"সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে কেঁচো প্রকৃতির লোকেরা নিয়োগ পায়" ড. তুহিন মালিক

লিখেছেন লিখেছেন কথার_খই ০৮ জুলাই, ২০১৩, ০৩:৪৬:০০ রাত

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বিদায়ের সময় নতুন করে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি নখ ও দাঁতহীন বাঘ। পাশপাশি বলেছেন, যতদিন শেখ হাসিনা সংসদ নেতা থাকবেন, ততদিন দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা যাবে না।



তো দুদককে কাগুজে বাঘ বলা, দুদকের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার অভিযোগসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা কথা বলেছি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তুহিন মালিকের সঙ্গে।

পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাতকারটি উপস্থাপন করা হল

রেডিও তেহরান: বাংলাদেশের সমাজে দুর্নীতি অত্যন্ত শক্তভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে- মিডিয়ার খবরে অন্তত এমন একটা ধারণা পরিষ্কার হয়। এই দুর্নীতি রোধ এবং দোষীদের বিচারের জন্য গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু দুদককে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান গোলাম রহমান নিজেও শুরুতে এবং বিদায় বেলায় দুদককে নখ-দন্তহীন বাঘ বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- কেন এ অবস্থা? তার এ বক্তব্যের মাঝ দিয়ে কি প্রতিষ্ঠানটির সব কাজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে না?

ড. তুহিন মালিক: আপনি যথার্থই বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান যাওয়ার সময় আবারও বলেছেন যে দুদকের দাঁত নেই নখ নেই। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন – ভাতা, গাড়ি-বাড়ি নিয়ে এবং অনেক বিতর্কিত কাজের জন্ম দিয়ে বিদায় নেয়ার সময় বললেন, যে সাপের দাঁত নেই, চোখ নেই; করে নাতো ফুসফাস- তো এভাবে বলে তো লাভ নেই! প্রকৃতপক্ষে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল যদি দাঁত না থাকে সেক্ষেত্রে দাঁত গজানোর। জনগণ এটা ওনার কাছ থেকে আশা করেছিল, জনগণ দুদকের নখ চেয়েছিল।

তবে উনি যে কথা বলেছেন, সেটা অনেক সত্য একটি বিষয়। দুদকের আসলে দাঁত আছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইনি কাঠামোর মধ্যে দুদকের দাঁত নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়। সমস্যাটা হচ্ছে দুদকের আক্কেল দাঁত নেই। আক্কেল দাঁত নেই বলছি এই কারণে যে- দুদকের যে আক্কেল দিয়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার কথা সেই আক্কেল দাঁত কখনও ওঠেনি। দুদককে ব্যবহার করা হচ্ছে দলীয় একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে।

দুদককে যদি বলা হয় 'দুদক লীগ' তাহলে বাড়িয়ে বলা হবে না এই কারণে যে, দুদকের ওপর জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল তা প্রতিষ্ঠানটি পূরণ করতে পারেনি। ১/১১ এর সময় দুদকের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু পরবর্তীকালে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ব্যাপারে যেখানে কানাডা থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদন প্রকাশ করল সেখানে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক এ বিষয়গুলোকে আমলে নেয়নি। এমনকি ওই সময় দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ঠাট্টা করে রমেশের ডায়েরি সম্পর্কে বলেছিলেন- সেটা বাজারের ফর্দ; এটাকে আমরা আমলে নেব না।

দ্বিতীয়ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের গাড়িতে যখন ৭০ লক্ষ টাকা পাওয়া গেল- তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সুরঞ্জিতের বিরুদ্ধে মামলা আমলে নেয়া তো দূরের কথা; তাকে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো না; কোনো মামলার আসামি করাতো অনেক পরের বিষয়। অন্যদিকে তারেক রহমানের বিষয়ে দুদক যে কাজটি করল সেটি হচ্ছে- একদিন আগে একজন মন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলেছেন যে, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তারেককে ধরে আনা হবে; ঠিক তার পরের দিন মন্ত্রীর কথাটাই পুনর্ব্যক্ত করে দুদক চেয়ারম্যান কোর্টে পিটিশন দিলেন এবং সেই অনুযায়ী ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট জারি করা হলো।

