আমি তো হাসতে হাসতে অস্থীর আপনারা একটু দেখুন ! ২০১২ ব্যানার নিয়ে ২০১৩ তে শোক দিবস পালন করে তাও আবার , ৩৮ তম না ৩৭ তম।
লিখেছেন লিখেছেন কথার_খই ১৫ আগস্ট, ২০১৩, ০৪:৫৮:২৩ বিকাল
আমি তো হাসতে হাসতে অস্থীর আপনারা একটু দেখুন !
২০১২ ব্যানার নিয়ে ২০১৩ তে শোক দিবস পালন করে তাও আবার , ৩৮ তম না ৩৭ তম।
১৯৭৫-এর আগস্ট হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে বিতর্ক
শা হ আ হ ম দ রে জা
কথায় বলে, কথায় কথা বাড়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা ছিলেন বলেই মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়েও কথা শুধু বেড়েই চলেছে। সেটা হত্যাকাণ্ড ছিল, নাকি ছিল অভ্যুত্থান—এ প্রশ্নের উত্তর নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য অবশ্য কিছু তথ্যের উল্লেখ করা, যেগুলো বহুল আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ড এবং তার বিচারের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে এসেছে। এসব তথ্য শুধু কৌতূহলোদ্দীপক নয়, যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণও। কারণ, এমন অনেককেও মরহুম নেতার জন্য দরদে উথলে উঠতে দেখা গেছে, জীবদ্দশায় যারা ছিলেন ঘোর মুজিব বিরোধী। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এরকম একজন নেতা। মুজিব হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হওয়ার পর ‘ইতিহাসের সত্য’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে গুরুগম্ভীর মন্তব্য করেছিলেন তিনি। মনে হয়েছে, শেখ মুজিবের প্রতি ভক্তি দেখানোর ব্যাপারে মেনন সম্ভবত শেখ হাসিনাকেও ছাড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। অন্যদিকে ‘ইতিহাসের সত্য’ কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য রকম। পাকিস্তান আমল থেকেই মেনন আওয়ামী লীগ বিরোধী ভূমিকা পালন করে এসেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে তিনি ছিলেন মওলানা ভাসানীর অনুসারী এবং একজন ‘কমরেড’। আওয়ামী লীগ বিরোধী হওয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মেননকে ভারতে গিয়ে ধাওয়া খেতে হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও মেনন মুজিব সরকার বিরোধী নেতা হিসেবে তত্পরতা চালিয়েছেন। তিনি ছিলেন ভাসানী ন্যাপের প্রচার সম্পাদক। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী ও কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে গঠিত দল ইউনাইটেড পিপ্লস পার্টি (ইউপিপি)-র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মেনন।
শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের প্রতি রাশেদ খান মেননদের মনোভাব সম্পর্কে জানার জন্য ইউপিপির একটি বিবৃতির অংশবিশেষ উল্লেখ করা যায়। হত্যাকাণ্ডের পর পর, ১৯৭৫ সালের ২৯ আগস্ট প্রচারিত এই বিবৃতিতে ইউপিপি বলেছিল, ‘গত ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গত সাড়ে তিন বছরের ঘৃণ্য ও গণধিকৃত মুজিবী রাজত্বের অবসান হয়েছে। লুট-দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ-অনাহার, চোরাচালান-পারমিটবাজি, স্বৈরাচার-পারিবারিক রাজত্ব কায়েম, জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ও অবমাননায় বিক্ষুব্ধ জনগণ প্রতি মুহূর্তে মুজিবের পতন কামনা করেছে।... ’ বিবৃতির পরের অংশে বলা হয়েছিল, ‘মুজিবের অপসারণে জনগণ উল্লসিত। তার মৃত্যু কারও মনে সামান্যতম সমবেদনা বা দুঃখ জাগায়নি—জাগাতে পারে না।...’ রাশেদ খান মেননদের মধ্যে এতটাই কঠোর মনোভাব ছিল শেখ মুজিব ও তার সরকার সম্পর্কে। আওয়ামী মহাজোটে গিয়ে সে মেননই জনগণকে ‘ইতিহাসের সত্য’ শেখাতে চেয়েছেন!
রাজনৈতিক ধান্ধাবাজির উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের ধামা ধরার ব্যাপারে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুও কম দেখাননি। এই ইনু সম্পর্কে পিলে কাঁপানো কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে দৈনিক আমাদের সময়। ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর প্রকাশিত এক রিপোর্টে দৈনিকটি জানিয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর হাসানুল হক ইনু শাহবাগস্থ বেতার ভবনে গিয়ে অভ্যুত্থানের নায়কদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছিলেন এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রতি সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি একা যাননি, গিয়েছিলেন লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের সঙ্গে। তাহের তখন জাসদের গণবাহিনীর অধিনায়ক, আর ইনু ছিলেন গণবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিশনার। সে কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে দৈনিক আমাদের সময় লিখেছে, ইনুদের বেতার ভবনে যাওয়াটা কোনো আকস্মিক বিষয় ছিল না। শেখ হাসিনাকে খুশি করার কৌশল হিসেবে ইনুরা এখন যাদের ‘খুনি মেজর’ বলছেন, তাদের সঙ্গে কর্নেল তাহের ও ইনুসহ জাসদ নেতাদের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। ১৫ আগস্টের আগে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান কর্নেল তাহেরের সঙ্গে তার নারায়ণগঞ্জের অফিসে গিয়ে দেখা করেছিলেন। তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের গণবাহিনী সে সময় সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মুজিব সরকারকে উত্খাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে তত্পর ছিল।
একটি বিশেষ ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে। আগস্ট অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা কর্নেল রশিদের নির্দেশে একজন জুনিয়র অফিসার নারায়ণগঞ্জে গিয়ে কর্নেল তাহেরকে শাহবাগস্থ বেতার ভবনে আসার অনুরোধ জানিয়েছিলেন এবং কর্নেল তাহের বেতার ভবনে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন হাসানুল হক ইনু। বেতার ভবনে তাহের ও ইনুর সঙ্গে অভ্যুত্থানের সব নেতার দেখা ও কথা হয়েছিল। বেতার ভবনেরই অন্য একটি কক্ষে নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের সঙ্গেও আলোচনা করেছিলেন তাহের ও ইনু। পটপরিবর্তনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বাকশালকে বাদ দিয়ে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করার প্রস্তাব রেখেছিলেন তাহের ও ইনু। এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন গোপন দলিলপত্রেও কিছু চমকপ্রদ তথ্য জানা গেছে। এরকম একটি তথ্য হলো, আগস্ট অভ্যুত্থানের নায়করা কর্নেল তাহেরকে বঙ্গভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিন-চারদিন কাটানোর পর খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তাহের বঙ্গভবন থেকে চলে এসেছিলেন। এখানে মূল বিষয়টি লক্ষ্য করা দরকার। প্রথমে বেতার ভবনে যাওয়া ও পটপরিবর্তনকে সমর্থন জানানো এবং তারপর বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তিন-চারদিন বসবাস করার মতো তথ্যগুলো প্রমাণ করে, কর্নেল তাহের ও ইনুসহ জাসদের নেতারা মুজিব সরকারের পতনে উল্লসিত হয়েছিলেন। অভ্যুত্থানের প্রতিও তাদের সমর্থন ছিল। ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত শুধু নয়, এর পরের কয়েকদিন পর্যন্তও ইনু-তাহেরদের তত্পরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। মার্কিন দলিলপত্রে জানানো হয়েছে, সিপাহী-জনতার বিপ্লব সফল হওয়ার পর তাহেরকে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে ‘ঘুরে বেড়াতে’ দেখা গেছে। ‘অধিকাংশ সময়’ তিনি জিয়ার সঙ্গেই থেকেছেন। সব মিলিয়েই মেনন বর্ণিত ‘ইতিহাসের সত্য’ হলো, শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডসহ ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের প্রতি হাসানুল হক ইনুরা সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহেও তাহের ও ইনুরা সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সে ইনুই এখন সেদিনের নায়কদের ‘খুনি’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন! বিনিময়ও পেয়েছেন তিনি।
এ পর্যন্ত এসে পাঠকদের মনে নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন জাগতে পারে। হত্যাকাণ্ড না অভ্যুত্থান—এ ধরনের বিতর্কে যাওয়ার পরিবর্তে উদ্দেশ্য আসলে কিছু তথ্য জানানো। প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহর বিবাদ ও বাকযুদ্ধ এ রকম একটি তথ্য। ১৯৭৫-পরবর্তী অন্য অনেক সুবিধাভোগীর মতো অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সফিউল্লাহর মধ্যেও মাঝখানে ‘মোড়ল’ হওয়ার ইচ্ছা দেখা দিয়েছিল। ‘সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করিয়ে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের দাবিতে শোরগোল তোলার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে বিদেশি শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর অভিযোগ উঠলেও সফিউল্লাহ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। এভাবে ভালোই এগোচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু মাঝখানে বাধার সৃষ্টি করেছেন আওয়ামী লীগেরই জাঁদরেল নেতা শেখ সেলিম। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৯ সালের ১৯ ও ২২ আগস্ট আয়োজিত দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলের একেবারে নাড়ি ধরে টান মেরে বসেছেন। বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ‘নেপথ্য ভূমিকায়’ ছিলেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেখ সেলিম বলেছেন, সেদিন ভোর পৌনে পাঁচটা থেকে পাঁচটার মধ্যে তার বড় ভাই শেখ ফজলুল হক মণির বাসভবনে এবং পৌনে ছয়টা থেকে ছয়টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের বাসভবনে হামলা হয়েছিল। মাঝখানের এক ঘণ্টার মধ্যে একাধিকবার সফিউল্লাহকে টেলিফোন করে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু জবাবে সফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে বাসভবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন!
উল্লেখ্য, ২২ আগস্টের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। সফিউল্লাহ নিজেও বসা ছিলেন সামনের সারিতে। তাকে লক্ষ্য করে শেখ সেলিমের সোজা কথা ছিল, সেনাপ্রধান হিসেবে সফিউল্লাহ কেন রাষ্ট্রপতির টেলিফোন পাওয়ার পরও ব্যবস্থা নেননি তা ‘রহস্যজনক’। তাছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর ‘খুনিরা’ সেনানিবাসে গিয়েছিল। সেখানে রেড অ্যালার্ট জারি করেও ‘খুনিদের’ গ্রেফতার করা যেত। কিন্তু সফিউল্লাহ উল্টো তাদের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন। রেডিওতে গিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন। শেখ সেলিম তাই জানতে চেয়েছেন, এসবের রহস্য কি?
ওদিকে হঠাত্ আক্রান্ত হয়ে পুরোপুরি ডিফেন্সিভে চলে গিয়েছিলেন জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ। দ্বিতীয় দফা আক্রমণের পরদিন, ২৩ আগস্ট একটি দৈনিকে প্রকাশিত সাক্ষাত্কারে শেখ সেলিমের অভিযোগকে তার বিরুদ্ধে ‘নতুন ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘তখনকার’ বাস্তবতা ‘এখনকার’ মতো ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে হত্যার বিষয়ে তিনি নাকি কোনো তথ্যই জানতেন না! কারণ, ১৯৭৪ সালে ডিজিএফআইকে তার হাত থেকে সরিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে নেয়া হয়েছিল এবং এর ফলে তিনি একেবারে ‘অন্ধ ও বধির’ হয়ে পড়েছিলেন! রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার কাছ থেকে অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। সুতরাং হত্যাকাণ্ডে তার কোনো ‘ব্যর্থতা’ নেই। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব তার কাছে টেলিফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন—এই প্রচারণাকে অসত্য দাবি করে সফিউল্লাহ বলেছেন, রাষ্ট্রপতি নন, তিনিই রাষ্ট্রপতিকে টেলিফোন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছিলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স বোধহয় আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। ওরা সম্ভবত কামালকে মেরে ফেলেছে। তুমি দ্রুত ফোর্স পাঠাও।’ উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। আপনি কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন?’ রাষ্ট্রপতি কোনো উত্তর দেননি, টেবিলের ওপর টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিলে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ পেয়েছিলেন সফিউল্লাহ। তারপর (দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে) বেশ কয়েক মিনিট তিনি ‘হ্যালো, হ্যালো’ করেছেন। কিন্তু জবাব পাননি। কিছুক্ষণ পর বেশকিছু গুলির শব্দ শুনেছিলেন। শুনে তার মনে হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি হয়তো আর বেঁচে নেই।
সফিউল্লাহ দাবি করেছেন, ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক কর্নেল সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে তিনি হামলার প্রথম খবর পেয়েছিলেন। তার মাধ্যমেই তিনি ঢাকা ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ধানমন্ডি যাওয়ার নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শাফায়াত জামিলের সেনারা নাকি ‘মুভ’ করেনি। এর মধ্যেই সফিউল্লাহ নাকি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল আহমদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি যেন রাষ্ট্রপতিকে তার বাসভবন থেকে বের করে নিয়ে যান (অথচ সফিউল্লাহ নিজেই আবার বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার কাছ থেকে অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল!)। সফিউল্লাহ বলেছেন, উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও নাকি তার নির্দেশ অমান্য করেছিলেন!
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের নিহত হওয়ার ব্যাপারে সফিউল্লাহ ‘নিশ্চিত খবর’ পেয়েছিলেন সকাল আটটার দিকে। তিনি তখন তার অফিসে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন (এই দু’জন নাকি তার টেলিফোনে দেয়া নির্দেশ পালন করেননি!)। ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য’ সফিউল্লাহ নাকি এরপর ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে সেখানকার সৈন্যদের মধ্যে ‘আনন্দের আভা’ দেখতে পেয়েছিলেন! ততক্ষণে ওই সৈন্যরাও নাকি ‘খুনিদের’ সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সেখান থেকেই তাকে নাকি ‘চাপাচাপি’ করে রেডিও অফিসে নেয়া হয়েছিল। সেখানে আগে থেকে উপস্থিত খন্দকার মোশতাক আহমদ তাকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন এবং ‘কাজ শেষ হওয়ায় বিশ্রাম নিতে’ বলেছিলেন (জড়িত না থাকলে ‘অভিনন্দন’ জানানোর, ‘কাজ শেষ’ হওয়ার এবং ‘বিশ্রাম’ নেয়ার প্রশ্ন এসেছিল কীভাবে?)। সফিউল্লাহ তখন নাকি ‘বিরক্ত’ হয়ে রেডিও অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেজর ডালিম তার ‘পথরোধ’ করেছিলেন। ‘বাধ্য হয়ে’ তাকে নাকি তাহের উদ্দিন ঠাকুরের লিখে দেয়া বক্তব্য ‘পাঠ’ করতে হয়েছিল! মেজর ডালিমকে কেন গ্রেফতার করেননি—এ প্রশ্নের উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছেন, পরিস্থিতি ‘কখনোই’ সে রকম ছিল না। তারা আমার সঙ্গে অস্ত্র উঁচিয়ে কথা বলেছে! মেজর ডালিম নাকি সফিউল্লাহর অফিসের দরজায় লাথি পর্যন্ত মেরেছিলেন! এরপর ২৪ আগস্ট তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় এবং তিনি ‘বাধ্য হয়ে’ রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে যান।
আরও অনেকভাবেই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন সফিউল্লাহ। লক্ষ্যণীয় যে, তার বক্তব্য থেকে কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, সেনাপ্রধান হলেও বাস্তবে তিনি ছিলেন ‘অন্ধ ও বধির’— ১৯৭৪ সালে ডিজিএফআইকে শুধু নয়, রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। ইতিহাস জানা না থাকলে সফিউল্লাহর কথাগুলো অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। এজন্যই ‘তখনকার’ বাস্তবতা কেন ‘এখনকার’ মতো ছিল না—কথাটার ব্যাখ্যা দেয়া তার উচিত ছিল। তাহলে মানুষ জানতে পারত, কেন সফিউল্লাহ অক্ষম ও অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। বস্তুত ‘তখনকার’ বাস্তবতার কারণ ছিল ‘জাতীয় রক্ষী বাহিনী’। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের দলীয় পেটোয়া বাহিনী হিসেবে এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। একথা জাতিকে জানানো সফিউল্লাহর দায়িত্ব ছিল যে, সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি ঘটানোর গোপন লক্ষ্য নিয়ে সবদিক থেকে সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা অনেক বেশি দেয়া হয়েছিল রক্ষীবাহিনীকে। আরও সহজ কথায় বলা যায়, ‘তখনকার’ বাস্তবতায় সেনাবাহিনী ছিল অনেকটা ঢাল-তলোয়ারবিহীন ‘নিধিরাম সরদারের’ মতো। অন্যদিকে ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও সর্বাধুনিক যানবাহন দিয়ে রক্ষী বাহিনীকে এমনভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছিল যাতে বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি ঘটানো যায়। কিন্তু রক্ষীবাহিনীর প্রশ্নে সফিউল্লাহ নীরবতা অবলম্বন করেছেন। তিনি এ তথ্যেরও উল্লেখ করেননি যে, বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে তখন বহুদলীয় গণতন্ত্রও বিলুপ্ত করা হয়েছিল। সফিউল্লাহ যদি এই তথ্যগুলো জানাতেন তাহলে জনগণ সেদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে পারত। তারা বুঝতে পারত, কেন ‘তখনকার’ বাস্তবতা ‘এখনকার’ মতো ছিল না এবং কেন ‘এখনকার’ সেনাবাহিনীকে ‘তখনকার’ সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘মিলিয়ে’ ফেলা উচিত নয়।
কিন্তু নিজে আওয়ামী শিবিরের লোক বলেই সফিউল্লাহ এসব তথ্য জানানো থেকে সুকৌশলে বিরত থেকেছেন। একই কারণে তার পক্ষে শেখ সেলিমের আক্রমণের জবাবে যুত্সই যুক্তি দেখানোও সম্ভব হয়নি। জনগণ জেনেছে, সফিউল্লাহ এমন ‘যোগ্য’ জেনারেলই ছিলেন যে, ‘খুনি’ মেজররা তার সঙ্গে অস্ত্র উঁচিয়ে কথা বলেছেন, তাকে ‘ধরে’ নিয়ে গেছেন রেডিও অফিসে এবং তাকে দিয়ে আনুগত্যের শপথ ‘পাঠ’ করিয়ে ছেড়েছেন! সফিউল্লাহ লক্ষ্য করেননি যে, এসবের প্রতিটিই ভারি লজ্জার কথা। তাছাড়া রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর সফিউল্লাহর জীবনে ‘শনৈ শনৈ’ উন্নতি হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত তিনি চুটিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। সম্ভবত এজন্যই চেষ্টা সত্ত্বেও অবসরপ্রাপ্ত এই জেনারেল দায়দায়িত্ব এড়ানোর মতো যুত্সই বক্তব্য হাজির করতে পারেননি।
এ অবস্থারই সুযোগ নিয়েছিলেন শেখ সেলিম। ফলে ‘পড়ি কি মরি’ অবস্থায় পড়েছিলেন সফিউল্লাহ। নিজের সমর্থনে রীতিমতো ‘ক্যাম্পেইন’ শুরু করেছিলেন তিনি। একের পর এক টিভি চ্যানেলে সাক্ষাত্কার দিয়ে বেড়িয়েছেন, সংবাদপত্রেও তার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তার পক্ষে ময়দানেও এসেছিলেন দু’চারজন। ফরমায়েশী লেখা লিখেছেন তারা। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, সফিউল্লাহর মতো অবসরপ্রাপ্ত এসব জেনারেল এবং অফিসারও ১৯৭৫-এর আগস্ট পরবর্তী সময়ে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। কেউ কেউ চুটিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরিও করেছেন। কিন্তু চেষ্টায় ত্রুটি না থাকলেও সফিউল্লাহকে বাঁচাতে পারেননি তারা। ফলে সফিউল্লাহর পক্ষেও দায় এড়ানো সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও তিনি এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন। কারণ, ধান্দাবাজ রাজনীতিকদের মতো সুকৌশলে তিনিও গিয়ে আওয়ামী লীগেই ঢুকে পড়েছেন।
লেখক : সাংবাদিক
বিষয়: বিবিধ
১৫৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন