উপমহাদেশের ইসলামিক রাজনৈতিক আন্দোলন (বিংশ শতাব্দি) ০৩ (বাংলাদেশ অধ্যায়)
লিখেছেন লিখেছেন তিতুমীর সাফকাত ২০ অক্টোবর, ২০১৩, ০১:২০:০৮ দুপুর
( ৩ )
১৯৭১ এর পর থেকে বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলোর অবস্থান
১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী সংগঠনগুলোর ইতিহাস যেমন গৌরবের নয়, তেমনি ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের ইসলামী সংগঠনগুলোও গণ-আকাঙ্খার যথার্থ প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। মাঝখানে শুধুমাত্র মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী এর আহবানে 'খেলাফত আন্দোলন' নামে স্বল্প সময়ের জোয়ার ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া আর কোন আশার আলো দেখা যায়নি এ সময়ের ইসলামী দলগুলোর আচরণ থেকে। খেলাফত আন্দোলন ভাঙ্গনের মাধ্যমে নিজেদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ ও স্বতন্ত্র কোন গতিপথ সৃষ্টি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এসময়ে ইসলামী দলগুলোর মাঝে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে পুঁজিবাদী শাসনের অংশীদার হওয়ার প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে সবচেয়ে বেশী। এমপি-মন্ত্রী হওয়ার লোভে নিজ আদর্শ ছেড়ে দিয়ে বড় দলের পিছনে চলার নীতি চালু হয়েছে ব্যাপকভাবে। ইসলামী ইস্যুকে ব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধির জন্য শাসক শ্রেণীর সাথে দর কষাকষি প্রকাশ্য রূপ লাভ করেছে। এইসব আচরণে ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃত চেহারা আজ সকলের কাছে অপরিচিত হয়ে গেছে। অথচ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বৈরী পরিবেশে ইসলামী দলগুলো ভিন্ন এক অঙ্গীকার নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল। আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের সহযাত্রী হিসাবে বাংলাদেশে তৎপর ইসলামী দলগুলো সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ও ইসলামী রাজনীতি
১৯৭২ সনে বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হয়। সম্পূর্ণ সেক্যুলার দৃষ্টি ভঙ্গিতে রচিত এই সংবিধানের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পিতভাবে এদেশে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। যদিও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইসলামী দল গুলোর ভূমিকা এর জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল, তবুও এই অজুহাতকে ব্যবহার করে প্রথম থেকেই বাংলাদেশকে একটি ইসলামশূন্য রাষ্ট্রে পরিণত করার বিদেশী চক্রান্তের অংশ ছিল এই সংবিধান। সমাজতন্ত্রের তল্পীবাহক ডক্টর কামাল হোসেন ছিলেন এর অন্যতম রচয়িতা। মুজিব সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী হিসাবে ১৯৭২ সালের ৩০শে মার্চ এক বিবৃতিতে ডক্টর কামাল বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ন্যায় মৌলিক নীতিসমূহ বিদ্যমান থাকিবে।' মূলতঃ এই চার নীতিমালার ভিত্তিতেই তৈরী হয় বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। যার মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন মুসলিম প্রধান এই দেশটিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজনীতি করার পথ সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।
সংবিধান পরিবর্তন ও বিসমিল্লাহ'র রাজনীতি
ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বাংলাদেশকে ইসলামী সভ্যতাশূন্য করার আওয়ামী দুঃসাহস ১৯৭৫ সালে এসে আরও ভয়াবহ রূপ লাভ করে। এক তরফা নির্যাতন চালাবার প্রয়াসে সব দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে চালু করা হয় এক দলীয় বাকশালী শাসন। এই জুলুম বেশী দিন টিকেনি। '৭৫ এর ১৫ আগষ্ট পট পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতারও পরিবর্তন হয়। দৃশ্যপটে আসেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বারের মত চালু করা হয় সামরিক শাসন। এরপর ১৯৭৭ সনের শুরুতে জিয়াউর রহমান সংবিধানে একটি সংশোধনী আনেন। যার মধ্যে থাকে বিসমিল্লাহ'র সংযোজন। আর উল্লেখ থাকে 'আল্লাহ্'র উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থাই হবে সংবিধানের মূল ভিত্তি।' এতেই তৎকালীন ইসলামী দলগুলো জিয়াউর রহমান এবং তার জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে ইসলামের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। এরপর থেকে সম্পূর্ণরূপে ইসলামী আদর্শের বিপরীত অবস্থানে থাকা এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র একটি কুফুরী সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' জড়াবার রাজনীতি দিয়েই জিয়া ও তার বিএনপি এদেশের ইসলামী শক্তির অভিভাবকের মর্যাদা দখল করে নেয়। আর কিছু কিছু ইসলামী দল হয়ে যায় বার বার বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার বাহন। যেন এ দলগুলোর আদর্শই হচ্ছে ইসলামী রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে বিএনপির জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সেবা করা।
ইসলামী দলগুলোর পুনর্বাসন
একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান ইসলামী রাজনীতির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ইসলামী দলগুলোর জন্য কিছুটা অনুকূল পরিবেশ তৈরী হয়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই জামায়াত নেতারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা শুরু করে। তবে মাওলানা আবদুর রহীম এবার আগের মতো পুরাতন দলের নামে কাজ করতে রাজী ছিলেন না। তাই তিনি আগের দলগুলোর সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত ইসলামী দল গঠনের উদ্যোগ নিলেন। এর প্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালে জামায়াতসহ তৎকালীন কয়েকটি ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে এই ভাষায় অঙ্গিকার করেন যে, "আমরা অধুনালুপ্ত কতিপয় ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ আল্লাহ্'কে হাজির নাজির জেনে এই অঙ্গীকার করছি যে, আমরা অতীতের পরিচিতি ভুলে সম্পূর্ণ নতুন নামে একটিমাত্র ইসলামী দল গঠন করব।" এই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে সাবেক জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, খেলাফতে রব্বানী, পিডিপি, বিডিপি, আইডিপি ও ইমারত পার্টিসহ মোট সাতটি দল নিয়ে 'ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ' (IDL) নামে একটি নতুন দল গঠন করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর রাজনৈতিক দূর্দিন কেটে গেলে অন্যান্য নেতারা আল্লাহ্'র নামে নেয়া শপথ ভঙ্গ করে হিংসার বশবর্তী হয়ে জামায়াতে ইসলামীকে জোট থেকে বের হওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। ফলে জামায়াতে ইসলামী আবার নিজ দলের নামে এ দেশে রাজনীতি শুরু করে। এভাবেই জামায়াতকে দুর্বল করার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইসলামী রাজনীতিতে অনৈক্যের সূচনা হয় এবং ১৯৮০ সনে আইডিএল ভেঙ্গে পূর্বনামে জামায়াতকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে হয়।
মাওলানা আবদুর রহীম এবার আর জামায়াতের রাজনীতির সাথে একাত্ম হননি। তিনি ১৯৮৪ সালের ৩০ শে নভেম্বর আইডিএলকে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন নাম দিয়ে নতুন গতিতে রাজনীতি শুরু করেন।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন
১৯৮১ সনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে প্রবীণ আলেম মওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন ব্যক্তিত্ব রূপে আবির্ভুত হন। তাঁর 'তওবার রাজনীতি'র ডাক দেশের রাজনীতি বিমূখ ইসলামী মহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষতঃ তার ছাত্র-শিষ্যদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ এ ডাকে সাড়া দিয়ে অচিরেই সামনে এগিয়ে আসেন। তাদেরকে নিয়েই তিনি ১৯৮১ সনের ২৯ নভেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক শায়েস্তা খান হলে 'খেলাফত আন্দোলন' নামে একটি সংগঠনের কার্যক্রম ঘোষণা করেন। প্রায় ৫০ বছর পর খেলাফত আন্দোলনের নামে এ অঞ্চলে বিশৃঙ্খলার সৃস্টি হয়। স্বাধীনতার পর এই প্রথম উলামাদের মাঝে তৈরী হয় নতুন বিভেদ। তবে ইতিপূর্বে অনেকের মাঝে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, ইসলামে কোন রাজনীতি নেই। তাছাড়া পাকিস্তান হওয়ার পর খিলাফত কায়েমের সুনির্দিষ্ট দাবীতে এ অঞ্চলে কোন আন্দোলন না থাকায় জাতিগতভাবে সকলেই প্রায় এই বিষয়ে নিরবতা পালন করছিলেন। হাফেজ্জী সাহেব এ জন্য জাতিগত ভাবে সকলের প্রতি তওবার আহ্বান জানান। মূলতঃ গায়রুল্লাহর প্রবর্তিত প্রতারণার রাজনীতি থেকে আল্লাহ্'র প্রবর্তিত সততার রাজনীতিতে প্রবর্তনের নাম দেয়া হয়েছিল তওবার রাজনীতি। (পরে যার স্বরূপ উতঘাটিত হয় এবং বিপর্যস্ত হয়, জামায়াত চল্লিশ বছর ধরে যে আশঙ্কা করেছিলো তাই হয়েছিল, খিলাফাতের প্রতি জনসাধারন বিতশ্রদ্ধ হয়ে পরে এবং ভুল ধারনা পোষণ করে, পরবর্তীতে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে)
খেলাফত আন্দোলনের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছ, খেলাফত আন্দোলন কোন পার্টি নয়, এটি একটি আন্দোলন। দল-মত ও দেশকালের উর্ধ্বে থেকে গোটা মানব মন্ডলীকে আল্লাহ্'র যমীনে আল্লাহ্'র খেলাফত কায়েমের ডাক দেয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য।
কয়েক বছরের মাথায় হাফেজ্জী সাহেব নিজেকে কেন্দ্র করেই দেশের ছোট বড় এগারটি সংগঠন ও কতিপয় বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে 'খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ' নামে একটি বৃহত্তর মোর্চা গড়ে তুলেন। হাফেজ্জী সাহেবের বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, মাওলানা আব্দুর রহীমের ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, মেজর (অব.) এম এ জলীলের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন প্রভৃতি সংগঠন এ মোর্চাকে নিয়ে গনতন্ত্রকে গালি দিয়ে আবার গনতন্ত্রের মতই জনগণের আশা-আকাঙ্খার কেন্দ্র-বিন্দুতে পরিণত করার লক্ষ্যে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। এই দ্বিমুখি নীতির কারনে তারা তেমন সফলতার মুখ দেখেন নি, বরং খিলাফাতকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
১৯৮২ সনের মার্চে সেনাপ্রধান এরশাদ বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করলে হাফেজ্জী সাহেবের গনতান্ত্রিক পন্থায় খলিফা হওয়ার স্বপ্ন বিনস্ট হয়ে যাওয়ায় এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তবে জামায়াত এ সময় নিরবতা পালন করে। ১৯৮৬ সনে এরশাদ যখন সবার অংশগ্রহনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে, তখন এ নির্বাচনে বৈধতা দেয়ার জন্য জামায়াত ও আওয়ামী লীগের মত দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়।
বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতিতে খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে গঠিত 'সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ' তাদের ঐক্য বেশী দিন ধরে রাখতে পারেনি। ফলে হাফেজ্জীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে খিলাফতের রাজনীতির নামে যে বিভেদের রাজনীতি শুরু হয়েছিলো তা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু এর প্রভাব এখনো বর্তমান। ১৯৮৫ সনে হাফেজ্জী সাহেবের জীবদ্দশায় তারই শিষ্য শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক হাফেজ্জীর নেতৃত্বাধীন দল থেকে বের হয়ে নিজ নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন (আ-গা) নামে আরেকটি দল গঠন করেন। এ দলটিই ১৯৮৯-এর ১২ অক্টোবর যুব শিবিরের সাথে একাকার হয়ে খেলাফত মজলিস নামে নতুন দল হিসাবে আত্ম প্রকাশ করে। উল্লেখ্য ১৯৮২ সনে অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদেরেকে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির থেকে বের করে দেওয়ার পর তিনি কিছু ছেলে নিয়ে যুব শিবির নামে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন।
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন
এই দলটি একক কোন রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরু করেনি। বরং অনেকগুলো ইসলামী দলের সমন্বয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে এর কার্যক্রম শুরু করা হয়। পরে অবশ্য এই ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এটি একটি একক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
