তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে আমার দেশের অপরাধ নেই সরকার দাবি করতে পারেনি যে, আমার দেশ এই হ্যাকিং বা সংগ্রহ কাজে জড়িত ছিলো। ফলে হ্যাকিং বেআইনি হলেও ‘বেআইনিভাবে’ পাওয়া তথ্য প্রকাশে আইনে যেহেতু কোনো বাধা নেই- কাজেই কোনো অপরাধ নেই আমার দেশের।
লিখেছেন লিখেছেন কথার_খই ২২ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:১২:৪৯ বিকাল
কপি পোষ্ট......
যেই মামলার সূত্র ধরে দৈনিক আমার দেশের ছাপাখানা সীলগালা করে ও অন্য কোথাও থেকে পত্রিকাটি ছাপতে না দিয়ে সরকার এটি কার্যত নিষিদ্ধ করে রেখেছে, সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে যেই মামলায় এবার গ্রেফতার করা হলো, এই মামলাটি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে দায়ের করা হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৬ ও ৫৭ ধারা ও দণ্ডবিধির ১২৪, ১২৪-এ, ৫০৫এ, ১২০বি ও ৫১১ ধারায় গত ১৩ ডিসেম্বর এই মামলাটি দায়ের করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান এই মামলায় পত্রিকাটির প্রকাশক হাসমত আলীকেও আসামি করেন।
এতে রয়েছে দুই ধরনের অভিযোগ; প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিমের কম্পিউটারে হ্যাকি করে তার স্কাইপ কথোপকথন ও ইমেইলসহ মিথ্যা-অশ্লীল তথ্য প্রকাশ এবং তা প্রকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহ।
ট্রাইব্যুনালটির চেয়ারম্যান বিচারাধীন বিষয় ও সম্ভাব্য রায় নিয়ে দিনের পর দিন কথা বলেছেন ট্রাইব্যুনাল বহির্ভুত এক ব্যক্তির সঙ্গে। আদালতের কাগজপত্র তাকে পাঠিয়েছেন, তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন। স্কাইপ যোগে আলাপের অডিও ও ভিডিও রেকর্ড নিজেদের কাছে থাকা সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে খবরটি প্রথম দেয় বৃটিশ সাময়িকী দি ইকনমিস্ট। দৈনিক আমার দেশ ওই কথোপকথনের অনেকাংশ প্রকাশ করে। পরে ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, একজন গ্রাহকের ফরমায়েশ অনুসারে সংশ্লিষ্ট বিচারক ও ট্রাইব্যুনাল বহির্ভূত ব্যক্তির আলাপালোচনা ‘সংগ্রহ’ করেছে আমেরিকার একটি বেসরকারি গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ‘গ্রাহকে’র নাম প্রকাশে করেনি তারা গোয়েন্দা সংস্থাটি।
বিচারকের শপথ ভঙ্গ করে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বাইরে আলাপ করার এমন কেলেঙ্কারি ফাঁস হলে ট্রাইব্যুনাল ছাড়েন চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম। অবশ্য তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে পূর্ববর্তী পদে বিচারক হিসেবে ফেরত গিয়েছেন তিনি।
এদিকে টানা কয়েকদিন স্কাইপ কেলেঙ্কারি প্রকাশের পর গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক আদেশে বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তাদের ওই আদেশের অনুলিপি ইকনমিস্ট ও আমার দেশের সম্পাদক এবং বিটিআরসি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
একইদিনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্ট বিভাগে আবেদন করেন এক আইনজীবী। বিভাগের বিচারক এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও ফরিদ আহমেদের যুগ্ম বেঞ্চে ওই আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজহারুল্লাহ ভূঁইয়া। শুনানি শেষে আদালত তার রুলে বলেন, স্কাইপ কথোপকথন ‘হ্যাকিং’ ও তা প্রকাশে দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং গ্রেপ্তারের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানাতে হবে। স্বরাষ্ট্রসচিব, আইজিপি এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ সংশ্লিষ্টদের দু’সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলেন আদালত। একইসঙ্গে দৈনিক আমার দেশ ছাপা ও প্রকাশনায় আইনের কোন ধারা লঙ্ঘন করেছে কি না তা খতিয়ে দেখতে ঢাকার জেলা প্রশাসককে বলেন বিচারকদ্বয়।
সেদিনই মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে দায়ের করা মামলায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমানের আইনজীবী বলেন, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৬ ও ৫৭ ধারার অধীনে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
আইনটির ৫৬ ও ৫৭ ধারায় কি বলা হয়েছে তা দেখে নেয়া যাক। আইনটির ৫৬ ধারার শিরোনাম হচ্ছে ‘কম্পিউটার সিস্টেমের হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড’ । এখানে বলা হয়েছে;
কোনো ব্যক্তি যদি ১. (ক) জনসাধারণের বা কোন ব্যক্তির ক্ষতি করিবার উদ্দেশ্যে বা ক্ষতি হইবে মর্মে জ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও এমন কোন কার্য করেন যাহার ফলে কোন কম্পিউটার রিসোর্সের কোন তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা উহার মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাস পায় বা অন্য কোনভাবে উহাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে; (খ) এমন কোন কম্পিউটার, সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করার মাধ্যমে ইহার ক্ষতিসাধন করেন, যাহাতে তিনি মালিক বা দখলকার নহেন; তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি হ্যাকিং অপরাধ। ২. কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন হ্যাকিং অপরাধ করিলে তিনি অনধিক দশ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
আইনটির ৫৭ ধারায় ‘ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড’ শিরোনামে বলা হচ্ছে (১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক দশ বত্সর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
বিচারকের স্কাইপ কথোপকথন আমার দেশ হ্যাক করেছে বলে এযাবত কোনো প্রমাণের দাবি করেনি সরকার। নিউ এজ’র প্রতিবেদনে অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ‘গার্ডিয়ান কনসাল্টিং এলএলসি’ বলছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত তাদের লোকেরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারক নিজামুল হক এবং বেলজিয়ামভিত্তিক বাংলাদেশী আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপে এবং ই-মেইল আলাপের কপি সংগ্রহ করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ‘অপকর্মের ব্যাপারে নজর রাখার’ জন্যই তাদের ভাড়া করা হয়েছিল বলে জানায়। এক্ষেত্রে সংস্থাটির জন্য যারা কাজ করেছে বা তথ্য সংগ্রহ করেছে তাদের কেউই কোনো আইন লঙ্ঘন করেনি বলেও দাবি করেছে ওই গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানটি।
এর বাইরে স্কাইপ কথোপকথন ও ইমেইল সংগ্রহের বিষয়ে আর কোনো তথ্য দেয়নি দি ইকনমিস্ট বা আমার দেশ। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে তার কার্যালয় ও আমার দেশ’র ছাপাখানা থেকে কম্পিউটার ইত্যাদি জব্দ করেছে সরকার। তারপর রিমান্ডে নিয়ে তাকে দৃশ্যত ব্যাপক নির্যাতনও করা হয়েছে। এরপরও সরকার দাবি করতে পারেনি যে, আমার দেশ এই হ্যাকিং বা সংগ্রহ কাজে জড়িত ছিলো। ফলে হ্যাকিং বেআইনি হলেও ‘বেআইনিভাবে’ পাওয়া তথ্য প্রকাশে আইনে যেহেতু কোনো বাধা নেই- কাজেই কোনো অপরাধ নেই আমার দেশের।
এরপর থাকে ৫৭ ধারার বিষয়। কিন্তু না সরকার না কোনো আদালত কখনো দাবি করেনি যে এই স্কাইপ কথোপকথন ঘিরে প্রকাশিত খবর ‘মিথ্যা’। সংশ্লিষ্ট বিচারক তো ট্রাইব্যুনালে শুনানিকালে একবার এটা স্বীকারই করেছেন যে তিনি ওই লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাছাড়া এসব খবর ‘অশ্লীল’ অথবা ‘জনসাধারণকে নীতিভ্রষ্ট করতে পারে’ অথবা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা’ বা ‘আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটা’নোর মত খবরও নয়। কিছু খবর কারো ‘ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন’ করে কি? কিন্তু কোনো খবর যদি জনস্বার্থে করা হয়, তা যদি সত্য হয়, তাতে আইনত কারো ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা হয়না। বরং জনস্বার্থ এক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল এমন একটি অনিয়মের খবর প্রকাশ নিঃসন্দেহে জনস্বার্থের দিক থেকে খুব দরকারি ছিল।
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১১৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন