিমখানা, হাসপাতাল।
২০) হারাম মাল নিসাব পরিমান হলেও যাকাত দিতে হবে না।
২১) পারিবারিক খাবারের জন্য অথবা রেনু/পোনা উৎপাদনের জন্য চাষকৃত মাছের যাকাত
দিতে হবে না।
২২) নিজ ব্যবহৃত বীজের জন্য রতি ফসলের যাকাত দিতে হবে না।
২৩) শিল্পির বা কারিগরের যন্ত্রপাতির যাকাত দিতে হবে না।
২৪) মিলকারখানার মেশিন যন্ত্রপাতি ইত্যাদির যাকাত দিতে হবে না।
২৫) বশত বাড়ীর আঙ্গিনায় উৎপাদিত ফল, তরকারী, শাক-সব্জির যাকাত দিতে হবে না।
২৬) অভিভাবকহীন এতিম বা নাবালকের বিভিন্ন সঞ্চয় বা সম্পদের যাকাত দিতে হবে না।
১২। উশর বা ফসলের যাকাতঃ
কৃষিজাত পন্য-ফল ও ফসলের যাকাতকে ইসলামী পরিভাষায় উশর বলে। বাংলাদেশের জমি উশরী কিনা তা নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও অধিকাংশের মতামত উশর প্রদানের প।ে
(ক) ফসলের নিসাবঃ
ইমাম আবু হানিফা (রাহঃ) এর মতে ফসল কম বেশী যাই হোক উশর আদায় করতে হবে। ইমাম আবু ইউসুফের মতে এবং বুখারী মুসলিম তিরমিজীর ভাষ্যে পাঁচ ওয়াসাকের কম পরিমান ফসলে যাকাত নাই। পাঁচ ওয়াসাক সমান প্রায় ৯৪৮ কিলোগ্রাম বা প্রায় ২৫মন।
(খ) উশরের পরিমানঃ
১) যে জমিতে সেচ-সার, কীটনাশক ব্যতিরেকে প্রাকৃতিক উপায়ে ফসল উৎপাদিত হয় তার
উশর ফসলের দশভাগের এক ভাগ।
২) যে জমিতে সেচ-সার,কীটনাশক ইত্যাদি সহ আধুনিক উপায়ে ফসল উৎপাদিত হয় তার
উশর ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ।
৩) পাকিস্তানে নিসাব পরিমান ফসলের ২৫% উৎপাদন ব্যয় বাবদ কর্তন করে অবশিষ্ট
ফসলের উশর দশ ভাগের এক ভাগ গন্য করা হয়।
(গ) উশরের শর্তঃ
১) সম্পদের নিসাব পরিমান মালের মালিককেই উশর আদায় করতে হবে।
২) জমির খাজনা বা কর দিলেও উশর আদায় করতে হবে।
৩) বছরে একাধিক ফসল উৎপন্ন হলে প্রতি ফসলেই উশর দিতে হবে।
৪) উৎপন্ন সকল ফসলের উপরই উশর ফরজ, কাজেই জমির মালিক পাগল, ক্রীতদাস,
নাবালগ, পরাধীন বা ওয়াকফকৃত যাহাই হোক না কেন উশর আদায় করতে হবে।
৫) ইজারা বন্দোবস্ত জমির শষ্যের উশর ইজারাদারের উপর ওয়াজিব।
৬) বর্গাজমির উশর উভয়ের ফসলেই আদায় করতে হবে।
৭) পচনশীল, ওজনযোগ্য নয়, ঔষধ বা খোশবু তৈরীতে ব্যবহৃত হয় এমন ফসলের
উশর নাই।
৮) বশতবাড়ীর আংগিনায় উৎপাদিত ফসলের উশর নাই।
৯) অমুসলিমের জমির ফসলে উশর নাই।
১৩। পশুর যাকাতঃ
পশুর শ্রেনী, পালনের ধরন, মালিকানা, বয়স ও নিসাবের সংখ্যা অনুযায়ী যাকাত ধার্য্য হয়। তবে সকল পশুর যাকাত নাই। উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির উপর যাকাত ফরজ। রাসুলে করীম (সাঃ) ও খিলাফাতের আমলে পশু সম্পদকে অর্থনীতির ভিত্তি মনে করা হতো। বর্তমানে পোপট পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশে সম্ভবত সায়েমা পশু পাওয়া যাবে না। সায়েমা হলো সেই পশু যা বছরের অধিকাংশ সময় নিজেই মাঠে/ঘাসে বিচরন করে খাদ্য গ্রহন ও বংশ বৃদ্ধি করে থাকে।
(ক) পশুর যাকাতের শর্তঃ
১) নির্র্ধারিত নিসাব পরিমান পশু থাকলে যাকাত দিতে হবে (পশুর নিসাব কত তাহা
সম্পদের নিসাব ও যাকতের অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
২) শুধুমাত্র চারন ভুমিতে পালিত সায়েমা পশু ও ব্যবসার উদ্দেশ্যে পালিত পশুর যাকাত
দিতে হবে।
৩) যে পশু গৃহে আহার বা গৃহকর্তার ব্যবস্থাপনায় আহার খায় বা গৃহস্থালীর কাজ করে বা
বাহনের কাজ করে সে সকল পশুর যাকাত দিতে হবে না।
৪) অশ্ব যখন বংশ বৃদ্ধি বা ব্যবসার জন্য পালিত হয় তখন যাকাত দিতে হবে।
আরোহন,পরিবহন ও যুদ্ধের জন্য পালিত হলে যাকাত দিতে হবেনা।
১৪। ডেইরী, পোল্ট্রি ও মৎস্য খামারের যাকাতঃ
বর্তমান যুগের ডেইরী ফার্ম, পোল্ট্রি ফার্ম বা মৎস্য খামারের প্রচলন পূর্বে ছিল না। বর্তমানে ইহার যাকাত নির্ধারনের জন্য মধুর যাকাত বা গুটি পোকা ও রেশমের যাকাতের মূলনীতি অনুসরন করে যাকাত নির্ধারন করা হয়েছে, যাহা নিম্নরুপঃ
(ক) ডেইরী, পোল্ট্রি ও মৎস্য খামারের যাকাতের শর্তঃ
১) ডেইরী ফার্মের গবাদি পশু দুগ্ধ, মাখন উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পালিত হলে এসব পশু পন্য উৎপাদক পর্যায় ভুক্ত। তাই এসবের যাকাত দিতে হবে না। তবে উৎপন্ন দ্রব্যের যাকাত দিতে হবে।
২) পশু মোটা তাজা করে বিক্রির জন্য পালিত হলে তার যাকাত দিতে হবে।
৩) পোল্ট্রি ফার্মে যদি ডিম বিক্রি বা ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য হাঁস মুরগি পালিত হয় তবে তার যাকাত দিতে হবেনা, তবে ডিম বা বাচ্চার যাকাত দিতে হবে।
৪) পোল্ট্রি ফার্মের ব্রয়লার/বাচ্চা বড় করে গোশতের জন্য বা লাভের জন্য বিক্রি করলে তার যাকাত দিতে হবে।
৫) মৎস্য খামারে রেনু বা পোনা বিক্রির জন্য পালিত মাছের যাকাত দিতে হবে না, তবে রেনু বা পোনার যাকাত দিতে হবে।
৬) ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মৎস্য চাষ করলে তার যাকাত দিতে হবে, তবে শুধুমাত্র পরিবারের খাবারের জন্য চাষকৃত মাছের যাকাত দিতে হবে না।
১৫। স্বামী-স্ত্রীর সম্পদ বা অলংকারের যাকাত কে দিবেঃ
স্বামী-স্ত্রীর সম্পদ একই পরিবারের গন্য হলেও মালিকানা ভিন্ন তাই পৃথকভাবে নিজ নিজ সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে। স্ত্রীর যদি অলংকার ব্যতিত অন্য কোন সম্পদ না থাকে তবে স্ত্রীর হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে বা কিছু অলংকার বিক্রি করে যাকাত আদায় করতে হবে। অলংকারের যাকাত স্ত্রীর পে স্বামী আদায় করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
১৬। বিগত বৎসরের কাযা যাকাতঃ
হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ আল্লাহ্র শপথ, যে ব্যক্তি সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে অবশ্যই আমি তাহার বিরুদ্ধে জিহাদ করিব। আমাদের বুঝতে হবে নামাজ-রোজার মত যাকাতের একই হুকুম। অজ্ঞতা বা অলসতা বশত এ ফরজ ছেড়ে দিয়ে শুধূ তওবা করলে দায়িত্ব পালন হবে না। পিছনের অনাদায়ী যাকাত হিসাব করে আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৭। যাকাত আদায়ের সময়ঃ
রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন ধনীর ধন-সম্পদ পুরো এক বছর কাল মালিকের অধিকারে না থাকলে তার উপর যাকাত আদায় করার বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ যে কোন নিসাব পরিমান সম্পদ পূর্ণ একবছর কাল ভোগ দখলের পরই যাকাত আদায় করতে হয়। প্রতি বৎসর একটি নির্দিষ্ট তারিখে সংসারে যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর পর যে সম্পদ/মাল/অর্থ ইত্যাদি অতিরিক্ত বা অবশিষ্ট থাকে তাহা যদি নিসাব পরিমান হয় তবে শর্তমতো যাকাত প্রদান করতে হবে। তবে কৃষিজাত ফসলের উশর (যাকাত) ফসল ঘরে তোলার সময়ই হিসাবমত আদায় করতে হবে। রাসুল(সাঃ) বলেছেন, রমজানের একটি নফল ইবাদত অন্য
সময়ের ফরজ ইবাদতের সমান এবং একটি ফরজ ইবাদত অন্য সময়ের ৭০টি ফরজের সমান। রমজানে ইবাদতের সওয়াব অন্য মাসের চেয়ে অনেক বেশী। তাই মুসলমানেরা সাধারনত রমজানে যাকাত আদায় করে থাকেন।রমজানের ১ম তারিখকে যাকাত বৎসরের তারিখ নির্দিষ্ট করে মালদার তার সকল স¤পদের হিসাব করে যাকাত নির্ধারন করতে পারেন।
১৮। যাকাতের নিয়ৎ ঃ
১) যাকাত পরিশোধে অবশ্যই সংকল্প বা নিয়ৎ করতে হবে। ইহা ফরয ইবাদত। নিয়ৎ
করা ওয়াযিব।
২) মুখে উচ্চারন করে বা যাকাত গ্রহনকারীকে শুনিয়ে বলা প্রয়োজন নাই। তবে মনে মনে
সংকল্প অবশ্যই করতে হবে আমি যাকাত আদায় করছি অন্যথায় যাকাত আদায় হবে
না। ইহা সাধারন দান হিসাবে গন্য হবে।
৩) যাকাতের টাকা পূর্বেই হিসাব করে রাখা থাকলে দেবার সময় পুনরায় নিয়াতের দরকার
হবে না।
৪) কোন ব্যক্তিকে যাকাত দেবার সময় নিয়ৎ না করলে গ্রহনকারীর মাল বর্তমান থাকা
অবস্থায় নিয়ৎ করলেও যাকাত আদায় হবে।
৫) বাৎসরিক যাকাত হিসাব করার পূর্বেও অগ্রীম হিসাবে যাকাত আদায় করা যাবে।
৬) হাওলাত,ঋন, অথবা বাকি প্রদান করে পরবর্তিতে যাকাত এর নিয়াতে মাফ করে দিলে
যাকাত আদায় হবে না।
১৯। যাকাত কাকে দেওয়া যাবেঃ
নিম্ন লিখিত আট খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা ফরজ। আল্লাহ্পাক কোরআনে বলেনঃ
যাকাত কেবল ফকির মিসকিন ও তৎসংশ্লিষ্ঠ কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষন করা উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋনে জর্জরিত ব্যাক্তিদের জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। তওবাঃ ৬০
০১। ফকিরঃ
যে ব্যক্তি মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিা চায়, যারা সর্বদা অভাব অনটনে জীবন কাটায়, নিজ জীবিকার জন্য অন্যের মুখাপেী এরাই ফকির।
০২। মিসকীনঃ
একজন দরিদ্র ভদ্রলোককে বুঝায়, যার বাহ্যিক অবস্থা দেখেও অভাবগ্রস্থ মনে হয় না, স্বীয় আতœসম্মান বোধের জন্য অপরের নিকট সাহায্য চাইতে পারেনা অথচ কঠোর শ্রম ও প্রানান্তর চেষ্টার পরও সংসারের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনা। সমাজে তথা নিজ আতœীয় স্বজনদের মধ্যে এরকম কেহ থাকলে তারাই হকদার বেশী।
০৩। যাকাত আদায়কারী কর্মচারীঃ
সরকারী ভাবে নিযুক্ত যাকাত আদায় ও বিতরনের কর্মচারী। বর্তমানে এই খাত বাংলাদেশে প্রযোজ্য নয়।
০৪। মন জয় করার জন্য নওমুসলিমঃ
যাদের অন্তর ইসলামের প্রতি আকৃষ্ঠ তবে সামাজিক বা আর্থিক ভয়ে ইসলাম ধর্মে আসছে না তাদের সাহায্য করে প্রকাশ্যে দলভুক্তি করা অথবা যারা নও মসলিম হয়েছে অন্য ধর্ম ছাড়ার কারনে পারিবারিক সামাজিক ও আর্থিক ভাবে বঞ্চিত হয়েছে তাদের সাহায্য করে ইসলামে সুদৃঢ় করা।
০৫। ঋনমুক্তির জন্যঃ
জীবনের মৌলিক চাহিদা পুরনের জন্য সংগত কারনে ঋনগ্রস্থ ব্যক্তিদের ঋনমুক্তির জন্য যাকাত প্রদান করা যায়।
০৬। দাসমুক্তিঃ কৃতদাসকে মুক্তির জন্য এ প্রথা এখন প্রযোজ্য নয়।
০৭ । ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহ্র পথেঃ
সাবিলিল্লাহ শব্দের অর্থ ব্যাপক। যে সব কাজ দ্বারা আল্লাহ্র সন্তোষ ও নৈকট্য লাভ করা যায় তাকেই ফি-সাবিলিল্লাহ্ বুঝায়। অন্যকথায় মুসলিম জনগণের কল্যানকর যাবতীয় কাজ যার ফলে দ্বীন ও রাষ্ট্রের স্থিতি আসে এমন কাজ।
০৮ । মুসাফির/প্রবাসীঃ
পথে বা প্রবাসে মুসাফির অবস্থায় কোন ব্যক্তি বিশেষ কারনে অভাব গ্রস্থ হলে ঐ ব্যক্তির বাড়ীতে যতই ধন-সম্পদ থাকুক না কেন তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।
২০। যাকাত কাকে দেওয়া যাবে না ঃ
১) নিসাব পরিমান মালের অধিকারী বা ধনীকে যাকাত দেওয়া যাবে না (মুসাফির ব্যতিত)।
২) সম্পদশালীর নাবালক পুত্র-কন্যাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
৩) কুরাইশ গোত্রের বনু-হাশিম এর অন্তর্গত আব্বাস, জাফর, আকীল (রাঃ) এর বংশধরের জন্য যাকাত গ্রহন বৈধ নয়।
৪) অমুসলিম ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
৫) যে সব প্রতিষ্ঠানে ধনী-গরীব সবাই সেবা পায় সেখানে যাকাত দেওয়া যাবে না।যেমনঃ মসজিদ, মাদ্রাসা (এতিম ফান্ড বা লিল্লাহ বোডিং ব্যতিত), শিাপ্রতিষ্ঠান, আশ্রয়কেন্দ্র, সেতু, টিউবয়েল, কুপ, পুকুর,রাস্তাঘাট ইত্যাদি।
৬) দরিদ্র পিতামাতা, সন্তান,দাদা,নানা,স্বামী বা স্ত্রীকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
৭) প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত কর্মচারী প্রতিষ্ঠানের পে এতিমখানা/লিল্লাহ বোডিং এর জন্য
যাকাত আদায় কারী নিযুক্ত হলে তাকে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু হাদিয়া/উপঢৌকন হিসাবে
দেওয়া যাবেনা।
৮) উপার্জনম ব্যক্তি যদি উপার্জন ছেড়ে দিয়ে নামাজ-রোযা ইত্যাদি নফল ইবাদতে
মশগুল হয়ে যায় তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
৯) উপার্জনম অলস ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
১০) নিজ চাকর চাকরানীকে যাকাতের টাকায় বেতন-ভাতা দেওয়া যাবেনা।
২১। যাকাত একজনকে কতটুকু দেওয়া যাবেঃ
হানাফী মাজহাবে পর্যাপ্ত পরিমান যাকাত প্রদান বৈধ। সাধারনত দুশো দিরহামের বেশী বা নিসাব পরিমানের বেশি দেওয়া মাকরূহ্ তবে পারিবারিক প্রয়োজন বা ঋনগ্রস্থদের জন্য অথবা নিজ আতœীয়দের সচ্ছল করার জন্য ইহার কোন নির্ধারিত পরিমান নাই। হযরত উমর (রাঃ) বলেন, যখন দাও সচ্ছল বানিয়ে দাও। ইমাম মুহাম্মাদ (রাঃ) বলেন, যাকাত দিয়ে কোন ব্যক্তিকে সচ্ছল বানিয়ে দেওয়া আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়।
২২। যাকাত বন্টনের এলাকাঃ
এলাকার যাকাত এলাকেতেই প্রদান মসনুন। যেমনঃ ভাই, বোন, চাচা,মামা,ফুপু,খালা,শ্বশুর এবং তাদের সšতানগণ, নিজ জামাতা,বিমাতা ইত্যাদি হক দার যদি থাকে তা আদায়াšেতর পর নিজ চাকর-চাকরানী,প্রতিবেশী, মহল্লাবাসী, গ্রামবাসী, পরিচিত এলাকার দরিদ্র আলেম, এলমেদ্বীন শিার্থী, মাদ্রাসার লিল্লাহ বোডিং ইত্যাদি খাতে বন্টনের পর দেশের সার্বিক কল্যানের স্বার্থে অন্যত্র বন্টন করা যাবে।
২৩। বর্তমান প্রোপটে যাকাত ও প্রস্তাবনা ঃ
পবিত্র কোরআনের উল্লেখিত ৮টি খাতের মধ্যে ৬টি খাতই বিভিন্নভাবে দারিদ্রের সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামী চিন্তাবিদগন ঐক্যমত পোষন করেন যে সরকারী ভাবে আইনের মাধ্যমে যাকাত আদায় ও প্রদানের ব্যবস্থা না থাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিম্ন লিখিত খাতে যাকাত আদায় ও বিতরনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বর্তমান পোপট বিবেচনা করে এদেশের সকল সচেতন মুসলিম ভাই-বোনদের এ ব্যপারে এগিয়ে এসে খোদাপ্রদত্ব অর্থনীতি চালু করে সমাজে কোরআনের আইন ও সূন্নাহর সুফল বয়ে আনতে হবে।
(ক) স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী প্র¯তাবঃ
দেশের যে সব এলাকায় বিভিন্ন নামের সেবা প্রতিষ্ঠান বা মিশনারী সামাজিক উন্নয়নের কথা বলে সাধারন জনগনকে বিধর্মীয় সং®কৃতি, বেদায়েতী প্রথা চালু, বিতর্কিত ধর্মীয় প্রথা প্রচলন তথা ইসলামকে হীন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সে সব এলাকায় বিশেষ প্রোগ্রাম চালু করে কোমলমতি জনগনকে ইসলামের প্রকৃত আর্থিক ও সামাজিক সুফল প্রতিষ্ঠা করা একান্ত জরুরী।
০১) চিহ্নিত গরীব, মিসকিন, দুঃখী, দুস্থ, রুগ্ন,অম, পঙ্গু, বৃদ্ধ, ইয়াতিমদের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা।
০২) ইসলামের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য এমনস্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা
যাতে সমাজে ইসলামের ভিত মজবুত হয়। এ জন্য গবেষনা, প্রকাশনা ও প্রশিনের
উন্নততর ব্যবস্থা নেওয়া।
০৩) দরিদ্র, মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সহ সকল শিা প্রতিষ্ঠানে
যাকাত ফান্ড থেকে নিয়মিত ষ্টাইপেন্ড, স্কলারশীপ বা বিনা মূল্যে শিার ব্যবস্থা করা।
০৪) নিজ নিজ এলাকায় বয়স্ক ধর্মীয় এবং সাধারন শিার ব্যবস্থা চালু করা।
০৫) স্বাস্থ্য সেবার জন্য স্থানীয় কিনিক, হাসপাতাল, ডিসপেনসারী প্রভৃতিতে যাকাত ফান্ডের
টাকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
(খ) পরিবার উন্নয়ন প্র¯তাবঃ
যাকাত প্রধানত ব্যক্তি বা পরিবারের দুরাবস্থা দুরীভুত করার জন্যই ব্যয়িত হতে পারে।
০১) শিতি, অশিতি, বেকার পুরুষ/মহিলা সকলকে কর্মসংস্থানের জন্য ট্রেনিং তথা
কর্মের মূলধন দিয়ে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করা।
০২) ঋনগ্রস্থদের ঋন পরিশোধের ব্যবস্থার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও তদারকি
প্রদান করা যেন আবার ঋন গ্রস্থ হয়ে না পরেন।
০৩) প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, ঘূর্নিঝড়, জলোচ্ছাস, ভুমিকম্প, ইত্যাদিতে তিগ্রস্থদের
সাহায্যের জন্য যাকাত তহবিল সংরতি করা।
০৪) কন্যাদায় গ্রস্থ বা বিধবাদের সহযোগীতার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া।
০৫) দাসমুক্তি প্রথা না থাকলেও বর্তমানে অনেক মুসলমান কারাবন্দি আইনের অপপ্রয়োগ
বা জটিলতার কারনে বিচারে বা বিনা বিচারে কারাগারে মানবেতর জীবন যাপন
করছেন। এদের মানষিক উন্নয়ন, ধমীয়শিা ও পারিবারিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা
যেতে পারে।
(
সংগ্রহ)
বিষয়: বিবিধ
১৭৫০ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ও সহজ করে লিখা একটি বই হচ্ছে ডঃ আবুবকর রফিক লিখিত "যাকাত এর আহকাম"।
প্রকাশক-সিআরপিএস,চট্টগ্রাম। ০১৭১১৭৩৯৩১৩
মন্তব্য করতে লগইন করুন