১৯৮৭ সনে তদানিন্তন সময়ের কয়েকজন বিশিষ্ট আলিম, পীর-মাশায়েখ এবং ইসলামী রাজনীতিবিদ অনুভব করলেন ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপকভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - চরমোনাই'র পীর মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিম, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক, ঐক্য আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুর রহীম, জামায়াতের মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, ব্যারিস্টার মাওলানা কোরবান আলী, মাওলানা আবদুল আহাদ মাদানী, তৎকালীন যুব শিবিরের সভাপতি অধ্যাপক আহম্মদ আব্দুল কাদের প্রমূখ। ঐক্যের জন্য পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে তারা কঠিন শপথ করলেন। সিদ্ধান্ত হলো ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ, সকলের উপস্থিতিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হবে এবং এই ঐক্য প্রক্রিয়ার অন্যতম উদ্যোক্তা মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। কিন্তু সেদিন সম্মেলনস্থলে গিয়ে জানা গেল ঐক্যবদ্ধ ইসলামী আন্দোলনের উদ্যোক্তা মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী দেশ ছেড়ে উধাও হয়ে গেছেন। তিনি নাকি নিজ দল জামায়াতের চাপে ইতিমধ্যেই পাড়ি জমিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। এর পিছনে চরমোনাই এর পীর সাহেবের হাত থাকার দাবীও অনেকে জানান। যাই হোক নির্ধারিত দিনেই ঢাকাস্থ মতিঝিলের হোটেল 'শরীফস ইনে' অনুষ্ঠিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন পীর সাহেব চরমোনাই। এর মাধ্যমেই আশঙ্কা সত্য প্রমানিত হলো, মুলত জামায়াত চাইছিলো বিভেদ ভুলে গিয়ে আবার সকল ইসলামী দলগুলোর ঐক্য। কিন্তু সাঈদী সাহেবের জনপ্রিয়তায় অতিস্ট হয়ে ও জামায়াতের শক্তিকে খর্ব করতে জামায়াতকে বাদ দিয়ে চরমোনাইয়ের নেতৃত্বে ১৩ মার্চ ১৯৮৭ ছিল জনসম্মুখে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আত্মপ্রকাশের ঘটে। কিন্তু কিছুদিন পর যা ঘটার তাই ঘটে। অনৈক্য, ভাঙ্গন, হতাশা।
১৯৮৭ সনের ১ অক্টোবর মাওলানা আব্দুর রহীম ইন্তেকাল করেন (ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এরপর '৯১এর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ব্যারিস্টার মাওলানা কোরবান আলীর নেতৃত্বে একটি অংশ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনে থেকে যায়, আর হাফেজ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি অংশ এ ঐক্য থেকে বের হয়ে যায়। অন্য দিকে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন (আ-গা) এবং ইসলামী যুব শিবিরও এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ১৯৮৯-এর ১২ অক্টোবর খেলাফত আন্দোলন (আ-গা) ও যুব শিবিরের এক যৌথ বৈঠকে খেলাফত মজলিস নামে নতুন দল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন চরমোনাইর পীর সাহেবের নেতৃত্বাধীন একটি একক দলে পরিণত হয়। এটাই ছিলো পীর সাহেবের সবচেয়ে বড় কারিশমা। নিজের দল তৈরির খমতা না থাকায় বিভেদ সৃস্টি করে অন্যের দলটাকেই নিজের বানিয়ে নিলেন।
২০০১ এর নির্বাচনে জাতীয় স্বার্থে যখন অনেক ওলামা ও ইসলামী দল বিএনপি এর নেতৃত্বের অধীনে জোটবদ্ধ নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন জামায়াত-বিএনপি'র সাথে না হলেও এরশাদের সাথে ঠিকই নির্বাচনী জোট বাঁধে। অবশেষে এ দলটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাভের জন্য ২০০৮ এর অক্টোবরে বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে তৈরী হওয়া 'ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন' তাদের নাম পরিবর্তন করে 'ইসলামী আন্দোলন' নাম ধারণ করে।
ইসলামী ঐক্যজোট
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর একটি স্মরনীয় গণআন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে ৷ এরপর ১৯৯১ সনের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামী ঘরানায় চালু হয়ে যায় ভিন্ন রকম হিসাব-নিকাশ। নতুন করে তৎপর হয়ে ওঠেন ইসলামী জগতের ঐ সকল কুশীলবগণও যারা হাফেজ্জীর নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন থেকে বের হয়ে এসেছেন। এর মাঝে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন হাফেজ্জী সাহেবের জামাতা মুফতী ফজলুল হক আমিনী(রঃ)। যিনি হাফেজ্জীর ইন্তেকালের পর (১৯৮৭) খেলাফত আন্দোলন ত্যাগ করে ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে সকলের নজর কাড়তে সক্ষম হন। খিলাফত ব্যবস্থার পক্ষে জনমত গঠন ও গণবিপ্লব সৃষ্টির পরিবর্তে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগনের কাছে পৌছানোর লক্ষ্যে তিনি এবং অন্যান্য কয়েকটি ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ মিলে একটি ইসলামী ঐক্যজোট গঠন করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক সত্য হলো নির্বাচন চলাকালেই এই ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য অনেকেই নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, দেশের মাদরাসাগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করা এবং ক্ষমতাসীনদের সাথে দর কষাকষির হাতিয়ার হিসাবে এই নামটিকে ব্যবহার করেছেন। এই প্রবণতা বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতিতে অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি ধারার জন্ম দেয়, তা হলো ইসলামী আদর্শের তোয়াক্কা না করে প্রচলিত পুঁজিবাদী রাজনীতির সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া।
১৯৯১ সনে গঠিত বিএনপি সরকারের দলীয় করণ ও দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার ফলে ১৯৯৬ এর নির্বাচনে ইসলাম বিদ্বেষী আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। এরপর ইসলামের উপর একের পর এক আঘাত আসতে থাকে। আওয়ামী সরকারের দুঃশাসন, ইসলাম ও ওলামা বিদ্বেষী আচরণ ইসলামী দলগুলোকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার পরিবেশ তৈরী করে দেয়। কিন্তু কিছু কিছু নেতার অতীত ভূমিকা অভিজ্ঞজনদেরকে এই ঐক্যে তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। তদুপরি ২০০১ সনে মহিলা নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির অধীনে চারদলীয় জোটে থাকা না থাকাকে কেন্দ্র করে ইসলামী ঐক্যজোটে আরেক দফা ভাঙন দেখা দেয়। শাইখুল হাদীস ও আমিনীর নেতৃত্বে খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী মোর্চা প্রভৃতি দল বিএনপি ও জামায়াতের সাথে চার দলীয় জোটভূক্ত হয়ে নির্বানে অংশ নেয়। আর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন জোট বাঁধে এক কালের স্বৈরশাসক এরশাদের সাথে। নির্বাচনোত্তর খালেদা জিয়ার সরকারে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে ঐক্যজোটের ঘনিষ্টতা একেবারে খানখান হয়ে যায়। মুফতী ফজলুল হক আমিনী শাইখুল হাদীস আজীজুল হকের পরিবর্তে নিজেকে ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে শাইখুল হাদীস খেলাফত মজলিস নিয়ে ঐক্যজোট থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর থেকে এই দলটি একাই নিজেদেরকে ইসলামী ঐক্যজোট বলে দাবী করতে থাকে। এদিকে সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রতিযোগীতার দ্বন্দে ঐক্যজোট আমিনী অংশের নতুন মহাসচিব নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মুফতী ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীকে জোট থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ নিয়ে ভেঙ্গে যায় নেজামে ইসলাম পার্টি। নতুন নেজামে ইসলাম পার্টি ঘোষণা করে মুফতী ইজহারুল ইসলামও নিজেকে ঐক্যজোটের নেতা বলে দাবী করেন। মিসবাহুর রহমান নামে এক হকার নেতাকে মহাসচিব নিযুক্ত করার কয়েকদিন যেতে না যেতে সেও বিদ্রোহ করে মুফতী ইজহারের সাথে। ইজহারের জোট ভেঙে সে তার দলের নাম দেয় বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট। অন্যদিকে নেতৃত্বের কোন্দলে পড়ে ভেঙে যায় খেলাফত মজলিস। ২০০৫ সনের ২২ মে শাইখুল হাদীসের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে আহমদ আব্দুল কাদির তার পুরাতন যুব শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আরেকটি খেলাফত মজলিসের জন্ম দেয়।
এমতাবস্থায় মুফতী আমিনী চারদলীয় জোটে ইসলামী ঐক্যজোটের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই নব গঠিত খেলাফত মজলিসের নামই ব্যবহার করতে থাকেন। এরই মধ্যে ঘটে যায় আরেক ভয়াবহ ঘটনা। স্মরণ কালের সকল ইতিহাস ব্রেক করে মুফতী ইজহার ফুলের তোড়া দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বরণ করে নেন। আর ২০০৬ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর শাইখুল হাদীস নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস পাঁচ দফা চুক্তির ভিত্তিতে চির শত্রু আওয়ামীলীগের সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দেয়। এভাবে ক্ষণিকের ক্ষমতা লোভী কতিপয় নেতার আচরণ বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনকে ভাবগাম্ভীর্যহীন একটি ঠাট্টার বস্তুতে পরিণত করে।
আগামীদিন চতুর্থ পর্ব তথা শেষ পাবেন ইনশাআল্লাহ
উপমহাদেশের ইসলামিক রাজনৈতিক আন্দোলন (বিংশ শতাব্দি) ০১ (ব্রিটিশ আমল)
উপমহাদেশের ইসলামিক রাজনৈতিক আন্দোলন (বিংশ শতাব্দি) ০২ (পাকিস্তান আমল)
বিষয়: রাজনীতি
১৭৭৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন