আমার আপন কথা রূপকথাকেও হার মানায়

লিখেছেন লিখেছেন তিতুমীর সাফকাত ২০ মার্চ, ২০১৩, ০৮:৩৫:০৫ রাত

১.

মা বাবার দ্বিতীয় সন্তান আমি । আমার বড় এক ভাই আছে । বাবার খুব ইচ্ছে ছির তার দ্বিতীয় সন্তানটা মেয়ে হবে আর মা তো মেয়েদের কাপড় চোপড়ও রেডি করে রেখেছিল । পরিবারের সবাই চাইছিল এবার একটা মেয়ে হোক , কারণ আমাদের বংশে মেয়ে নেই বলতে গেলে, আমার বাবারও কোন বোন ছিল না তাঁর বাবারও না । তাই সবাই একটা মেয়ে চাইছিল , মায়ের নাকি আল্ট্রাসনো করানো হয়েছিল ওখানে দেখা যায় যে আমি মেয়ে তাই সবার মনেই ছিল অনাবিল আনন্দ। সেই আনন্দে পানি ঢেলে দিয়েই আমার জন্ম । আসল ব্যপারটা পরে ডাক্তার আন্টি আমাকে বলেছিলেন , বাবা নকি বলেছিলেন আমি যদি ছেলে হই তবে এবরশন করানো হবে । এখন যেমন হরহামেশা এবরশন তখন তেমন ছিল না । ডাক্তাররা এবরশনকে হত্যাই মনে করতেন তাই আমাকে বাঁচাতে আন্টি মিথ্যা বলেন ।

২.

জন্মের পর থেকেই অবহেলার শিকার হয়েছি আর তখন থেকেই মেয়েদের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে বড় হয়েছি । আমাদের পরিবার খুবই প্রভাবশালী ছিল তাই ডাক্তার আন্টিকে খুবই খারাপভাবে অপমান হেনস্তা করা হয় । নিঃসন্তান আন্টি পরে চেয়েছিলেন আমাকে তার কাছে নিয়ে পালন করতে । কিন্তু এখানেও বাগড়া বাঁধার আভিজাত্যের উন্নাষিকতা ।আন্টি আমাকে নিতে পারেন নি বরং আরো অপমানিত হন । আমার জন্মের পর আমার বাবা আমাকে একটা ভাল জিনিসই দিয়েছে এটা হচ্ছে একটা বিশাল নাম । বংশীয় ঐতিহ্যের মধ্যে একটাই আছে আমার নামটা শাহজাদা শেখ মোহাম্মাদ সাফকাত আল মনজুর ইয়ামেন ইবন..... বাকিটা আর বলতে চাইনা । পরে অবশ্য আমি নামটাকে ছোট করে ফেলেছিলাম সব বাহুল্য দূর করে ।

৩.

ছোটবেলা থেকেই একা বড় হয়েছি । আমি যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই মা আমার থেকে অনেক দূরের মানুষ । সারাদিনে মাত্র একবার দেখা হত তাও আবার রাতে খাওয়ার সময় । আমাদের বাড়ির পুরাতন নিয়ম অনুযায়ী বাড়ির বড় বৌ রাতের খাবারটা সবাইকে নিজ হাতে তুলে দিত । আমি সারাদিন এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করতাম । মাকে কখনো মা বলে ডাকিনি , আন্টি বলেছিলেন তাঁকে মা ডাকতে কিন্তু পারি নি । আর বাবার কাছেই কখনোই কখনো যেতাম না ভয়ে বাবা ডাকাতো দূরের কথা। বাবার সাথে আমি প্রথম কথা বলি যখন আমার এস.এস.সি এর রেজাল্ট দিয়েছে আমি সব বিষয়ে এ+ পেয়েছি তখন । আমাদের বংশের মধ্যে এটাই সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট । এর আগে কেউ এস.এস.সি পাশ করেনি । ভাইয়া তিনবার পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছিল । আসলে সম্পত্তি ছিল তাই কেউ লেখাপড়া নিয়ে চিন্তা করনি । আমি নিজের পরিবারে থেকেও একঘরে ছিলাম । চাকর বাকর রা ছাড়া আর কেউ আমার খবর নিত না । আমার লেখাপড়ার খরচটা পর্যন্ত বাবা দেন নি । আসলে তিনি জানতেনই না যে আমি লেখাপড়া করি । আমার লেখাপড়ার আংশিক খরচ দিয়েছেন ডাক্তার আন্টি আর মেধাবী ছিলাম বলে হাইস্কুলে কোন খরচ ছিল না তার উপরে বৃত্তি পেতাম সেটা দিয়েই পুরাতন বইপত্র কিনতাম । রেজাল্টের দিন স্কুলের স্যার বাবাকে আমার খবরটা দেন । সারা থানায় এটাই সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট । বাবা বাড়ি এসে খুব রাগারাগি করেন , আমাকে মেরেওছিলেন । তারপরও জন্মের ১৬ বছর পর বাবার প্রথম স্পর্শ , কেমন জানি লাগছিল । অবশেষে স্যারের সুপারিশে আর লোকলজ্জার খাতিরে বাবা আমাকে কলেজে পড়ার অনুমতি দেন এবং মাসে মাত্র দুই হাজার টাকার একটা ব্যবস্থা করেন । থাকা খাওয়া কোনটাই দুই হাজার টাকায় হত না , তাই বাধ্য হয়ে টিউশনি করতে হত । কখনো প্রাইভেট পড়িনি বা কোচিং করি নি । নিজেই পড়েছি একা ছিলাম একাই আছি একা থাকা অভ্যাস হয়ে গেছে । ভাল ছাত্র ছিলাম তাই অনেকেই বন্ধু হতে চেয়েছিল কিন্তু আমি এড়িয়ে গেছি । যখন ইন্টারের রেজাল্ট পেলাম তখন আমার খুশি হওয়ার কথা সব বিষয়ে এ+ পেয়েছি কিন্তু আমার কষ্ট লাগতে লাগল । একমাত্র যে মানুষটি খুশি হত এটা শুনে সেই আন্টি গত বছর আমাকে আরে একা করে চলে গেছেন । আর ভাল লাগে না । কেন সেদিন আন্টি সত্য প্রকাশ করলেন না ? কেন আমাকে জন্ম নিতে দিলেন ? কেন ?কেন ? কেন ? একদম একা হয়ে যাওয়ার পর আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পরি । যা আমাকে কিছুটা শান্তি দিয়েছে বিপদে সাহায্য পেয়েছি ।

৩.

এরপর ভর্তি পরীক্ষা । আমার আর পড়ারই ইচ্ছে ছিল না কিন্তু বড়ভাইরা অনেক বুঝালেন তারপরও পড়িনি কোথাও ঠিকভাবে কোচিংও করিনি । মাঝখানে আমার ছাত্রাবাসটা সন্ত্রাসীরা পুড়িয়ে দিল । আবাস হারিয়ে উদ্ভাস্তুর মত ঘুরে বেরিয়েছি রাজনৈতিক কারণে মামলা খেয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি কয়েক মাস । পরে শুধুমাত্র বড়ভাইদের চাপে ঢাবি আর সাস্টে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম । আল্লাহ এর রহমতে দুই জায়গায়ই হল কিন্তু ঢাকায় থাকায় আপেক্ষিক খরচের কথা চিন্তা করে সাস্টেই ভর্তি হলাম ভর্তির টাকাটা পর্যন্ত অন্য একজন দিয়েছেন । নিজের এলাকায় কখনো যাওয়া পরে না । তারপরও একবার গিয়েছিলাম গতমাসে , অনেক পরিবর্তন হয়েছে । শুনলাম ভাইয়ের নাকি অভিষেক হবে আগামী শাবান মাসে , বাবা অসুস্থ হয়ে আছেন । খুব ইচ্ছে হয়েছিল মানুষটাকে গিয়ে দেখি কিন্তু সাহস হয় নি ।

৪.

একা আমি একাই আছি , একাকিত্বের মাঝে এক নতুন স্বাদ পেয়েছি , একাই ভাল লাকে । মেয়েদের আমি ঘৃণা করি তীব্র ঘৃণা ! কখনো কোন মেয়ের সাথে স্বেচ্ছায় কথা বলি নি সর্বদায় এড়িয়ে চলি । এজন্য আড়ালে আবডালে আমাকে যে কত টিটকারি মারা হয় সবই আমি জানি । তবে ইদানিং কিছু বন্ধু হয়েছে রাজনীতির খাতিরে , আছি তাদের সাথে , তারপরেও বেশিরভাগ সময়ই ওদের এড়িয়ে চলি । চিন্তা করি , আচ্ছা মেয়েরা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয় সবসময় শুনা যায় ছেলেদের শুনা যায় না কেন ? নাকি আমিই একমাত্র ব্যাতিক্রম ? চলছি চলার পথে অনন্ত অসীম যে পথ অপেক্ষায় আছি এর সমাপ্তির । কখন শেষ হবে এই ক্লান্তিময় গ্লানিময় পথচলা ॥

বিষয়: Contest_mother

১৯৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File