তবে জনগণের প্রত্যাশিত যেসব দুর্নীতির বিষয়ে দুদকের এগিয়ে আসা উচিত ছিল-যেমন হলামার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য যে সব বড় বড় দুর্নীতি হয়েছে সে সবের কোনটাতেই দুদকের দাঁতের কোনো স্পর্শ আমরা পাইনি। বরং দুদক বিরোধী দলকে দমন করার ক্ষেত্রে ছিল সোচ্চার। কয়েক হাজার বিরোধী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা ঝুলছে। বিশেষ করে আমি বলব, রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা প্রায় ৭,৫১১টি মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। সেখানে দুদকের মামলাগুলোও তাদের এক্সিকিউটিভ অর্ডারে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। অথচ বিরোধীদলের একটি মামলাও কিন্তু দুদক প্রত্যাহার করে নেয়নি।

বরং আমরা দেখছি, বিভিন্ন সময়ে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের সে সব মামলায় আদালতের মাধ্যমে হেনস্তা করে, জামিন বাতিল করিয়ে, জেলে ঢুকিয়ে তাদের বিরুদ্ধে স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে দুদকের রাজনৈতিক পরিচয়টাই আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। ফলে এটা স্পষ্ট যে, আমাদের দেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা দুদককে কোনোভাবেই শক্তিশালী করে না। কারণ, এই দুদক কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেই কাজ করে। দুদকের মূল কাজ কিন্তু সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নয়। দুদকের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা আছেন বা সরকারে যারা আছেন তাদের দুর্নীতি খতিয়ে দেখা। ফলে ক্ষমতায় যারা থাকেন বা যারা ক্ষমতায় আসতে চান তাদের কেউ কেউ কিন্তু স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দুদকের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেন এবং এটাকে ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করেন।

রেডিও তেহরান: গোলাম রহমান বিদায় নেয়ার সময় বলেছেন- যতদিন শেখ হাসিনা সংসদ নেতা থাকবেন, ততদিন দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা যাবে না। তিনিই আবার বলেছেন, দুদক কাগুজে বাঘ। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দুদককে কাগুজে বাঘ বানিয়ে রেখেছেন কে? গোলাম রহমানের এ বক্তব্যকে আপনি কিভাবে দেখেন?

ড. তুহিন মালিক: দেখুন গত ছয়মাস আগে আমি একটি লাইভ টকশোতে এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম। তাজরিন গার্মেন্টে যখন অগ্নিকাণ্ড হয় সে সময় এক টকশোতে আমি বলেছিলাম- ফায়ার সার্ভিসের ২৩ কোটি টাকার একটি দুর্নীতির মামলা দুদকে এসেছিল। তখন দুদকের কমিশনাররা মামলা না করে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে টাকাগুলো ভাগ বাটোয়ারা করে নিল। এ ঘটনায় আমি বললাম- এই গোলাম রহমানরা সারা জীবন গোলামই রয়ে গেলেন। এ হিসেবে গোলামদের বাবা-মা তাদের নাম ঠিকই গোলাম রেখেছিলন।

আমাদের সাংবিধানিক কিম্বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই যে গোলামীর মনোবৃত্তি এটা দুঃখজনক। এসব প্রতিষ্ঠানে যারা কর্মকর্তা হিসেবে আছেন বা থাকবেন-যাদের দেশের বিবেক হিসেবে কাজ করার কথা তাদের ভেতর গোলামী রয়ে যায় তাদের নেতা-নেত্রীদের প্রতি। যার ফলশ্রুতিতে তারাও কিন্তু একটা পলিটিক্যাল পার্টির অর্গান হিসেবে কাজ করেন।

দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যখন আমরা মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে বলতে শুনি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে এখন দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন করতে হবে কিম্বা লিমনের মামলায় তিনি যখন সমঝোতার প্রস্তাব দেন তখন বলতে হয়, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানে যারা এ ধরনের বিগ বস রয়েছেন তারাই দায়ি। আর তখন জনগণের দায়টা তাদের কাছে ছোট হয়ে আসে। ফলে এ ধরনের আক্কেল দাঁতহীন কিম্বা নখবিহীন লোকগুলোকে কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসা হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কারণে যাতে করে ক্ষমতাসীনদের কেউ স্পর্শ করতে না পারে। এভাবে রাজনৈতিক কারণে এসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা হচ্ছে। তাছাড়া, যারা প্রতিষ্ঠান চালাবেন সেইসব লোককে দলীয় বিবেচনায় এনে দাঁতহীন ও নখহীন করে রাখা হয়েছে।

রেডিও তেহরান: যে দুর্নীতি দমন কমিশন সমাজের দুর্নীতি দূর করবে সেই প্রতিষ্ঠানের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে- বিভিন্ন মামলায় আইনজীবীদের ফি’র নামে তিনি ১০০ কোটি টাকা লোপাট করেছেন। অথচ তার মেয়াদে অন্যদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া কোনো একটি মামলাও তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

ড. তুহিন মালিক: দেখুন, আমি দেশের তিনটা জাতীয় পত্রিকায় কলাম লিখি। বেশ কিছুদিন আগে আমি একটা কলামে লিখেছিলাম যে, যে প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন নিয়ে কাজ করে বা যিনি সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান সেই প্রতিষ্ঠানের নিজেদের এবং প্রধানের যদি দুর্নীতি থাকে তবে তা সংশোধন করবে। তাহলে দুদকের ভেতরের দুর্নীতি দমন করার জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে কি না ?

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি দমন আইনের সাবসেকশন ৩ এ খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে যেদিন থেকে কমিশনার নিয়োগ লাভ করবেন সেদিন থেকে ৪ বছরের জন্য এই পদে থাকবেন। কিন্তু বিদায়ী চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে- তিনি ২০০৯ এর ৩০ এপ্রিল নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং চলতি বছরের ১ মে তার চার বছর শেষ হয়ে গেছে। তারপরও গোলাম রহমান কোন্‌ ক্ষমতাবলে ওই পদে ছিলেন তা নিয়ে আমি একটা কলাম লিখি। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে একটা রিট হয়। সেটার বিচার আগামী ৮ জুলাই হবে নির্ধারণ করে রেখেছে হাইকোর্ট ডিভিশন।

তো বিচার যেটাই হোক না কেন আসল যে প্রশ্নটি আপনি বললেন- এই আইনি কাঠামোর যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা রুল অব ল'কে নিশ্চিত করবে এবং জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী মানুষকে ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা উপহার দেবে; তারা নিজেরাই যদি পরিষ্কারভাবে আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকেন এর চেয়ে দুঃখজনক এবং অনৈতিক কাজ আর কি হতে পারে?

আপনি যেটা বললেন দুদকের আইনজীবী নিয়োগে ১০০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। আসলে এগুলো তো ছোট ছোট বিষয়। আরো অনেক বড় এবং ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের নিয়োগ বাণিজ্য রয়েছে। আর সে সব নিয়োগ বাণিজ্য কয়েকশ' কোটি টাকার। শুধু তাই নয় দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে লোকজনকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করছেন। এ ধরনের অভিযোগ আমরা মিডিয়ায় দেখেছি। কিন্তু এসবের কোনটাই তারা আমলে নেয় না।

বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা সিটি কর্পোরেশনের কোন গাড়ির কাচ ভেঙে ফেললে দুদক সেটা আমলে নেয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা দুদকের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিংবা কে কোথায় ১৩০০ টাকার তৈজসপত্র নিয়ে দুর্নীতি করেছে সেটা নিয়ে মামলা করতে তারা বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে- যখন আমরা পুরো প্রতিষ্ঠান, এর আইন এবং কাঠামোকে রাজনৈতিকভাবে দেখছি এবং রাজনৈতিক কারণে যখন এটাকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তখন তারা কিন্তু সেফ-গার্ড পেয়ে যাচ্ছে। যখনই ক্ষমতাসীন দলকে খুশি করার জন্য বিরোধীদলের ওপর নির্যাতন চালাবো তখন আমি আমার প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যে অপকর্ম করছি, যে দুর্নীতি করছি তার একটা রক্ষাকবচ কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আমাকে প্রদান করা হচ্ছে। আর এসবের বিনিময়ে তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সুবিধাটা পেয়ে যাচ্ছেন এবং ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকছেন। তাদেরকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।

রেডিও তেহরান: দেশের সর্ববৃহত দুর্নীতির মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতিকেও স্থান দেয়া হচ্ছে। আর যাকে নিয়ে মূলত পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ আবর্তিত হয়েছে সেই যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের নাম এ মামলায় নেই। এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণ চুক্তি বাতিল হয়ে গেল। এখানে দুদকের দায় কতটা বলে আপনি মনে করেন? এখানে আপনাকে বলে রাখি- দুদকের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক নিজেও। কে এখানে সঠিক অবস্থানে ছিল?

ড. তুহিন মালিক: সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিষয়ে আমি বলব, দুদকের আইনের মধ্যে কোনো অভিযোগ যদি দুদকের কাছে আসে বা দুদক স্বপ্রণোদিত হয়ে যদি কোনো স্যুয়োমুটো দেয় বা তদন্ত করে বের করে সেই সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন ব্যক্তি কিংবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা বিষয়টি আমলে নেয়ার বিধান দুদকের আইনেই রয়ে গেছে।

তো যেখানে বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠান গত চার বছর ধরে দুদককে তিন/চারটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীসহ অন্যদের ব্যাপারে কিন্তু আজ পর্যন্ত আবুল হোসেন বা আবুল হাসানের কাউকে ধরা হয়নি। তাদেরকে ধরার বদলে তাদেরকে ক্লিন সার্টিফিকেট দিয়ে বললেন, এরা দুর্নীতির বাইরের মানুষ। শুধু তাই নয়- পরবর্তীতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল হোসেন সম্পর্কে বললেন, তিনি বাংলাদেশের এক নম্বর দেশপ্রেমিক। বিশ্বব্যাংক কিংবা কানাডার আদালতে যেখানে প্রমাণিত হলো তারা দুর্নীতি করেছেন সেখানে আমাদের দুদক তাদেরকে ক্লিন সার্টিফিকেট দিচ্ছেন এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী তাকে দেশ প্রেমিক উপাধি দিচ্ছেন। এর ফলে আমাদের নতুন প্রজন্ম শিখবে অপরাধ করেও রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে দুদকের কাছ থেকে এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ক্লিন সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।

রেডিও তেহরান: বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতা কিংবা লুটপাট আড়াল করতে দুদককে একটি সাক্ষিগোপাল সংস্থায় পরিণত করা হয়েছে। এ অভিযোগের বিষয়ে আপনি কি বলবেন?

ড. তুহিন মালিক: দেখুন, বর্তমান সরকারের সময় দুদকের দুটো চরিত্র আমরা দেখতে পেয়েছি। একটা হচ্ছে আপনি যে কথা বললেন স্বাক্ষীগোপাল- হ্যা. দুদক স্বাক্ষীগোপালের ভূমিকা পালন করছে। এটা এখন চারিত্রিক সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জনগণ যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপারে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে দুদকের প্রথম কাজ হচ্ছে তাকে একটা ক্লিন সার্টিফিকেট দেয়া। সুরঞ্জিতের কালো বিড়াল থেকে শুরু করে আবুলের পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা দেখেছি, যদি সেটা সরকারি দলের কারও বিরুদ্ধে হয় তাহলে দুদক অভিযুক্তদেরকে চারিত্রিক সনদ দিচ্ছে।

দুদকের আরেকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- বিরোধীদল দমনে তারা সিদ্ধহস্ত। অর্থাত বিরোধীদল দমনে দুদককে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে হওয়া উচিত ছিল এর উল্টোটি। আইনের শাসন হচ্ছে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের লালন। তবে দুদককে দিয়ে করানো হচ্ছে শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালন। এটা সম্পূর্ণভাবে আইনের শাসনের বিপরীতে কাজ করছে। সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, গণতন্ত্র, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন ও মানবাধিকারকে ভূলুন্ঠিত করার মতো একটা বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে দুদক।

রেডিও তেহরান: সবশেষে আপনার কাছে আমরা যে প্রশ্নটি জানতে চাই তা হলো- দেশের বর্তমান বাস্তবতায় দুদকসহ এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কি স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব?

ড. তুহিন মালিক: না, আমি স্পষ্টভাবে বলবো দুদকের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ কারণে সম্ভব নয় যে, যারা দুদকে নিয়োগ পাবেন তারা কখনই স্বাধীন এবং মনুষ্য প্রজাতির কেউ হবেন না। যাদের মেরুদণ্ডের হাড় আছে তাদের কেউ এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাবেন না। ওখানে কেঁচো প্রকৃতির লোকেরা নিয়োগ পাবেন যাদের মেরুদণ্ড বলে কোনো জিনিষ নেই। এটা আমাদের দেশের জন্য খুব দুর্ভাগ্য যে, যারা দেশের জন্য কাজ করেন, সততা ও ন্যায়ভিত্তিক কাজ করেন তারা বর্তমান সমাজে হারিয়ে গেছেন। কারণ সমাজে অসভ্য লোকেরা সভ্যদের শাসন করছে, অশিক্ষিত লোকেরা শিক্ষিতদের শাসন করছে আর ন্যায়পরায়ণ লোকদেরকে গুণ্ডা প্রকৃতির লোকেরা শাসন করছে।

জ্বি হুজুরের পঙ্গপালরাই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রধান হচ্ছে। আর এই প্রধানরা মুখের দিকে চেয়ে থাকে যে তাদের নেতা-নেত্রীরা কি বলবে! আর তাদের আশীর্বাদ নিয়ে এসব কর্মকর্তা বাকি জীবনটা আরাম-আয়েসে কাটানোর জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়েছেন। সেটা নির্বাচন কমিশন হোক, পাবলিক সার্ভিস কমিশন হোক, দুর্নীতি দমন কমিশন হোক কিংবা মানবাধিকার কমিশন হোক –সব প্রতিষ্ঠানের একই দশা। এসব কমিশনে যারা যাচ্ছেন তারা প্রত্যেকে একটা লেসার ট্রিপের মতো বিলাসি জীবন যাপন করছেন। তারা চাচ্ছেন না- তাদের ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করুক। আবার সরকারকেও তারা কোনোভাবে ক্ষেপিয়ে তুলতে চান না কারণ, তাহলে তাদের রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে যাবে।

কিছু দলীয় মুখচেনা লোকদেরকে যে পুনর্বাসন কেন্দ্র করে দেয়া হলো এতে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা শুরুতেই ভূলুন্ঠিত হয়ে গেল। আমি যেটা বলছি, গোড়াতে নিয়োগেই সমস্যা রয়ে গেছে। নিয়োগের সময় যদি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও স- ন্যায়বান লোকদের আনা হতো তাহলে সরকারি হস্তক্ষেপের চেষ্টা যতই করা হতো না কেন এভাবে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারতো না।Click this link

রেডিও তেহরান/জিএআর/এমআই/৩০

বিষয়: বিবিধ

১২৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File