প্রতিদিন যদি বাংলাদেশ বিমানের দেড় শ যাত্রী নিয়ে একটি করে প্লেন ধ্বংস হতে থাকে, তাহলে এ দেশে মানুষ আর কখনো বিমানে উঠতে চাইবে না। অথচ প্রতিদিন এর চেয়ে বেশি মানুষ এ দেশে মারা যাচ্ছে ধূমপান করে। এই মৃত্যুগুলোকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া তো দূরে থাক, বরং আমরা যেন আমাদের ধূমপানবিরোধী আইনকে ফেলনা করে ফেলেছি।
লিখেছেন লিখেছেন কথার_খই ১৩ জুলাই, ২০১৩, ০৭:৫৭:০৫ সন্ধ্যা
ধূমপান নিয়ন্ত্রণ না নিষিদ্ধ
প্রতিদিন যদি বাংলাদেশ বিমানের দেড় শ যাত্রী নিয়ে একটি করে প্লেন ধ্বংস হতে থাকে, তাহলে এ দেশে মানুষ আর কখনো বিমানে উঠতে চাইবে না। অথচ প্রতিদিন এর চেয়ে বেশি মানুষ এ দেশে মারা যাচ্ছে ধূমপান করে। এই মৃত্যুগুলোকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া তো দূরে থাক, বরং আমরা যেন আমাদের ধূমপানবিরোধী আইনকে ফেলনা করে ফেলেছি। অথচ ২০০৫ সালে ধূমপানবিরোধী আইনটি প্রণয়নের পর যত্রতত্র জরিমানার দৃশ্য দেখা গেলেও সেটা এখন আর দৃশ্যমান নয়। তবে এই আইনের প্রভাবে মানুষ এখন প্রকাশ্যে ধূমপান করতে অস্বস্তি ও লজ্জাবোধ করে। এটা জনসচেতনতারই প্রমাণ। সম্প্র্রতি পাবলিক প্লেসে প্রকাশ্যে ধূমপানের শাস্তি ৩০০ টাকা করার বিধান রেখে ২০০৫ সালের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও সংশোধন আইন পাস করা হয়। তবে সংশোধিত আইনে পাবলিক প্লেসের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি বা ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফটিসি) সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, সেটা বিবেচ্য বিষয়। কেননা বাংলাদেশ ২০০৪ সালের ১০ মে এই চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করায় আমাদের বাধ্যবাধকতার জন্ম হয়েছে।
এফটিসি চুক্তিতে ধূমপানে উৎসাহিত হয়- এমন কোনো পদক্ষেপ না নিতে বলা হলেও আমাদের আইনের দুর্বলতায় সিগারেট কম্পানিগুলো বিভিন্ন কৌশলে বিনা মূল্যে চারাগাছ বিতরণ, কুইজ প্রতিযোগিতা, কনসার্ট, খেলাধুলা, বৃত্তি প্রদানসহ বিনা মূল্যে ধূমপানের সুযোগ দিয়ে কিশোর-যুবকদের ধূমপানে উৎসাহিত করছে। রাস্তার পাশে চাকা লাগানো টংঘরের মতো সিগারেটের দোকানগুলোর প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন যেন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমাদের দেশে পান-জর্দার মতো ক্ষতিকর তামাকও প্রকাশ্যে বিক্রি ও সেবন হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় সিগারেটের মোড়কে ভীতিকর ছবি ব্যবহার করা হলেও ভয় প্রদর্শনের এ রকম বিধান আমাদের নেই। দুর্ভাগ্য আমাদের, সিগারেট উৎপাদনকারী বহুজাতিক কম্পানিগুলো আমাদের আইনকে দুর্বল করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাই বর্তমানের সংশোধিত আইনে পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞা দেওয়া হলেও ধূমপানের জন্য নেই নির্দিষ্ট কোনো এরিয়া। ধূমপায়ীরা তো অনেকটা নেশাগ্রস্তের মতোই। তাহলে আইনে তাদের ধূমপান বা তামাক সেবনের জন্য স্পষ্ট কোনো নির্দিষ্ট জায়গার বিধান করে দিতে হবে। অন্যথায় এই আইনও আগেরটার মতোই অকার্যকর থেকেই যাবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের ২০০৪ সালের ধূমপান নিরোধ আইনের ৩(২) নম্বর ধারার মতো পাবলিক প্লেসে আলাদা নির্দিষ্ট কোনো জায়গা বা কক্ষে ধূমপান করার বিধান করা যেতে পারে। এ রকম বিধান ইংল্যান্ডের ২০০৬ সালের হেলথ অ্যাক্টেও খুঁজলে পাওয়া যাবে।
বর্তমানের সংশোধিত আইনে পাবলিক প্লেস বলতে বোঝানো হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌবন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, দাঁড়ানোর লাইন, খেলার মাঠ, বাস টার্মিনাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, আচ্ছাদিত প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত মেলা এবং স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক ঘোষিত অন্য যেকোনো পাবলিক প্লেস। পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞায় নতুন করে বেসরকারি অফিস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা ২০০৫-এর আইনে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তি ছিল ৫০ টাকা। বর্তমান আইনে সেটা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা বারবার একই অপরাধ করলে পর্যায়ক্রমিকভাবে দ্বিগুণ হারে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী বা ব্যবস্থাপক আইন লঙ্ঘন করলে তাকে অনধিক ৫০০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। বিলে গুল, জর্দা, খৈনী, সাদাপাতাসহ চোষণ ও চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করা তামাকজাত দ্রব্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
যেভাবে এই আইন করা হয়েছে তাতে এটা বাস্তবায়ন করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। কেননা এ আইনে অপরাধ করলে যেকোনো শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধীর বিচার করবেন। কিন্তু সেটা হতে হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার লিখিত বক্তব্যের প্রয়োজন হবে। এ আইনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলতে ইউএনও বা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা সমমানের বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাকে বোঝাবে। প্রতিদিন যত্রতত্র কোটি কোটি ধূমপায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এই কর্মকর্তাদের নাগাল পাওয়া সত্যিই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আইনের ৮ নম্বর ধারায় বাধ্যতামূলকভাবে পাবলিক প্লেসে 'ধূমপান হইতে বিরত থাকুন, ইহা শাস্তিযোগ্য অপরাধ'- শীর্ষক নোটিশ লাগানোর বিধান থাকলেও বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। এমনকি সরকারি অফিস ও খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও এ ধরনের নোটিশ খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। সরকার নিজেই তো এই আইনকে ভঙ্গ করে চলেছে। তা ছাড়া আইনের ১০(১) ধারায় সিগারেটের মোড়কে ৩০ শতাংশ জায়গাজুড়ে 'ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর' ধরনের সতর্কবাণী লেখার বিধান থাকলেও অজানা কারণে তা কেউ মানে না।
আসলে বিশ্বে এখন আর ধূমপান নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটা নিষিদ্ধের পর্যায়ে চলে এসেছে। কয়েক বছর আগে সুইজারল্যান্ডে ধূমপানের বিরুদ্ধে গণভোট হয়েছে। নিউজিল্যান্ড ২০২৫ সালের মধ্যে সে দেশে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার আইন প্রণয়ন করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন গত বছর নতুন করে ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর দেশের মানুষের জীবন রক্ষার্থে ধূমপানের বিরুদ্ধে কঠোর আইন পাস করেন। এ বছরের ১ জুন প্রথম ধাপে এবং ২০১৪ সালের ১ জুনের পরের ধাপে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে রাশিয়ার ধূমপানবিরোধী আইন। স্পেনে গত ২ জানুয়ারি থেকে কঠোর আইন পাস করা হয়েছে ধূমপানের বিরুদ্ধে। ২০১০ সালে ভারতের প্রথম ধূমপানবর্জিত রাজ্যের স্বীকৃতি পায় সিকিম। তামাক চাষ, বিক্রি, বিতরণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটানে। তাই আইন সংশোধন করে নয়, বরং নব নব পদ্ধতিতে ধূমপান ও তামাকসেবন রোধে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি শুধু ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইনই করে যাব, নাকি অন্যদের মতো আমরাও ধূমপান নিষিদ্ধের জন্য আইনের একটা প্রক্রিয়া শুরু করব। আমাদের ভুললে চলবে না যে ধূমপান হচ্ছে মাদকাসক্তির প্রথম ধাপ। পরের ধাপ কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যু।
লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞউৎসঃ কালের কন্ঠ
তুহিন মালিক
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১১৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন