জিহাদ নিয়ে বিভ্রান্তি
লিখেছেন লিখেছেন তিতুমীর সাফকাত ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১০:০৭:০৪ রাত
কনফারেন্স রুমের এসি চলছে। শ্রোতারা গভীর মনোযোগে শুনে যাচ্ছেন ভারী নামের বিখ্যাত স্কলার বা আলিমের বক্তব্য। আজানে মাইক ব্যবহার করা জায়েজ কিনা, ফাস্ট ফুড খাওয়া ঠিক কিনা, টুপি গোল না লম্বা পরতে হবে ইত্যাদি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিলেন তিনি। তবে তাঁর অপছন্দনীয় হলেও জনৈক প্রশ্নকারী জিহাদের প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে এলো। এবার শুরু হলো তাঁর দীর্ঘ বক্তব্য আর তিনি একের পর এক যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কেন এখন জিহাদের প্রয়োজন নেই। আলোচনা শেষে সম্মানিত স্কলারকে রাজকীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্ডনে সসম্মানে তাঁর বাংলোয় পৌঁছে দেয়া হলো।
কিন্তু সত্যিই কি জিহাদ নেই বা এর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে? এমন কি কোন মুসলিম নেই, যে কিনা এই যুগেও কুরআনের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছে?
আল্লাহু আকবার, আজ আমরা এমন এক সময় পার করছি যখন জিহাদের বিরুদ্ধে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বলার জন্য সাধারণ মুসলিম শুধু নয়, আলিম বা স্কলারেরও অভাব নেই। কেউ কেউ আবার জিহাদকে আবশ্যক হিসাবে বলে এবং এরপরই নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে দিয়ে বর্তমানের জন্য একে অপ্রয়োজনীয় বলে কৌশলে যেন এর পিঠে ছুরিই বসিয়ে দেবার অপচেষ্টায় নেমেছে।
আজ জিহাদ নিয়ে নানা বিভ্রান্তির উত্তর আমরা খুঁজে নেবার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
মানবজাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে সত্য ও মিথ্যার সংঘাত সকল সময় চলে এসেছে। এছাড়াও সংঘাত হয়েছে বাতিল ও বাতিলের মধ্যে। সত্যের সাথে মিথ্যার বা বাতিলের সাথে বাতিলের এ লড়াইয়ের মাধ্যমে আল্লাহ দুনিয়ার বুকে স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছেন যা তিনি কুরআনে বলেছেন।
“মানবজাতির এক দলকে আল্লাহ যদি অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে সমগ্র পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত, কিন্তু বিশ্বজগতের উপর আল্লাহ হলেন পরম করুণাশীল”। – সুরা বাক্বারাঃ ২৫১
নিউয়র্ক, লন্ডন বা কোপেনহেগেন কিংবা কায়রো-করাচি-ঢাকায় যুদ্ধবিরোধী যত সমাবেশই হোক আর যাদুকরী অসাড় কথার ফুলঝুরি ছুটুকনা কেন, এ যুদ্ধ কখনই বন্ধ হয়নি বা হবার নয়, আল্লাহর ঘোষণাই চুড়ান্ত।
শয়তান আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বহিষ্কৃত হবার পর আল্লাহর কাছে তার করা প্রার্থণা ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার অনুসারী একদল মানবগোষ্ঠী তৈরী করেছে এবং বিপরীত দিকে আল্লাহ এর বিপক্ষে তাঁর একান্ত অনুগ্রহের মাধ্যমে একদল বান্দাকে শয়তানের কবল থেকে বাঁচিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছেন। যুগে যুগে সত্য মিথ্যার এ সংঘাতে অধিকাংশ সময় বাহ্যত মিথ্যার পাল্লা ও সাজ সরঞ্জাম ছিলো ঈর্ষণীয় ও অধিক, কিন্তু তবুও আল্লাহ সত্যকে কখনও মিথ্যার কাছে পরাজিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হতে দেননি। এ হচ্ছে আল্লাহর ওয়াদা যা তিনি কুরআনে বলেছেন-
“সত্য সমাগত হয়েছে এবং মিথ্যা দূরীভুত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা দূরীভুত হবেই” –সুরা বনী ইস্রাইলঃ ৮১
সকল রাসুল একই মিশন নিয়ে পৃথিবীতে কাজ করেছেন এবং আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না (যেমনটি আল্লাহ কুরআনে বলেছেন “লা নুফাররিকু বাইনা আহাদিম মির রুসুলি)। তবে অন্য রাসুলদের সাথে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কিছু মৌলিক পার্থক্য আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন যা হলো- তাঁর কাছে প্রেরিত সর্বশেষ কিতাব কুরআন সংরক্ষণ ও কাফিরদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ওদের মোকাবেলায় তাঁর মনোনীত দীনের বিজয়। তবে এ বিজয় এমন নয় যে আল্লাহ তা এমনি এমনি দিয়ে দেবেন। আল্লাহ যখন কুরআনে ইসলামের বিজয়ের কথা উল্লেখ করেছেন তখন সাথে সাথেই তিনি মুমিনদের জিহাদের জন্য ডেকেছেন। আল্লাহ বলেন-
“তারা আল্লাহর নুর (ইসলাম) কে ফুঁৎকার দিয়ে নিভিয়ে দিতে চায় কিন্তু আল্লাহ তাঁর নুর প্রজ্জ্বলিত না করে ছাড়বেননা, কাফিরদের কাছে তা যতই অপছন্দনীয় হোকনা কেন। তিনিই আল্লাহ, যিনি রাসুলকে পাঠিয়েছেন হিদায়াত ও সত্য দীন সহ অন্য সকল দীনের উপর বিজয়ী হবার জন্য, মুশরিকদের কাছে তা যতই অপছন্দনীয় হয়ে থাকুক না কেন। ওহে যারা ঈমান এনেছো, আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দেব যা তোমাদের বাঁচাবে ভয়ংকর আযাব থেকে? (তাহলে) তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো আর ঈমান আনো রাসুলের উপর এবং আল্লাহর পথে জিহাদ কর তোমাদের সম্পদ এবং জীবন দিয়ে, এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা তা জানতে”। (সুরা সফঃ ৮-১১)
আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে সমগ্র মানবজাতিকে তিনি একটি উম্মাহ বানাতে পারতেন যারা কেবল তাঁরই আনুগত্য করত, কিন্তু তিনি তা চাননি। মানুষ যখন আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করেছে বা ইলাহ হিসাবে আল্লাহর স্থানে অন্য কাউকেও বাসাতে শুরু করেছে তখন আল্লাহ তাদের ধ্বংস না করে দিয়ে তাদের অবারিত স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন, তবে তিনি সকল মানবগোষ্ঠীর কাছেই তাঁর পক্ষ থেকে সতর্ককারী রাসুল প্রেরণ করেছেন যারা চোখে আঙুল দিয়ে মানুষকে তাদের পাপাচার সম্বন্ধে সতর্ক করেছে। তাদের কথা কেউ মেনে নিয়েছে কেউ নেয়নি, এমনকি এমন রাসুলের কথাও হাদীসে এসেছে যার কথা একটি লোকও মেনে নেয়নি। তবে অনেক জাতিকে আল্লাহ সে সৌভাগ্য দিয়েছিলেন যারা তাদের রাসুলদের সাহায্য করেছে এবং অবর্ণণীয় অত্যাচার, কষ্ট সহ্য করে এবং অসম যুদ্ধে কাফিরদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, তবে চুড়ান্ত বিচারে জয় হয়েছে বিশ্বাসীদেরই। আল্লাহ এদের সাহায্য করেছেন, এদের দোষ-ত্রুটিগুলো ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন।
সকল রাসুলের সাথে রাসুল সাঃ এর যে পার্থক্য কুরআনে আল্লাহ বলেছেন ও আমরা আগে আলোচনা করেছি, গত সাড়ে চৌদ্দশ বছরে আল্লাহ তা আমাদের দেখিয়েছেন এবং কিয়ামাত পর্যন্ত এর অন্যথা হবেনা। আগের জাতিগুলোর মতোই রাসুলুল্লাহ সাঃ এর উম্মাতদের জন্য আল্লাহ তাঁর দীনকে বিজয়ী নিজ থেকেই করে দেননি। আল্লাহ আমাদের জন্য অন্য জাতির মতোই এই অনন্য সুযোগটি দিয়েছেন যে আমরা তাঁর দীনের জন্য নিজের জীবন আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দেব আর আল্লাহ এই বিক্রির বিপরীতে আমাদের জান্নাত দেবেন।
আল্লাহ বলেন,
“অবশ্যই আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে তাদের জান ও মালকে কিনে নিয়েছেন। এরা আল্লাহর পথে জিহাদ করে অতঃপর হত্যা করে ও নিহতও হয়”। -সুরা তাওবাঃ ১১১
শুধুমাত্র এই একটি আয়াতই মুসলিমদের জন্য যথেষ্ট যে, তারা নিজের জীবন তুচ্ছ করে আল্লাহর দীন ইসলামকে সকল দীনের উপর বিজয়ী করবে। রাসুলুল্লাহ সাঃ যখন বদরের যুদ্ধে কাফিরদের মোকাবেলা করতে যাচ্ছিলেন, তখন ৩১৩ জন মামুলী অস্ত্রধারী যোদ্ধা হাজার খানেক সুসজ্জিত যোদ্ধার সামনে পড়তে যাচ্ছিলো। সমর কুশলতায় কেউ কারো চেয়ে অগ্রগামী ছিলো না, কেননা উভয়পক্ষের অনেকেই ছিল রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন। ৩ গুন সংখ্যাধিক্য, ভারী অস্ত্র ও অধিক বাহন কাফির বাহিনীর জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিলো এবং সত্যিই যদি তা হতো তাহলে রাসুল সাঃ সহ আল্লাহর দীন চিরতরে পৃথিবী থেকে মুছে যাবার ইতিহাস লিখতে হতো। কিন্তু আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুসলিমদের বিজয় দিয়েছেলেন যেহেতু রাসুল সাঃ ও মুসলিমদের কেউই নিজের জীবন বিকিয়ে দিতে পিছপা হননি।
কুফফার গোষ্ঠীও বসে থাকেনি এবং কিয়ামাত পর্যন্ত আল্লাহর ঘোষণার সত্যতা প্রমাণ করে তারা আল্লাহর দীনকে নিভিয়ে দেবার সব প্রচেষ্টাই অব্যাহত রাখবে। আর এভাবেই রাসুলুল্লাহ সাঃ এর মাধ্যমে শুরু হওয়া জিহাদ কিয়ামাত পর্যন্ত চলবে। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “এই দীন সর্বদা টিকে থাকবে এবং দীনকে কায়েম রাখার জন্য মুসলিমদের একটি দল কিয়ামাত পর্যন্ত সশস্ত্র জিহাদ চালিয়ে যাবে”। (মুসলিম)
রাসুল সাঃ আরো বলেছেন, “আমাকে কিয়ামাত পর্যন্ত সকল যুগের জন্য তলোয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে আর আমার রিজিক রাখা হয়েছে বল্লমের ছায়ার নীচে”। (সহীহ বুখারী, আহমাদ ২/৫০, ৯২; আলবানী এর সনদ হাসান বলেছেন; ইমাম বুখারী এটিকে তাঁর সহীহ গ্রন্থে তালীক হিসাবে বর্ণনা করেছেন)
সুনান আন নাসায়ীতে বর্ণিত হয়েছে,
সালামা ইবন নুফাইল (রাঃ) বলেছেন, “যখন আমি রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সাথে বসে ছিলাম তখন একজন মানুষ এসে বলল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, ঘোড়াদের অপমান করা হচ্ছে, অস্ত্রগুলো ফেলে রাখা হয়েছে এবং মানুষ মনে করেছে জিহাদ আর নেই এবং সব যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, ‘তারা মিথ্যা বলছে, যুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। যুদ্ধতো সবে শুরু হয়েছে। আমার উম্মাহ থেকে সবসময় একটি দল সত্যের উপর যুদ্ধ করতে থাকবে এবং আল্লাহ কিছু মানুষের ক্বলবকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন এবং তাদের থেকে এই দলের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী সরবরাহ করবেন (ততক্ষন), যতক্ষন না শেষ সময় ঘনিয়ে আসে এবং আল্লাহর ওয়াদা সত্য বলে প্রমানিত হয়। এবং কিয়ামাত পর্যন্ত ঘোড়ার কপালেই মঙ্গল লেখা থাকবে।“
সামনেই পবিত্র রমজান মাস। এ মাসে সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর করে দেয়া ফরজ রোজা রাখবে। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো এই যে, কেবলমাত্র একটি আয়াতের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের সকল মুমিন রামাদানের রোজাকে ফরজ বলে জানে আর তা হলো সুরা বাক্বারার ১৮৩ নং আয়াত যেখানে আল্লাহ বলেছেন-
“তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের উপর সিয়াম (রোজা) ফরজ করে দেয়া হল, যেমন দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তিদের উপর যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার”। -সুরা বাক্বারাঃ ১৮৩
আল্লাহ এ আয়াতে “কুতিবা আ’লাইকুমুস সিয়াম” এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন যার অর্থ হতে পারে “পাকাপাকিভাবে লিখে দেয়া হলো”। এই একইভাবে আল্লাহ সুরা বাক্বারার ২১৬ নং আয়াতে বলেছেন,
“তোমাদের উপর সশস্ত্র যুদ্ধ ফরজ করে দেয়া হলো, যদিও তোমরা তা অপছন্দ কর” –সুরা বাক্বারাঃ ২১৬
আল্লাহ এখানে বলেছেন “কুতিবা আ’লাইকুকুল ক্বিতাল” যার মানে দাঁড়ায় “পাকাপাকিভাবে লিখে দেয়া হলো”। তবে এখানে আল্লাহ তাঁর অনন্য প্রজ্ঞার কয়েকটি নজীর দেখিয়েছেন আয়াতের পরবর্তি অংশে, যেখানে তিনি বলেছেন-
“যদিও তোমরা তা অপছন্দ কর”।
স্বভাবগত আরামপ্রিয়তার কারণে যুদ্ধের অংশটি প্রায় সকল মানুষের কাছেই অপ্রিয় বোধ হয় আর তা থেকে বের হয়ে আসাটাই হলো আল্লাহর পরীক্ষা ও মুমিনের বৈশিষ্ট্য। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যে, আল্লাহ এখানে ‘জিহাদ’ শব্দটি না উল্লেখ করে ‘ক্বিতাল’ উল্লেখ করেছেন। মানুষ যেভাবে জিহাদ শব্দটিকে বিকৃত করে মিছিলের জিহাদ, অফিসের জিহাদ, সংসারের জিহাদ, বিতর্কের জিহাদ ইত্যাদি বানিয়ে মূল জিহাদকে ভুলে থাকতে বা ভুলিয়ে রাখতে চাইছে, ‘ক্বিতাল’ (যার অর্থ সশস্ত্র যুদ্ধ) শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহ এর সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন।
কুরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত অবশ্যপালনীয় বিষয়গুলো আল্লাহ যখন বর্ণনা করেছেন, তখন আল্লাহ একদিকে যেমন সেগুলো পালনের পুরষ্কার বর্ণনা করেছেন তেমনি না পালনের শাস্তিও অত্যন্ত কঠোরভাবে বলেছেন, যে কথার অন্যথা হবার কোন সুযোগ নেই। যেমন-আল্লাহর দেয়া খাদ্যসমূহ ভোগ করার কথা যেমন বলেছেন, অপচয় না করার ব্যাপারে তেমন কঠিন হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। শির্ক না করলে যাকে তিনি চান তার অন্য অপরাধ ক্ষমা করার কথা যেমন বলেছেন, তেমনি শির্ক করলে অবধারিত জাহান্নামের কথাও বলেছেন। ঠিক তেমনি জিহাদ করার ফল যেমন তিনি অবশ্যম্ভাবী ক্ষমা এবং জান্নাতের কথা বলেছেন, জিহাদ না করা বা তার বিরুদ্ধ কোন কাজ করার কথাও আল্লাহ অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। আজ আমরা জিহাদকে যদি আমদের জীবন থেকে বাদ দিয়ে প্রকৃত ইসলামের বাকী সকল বিধান মেনেও আল্লাহর কাছে যাই, তাহলে কি আমাদের জান্নাত নিশ্চিত থাকবে? আল্লাহ বলেন,
“তোমরা কি মনে কর যে তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে এমনি, যতক্ষন না আল্লাহ জেনে নেবেন তোমাদের মধ্যে কে (আল্লাহর পথে) যুদ্ধ করেছে আর কে আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও মুসলিমদের ব্যাতিত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা থেকে বিরত রয়েছে?”। – সুরা তাওবাহঃ ১৬
আল্লাহ আরো বলেন,
“তোমাদের কি ধারণা তোমরা এমনি এমনি জান্নাতে চলে যাবে, অথচ দেখে নেয়া হবে না তোমাদের মধ্য কারা জিহাদ করেছে আর কারা ধৈর্য্যশীল?” – সুরা আল ইমরানঃ ১৪২
তিনি আরো বলেছেন,
“তোমাদের কি ধারণা তোমরা এমনি এমনি জান্নাতে চলে যাবে অথচ এখন পর্যন্ত তোমাদের উপর পূর্ববর্তিদের মত বিপদ আপদ আপতিত হয়নি, তাদের উপর এসেছিল বহু বিপদ ও কষ্ট। তাদেরকে অত্যাচার নির্যাতনে জর্জরিত করে দেয়া হয়েছে, এমনকি শেষ পর্যন্ত নবী ও তার অনুসারীরা আর্তনাদ করে বলতে বাধ্য হয়েছিল যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য”। – সুরা বাক্বারাঃ ২১৪
আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। এর চেয়ে স্পষ্ট আর প্রকাশ্য কথা আর কি হতে পারে?
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন জিহাদ কিয়ামাত পর্যন্ত চলবে এবং কিয়ামাত পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে একটি দল আল্লাহর পথে জিহাদে রত থাকবে (মুসলিম, আহমাদ, ইবন হিব্বান), এ কথার অন্যথা হবার নয়। মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়েছে, মানবতা যখন বিপন্ন হয়েছে, আল্লাহর পথের মুজাহিদরাই এগিয়ে এসেছে। নিজের জীবন দিয়ে তারা আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়িত করে স্বস্তি দিয়েছে অসহায় মানুষকে। আল্লাহ বলছেন-
“তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছো না, অথচ অসহায় অবস্থায় পতিত কত পুরুষ, নারী এবং শিশু রয়েছে যারা চিৎকার করে (কাঁদছে) বলছে, “ও প্রতিপালক, আমাদের এই জনপদ থেকে উদ্ধার করুন কারণ এখানকার অধিবাসীরা জালিম। এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে একজন অভিভাবক পাঠান ও একজন সাহায্যকারী পাঠান”। – সুরা নিসাঃ ৭৫
ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু রাজ্যে হিন্দু রাজা দাহির যখন একটি মুসলিম বোনকে আটকে রেখে নির্যাতন করছিলো, তখন তার লেখা একটি চিঠি পেয়ে ১৭ বছরের যুবক মুহাম্মাদ বিন কাশিম অল্প কিছু সেনা নিয়ে সেই পথ পেরিয়ে সিন্ধু আক্রমন করতে আসেন আসেন, যে পথটি এখন আমরা প্লেনে পাড়ি দিতেও ক্লান্তি বোধ করি। ১৯৯০ সালে বসনিয়াতে যখন সার্ব বাহিনী আক্রমণ করে হাজার হাজার মুসলিম হত্যা করছিলো, সারা বিশ্বের মিডিয়াতে সামান্য কিছু তথ্য আসার পর যখন কাফিররা পর্যন্ত আঁতকে উঠছিলো, তখন আফগান মাটি থেকে আরব মুজাহিদের ছোট একটি দল হাজারো মাইল আর শত কষ্ট দূরে ঠেলে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। তাদের চেষ্টায় ইসলামকে প্রায় ভুলে যাওয়া বসনিয়ান মুসলিম জাতি ধীরে ধীরে রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছিলো। কমিউনিজমের ফিতনা ছেড়ে মানুষ আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার জন্য নাম লেখাচ্ছিলো, জিন্স আর শার্ট ছেড়ে মেয়েরা হিজাব গ্রহণ করছিলো আর এভাবে একদিন তারা সক্ষম হয়েছিলো সার্ব বাহিনীকে পিছু হটাতে। যুগে যুগে অকুতোভয় মুসলিম মুজাহিদগণ এভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন-
“মুমিনরা হচ্ছে একটি দেহের মত, এর একটি অঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো শরীর জ্বর অনুভব করে” (সহীহ মুসলিম)।
এখন চলছে সেই ক্রান্তিকাল, যখন আমরা নিজেরাই দাঁড়িয়ে গেছি জিহাদের বিরুদ্ধে। লক্ষ লক্ষ অসহায় মুসলিমের আর্তনাদ আমাদের কান দিয়ে ঢুকতে পারেনা। গাজার যে ফুটফুটে শিশুটিকে তার মায়ের সামনে বুলেটে এফোঁড়-ওফোঁড় করা হয়েছিল সেটা আমাদের চোখে কোন আগুন জ্বালায়নি। ইরাকে ক্লাস্টার বোমায় যখন এক পরিবারের সবাই মারা গিয়েছিল, তখন আমরা আফসোস করেছি আমাদের প্রমোশন নিয়ে। আবু গারিব কারাগারে যখন সারা জীবন হিজাব করা আমাদের বোন ফাতিমাকে একই দিনে নয়বার ধর্ষণ করা হলো, আমরা তখন ব্যস্ত ছিলাম লাক্স-চ্যানেল আই ফটোসুন্দরী নিয়ে। চেচনিয়াতে যখন মুসলিমদের ঘরগুলো রাশিয়ান বাহিনী বাসিন্দাদের ভেতরে তালাবদ্ধ করে করে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, তখন আমরা রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে বসে সংস্কৃতি বিনিময় করছিলাম। তবে আল্লাহর বাণী ভুল হয়নি, আল্লাহর অনেক বান্দা নিজেদের জীবনকে তাঁর কাছে বিক্রি করে, নিজেদের সকল সম্পদ ফেলে রেখে ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আর এদেরই সামান্য উপস্থিতি প্রকম্পিত করেছিল কাফির গোষ্ঠীকে।
জিহাদে না যাওয়ার ভয়ংকর পরিণাম সম্বন্ধে আল্লাহ বলেছেন,
“যদি তোমরা জিহাদে বের না হও তাহলে আল্লাহ তোমাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দেবেনেবং অন্য একটি জাতিকে তোমাদের উপর চাপিয়ে দেবেন যাদের তোমরা কোন ক্ষতি করতে পারবেনা”। -সুরা তাওবাহঃ ৩৯
ইবন উমার (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাঃ কে বলতে শুনেছি, “তোমরা যদি নিজেদের মধ্যে ব্যবসা করতে থাক, আর ষাঁড়ের লেজের পেছনে চলতে থাক, এবং কৃষক হিসাবে থেকেই সন্তুষ্ট হয়ে যাও আর জিহাদ ছেড়ে দাও, আল্লাহ তখন তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেবেন যতক্ষন তোমরা তোমাদের দীনে ফিরে না যাও”। (আবু দাউদ, সহীহ)
সত্যিই আজ জিল্লতির জীবন চেপে বসেছে আমাদের কাঁধে। যাদেরকে আল্লাহ বলেছেন “কুনতুম খাইরা উম্মাহ (তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি)” আজ তারাই চাতক পাখির মতো ডিভি লটারীর ফলাফলের দিকে চেয়ে থাকি, ইউরোপ-আমেরিকার নিরেট কোন মুসলিম বিদ্বেষী কাফিরের সাথে ইংরেজীতে কথা বলতে পারলে গর্বে বুক ফুলাই। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, আল্লাহ আমাদের আযাব থেকে আশ্রয় দিন।
প্রশ্ন হচ্ছে, এখন কি মানুষ নির্যাতিত হচ্ছেনা যেভাবে তারা আগে নির্যাতিত হচ্ছিল এবং এখন কি তারা আল্লাহর কাছে সেভাবে সাহায্য চাচ্ছেনা যেভাবে আল্লাহ কুরআনে তাদের কথা বলেছেন? অবশ্যই চাচ্ছে। তাহলে এখন কি জিহাদের প্রয়োজনীয়তা নেই নাকি এখন তাদের এই অসহায় অবস্থায় এগিয়ে আসার জন্য অনেকগুলো শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন এবং বাহ্যত এই শর্তগুলো পূরণ না হলে তাদের জন্য এগিয়ে যাওয়া হবে একটি ফিতনা? নাসিরুদ্দিন আলবানী জিহাদের প্রশ্নে অন্যতম যে শর্তের কথা বলেছেন তা হলো একক আমীর। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, কুরআনে আল্লাহ কোথাও এমন কোন শর্তের কথা বলেননি, রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কোন হাদীসেও এমন কোন শর্তের কথা তিনি বলেননি।
১৯২৪ সালে সর্বশেষ ইসলামী খিলাফাহ উসমানী খিলাফাহর পতন ঘটে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের হাতে। ফ্রান্স-বৃটেন ও পশ্চিমা অন্যান্য কাফিরদের মদদপুষ্ট আতাতুর্ক যখন খিলাফাহ্ এর পতন ঘটিয়েছিল, দেশ থেকে সে নিষিদ্ধ করেছিল হিজাব, কুরআন, হজ্জ্ব করা, আযান এবং সকল ইসলামী অনুশাসন (কয়েক দশক পরে ডানপন্থী বলে পরিচিত এক প্রেসিডেন্ট তার নির্বাচনী এজেন্ডা অনুযায়ী আযান দেয়ার অনুমতি দিয়েছিল এবং এরপর আবার যখন মাসজিদ গুলোতে আল্লাহু আকবার ধ্বনি উঠেছিল, মানুষ কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল, তার কেবল কাঁদছিল আর কাঁদছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি ‘শহীদ’ উপাধীধারী প্রেসিডেন্ট জিয়া এই আতাতুর্কের নামেই বনানীতে একটি রাস্তার নাম রেখেছে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ)। সেই উসমানী খিলাফাহ্ পতনের পর থেকে মূলতঃ মুসলিম উম্মাহ একক নেতৃত্ব বিহীন অবস্থায় আছে। এই অবস্থা কতদিন চলে তার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই আছে। তাহলে কি সেই থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত এবং তারও পরে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত জিহাদ বন্ধ থাকবে? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কি এমন কোন কথা বলেছেন? রাসুলুল্লাহ সাঃ তো বলেছেন জিহাদ চলবে কিয়ামাত পর্যন্ত, তাহলে সেটা কিভাবে?
কয়েকজন স্বনামধন্য স্কলার জিহাদের জন্য একক আমীর আবশ্যক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। একক আমির এবং জিহাদ এ প্রসঙ্গে ইসলামের ইতিহাস থেকে আমি কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
খুলাফায়ে রাশিদা এবং উমাইয়া খিলাফার পর আব্বাসীয় খিলাফাহ বহুদিন ইসলামী বিশ্বে চলেছিল। সপ্তম হিজরীতে শেষ পর্যায়ে এই খিলাফাহ ছিল নাজুক অবস্থায়। খলিফাহ ছিল নানা নেশায় আসক্ত এবং কোন ইসলামী আমিরাতের উপর তার সত্যিকার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলনা। এমনও হয়েছে যে কোন রাষ্ট্রের গভর্নর তার বিশাল বাহিনীকে নিয়ে খোদ খলিফাকে উৎখাতের চেষ্টা করেছেন। মানুষের ভেতর তখন জাহিলিয়ার বীজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাজহাব-মাজহাব দ্বন্দ্বে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতো আর মৃত্যুর মিছিল ছড়িয়ে পড়ত। কুরআনের কথা শোনার কেউ ছিলো না কিন্তু মাজহাবের ফাতওয়া প্রতিষ্ঠিত করতে স্ব স্ব আলিমরা অন্ধ হয়ে পড়েছিল। এহেন অবস্থায় আল্লাহ আযাব হিসাবে তাদের উপর এমন এক জাতিকে চাপিয়ে দিয়েছিলেন, রক্ত আর মৃত্যু যাদের কাছে ছিল ভাত আর রুটির মতো। এরা হলো চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বের তাতারী বাহিনী। মঙ্গোলিয়া থেকে এই বাহিনী মুসলিম সাম্রাজ্যে যখন ঢুকেছিল, ধ্বংসের বান তারা সাথে নিয়ে এসেছিল। যে জনপদ তারা অতিক্রম করছিল, সেখানকার সকল সক্ষম পুরুষ-কিশোরকে হত্যা, নারীদের দাস বানিয়ে শহর ও জনপদকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে যাচ্ছিল। এহেন অবস্থায় সুলতান জালালুদ্দিন তাঁর জানবাজ কিছু মুজাহিদ নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং উল্লেখযোগ্যভাবে তাতারীদের প্রতিহত করতে পেরেছিলেন। এমনি সময় তিনি বাগদাদের খলিফার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। খলিফা তাঁকে সাহায্য করেননি বরং তিনি তাতারীদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন সে এলাকা ধ্বংস করার জন্য, কারণ এই এলাকা ছিল তার কুটনৈতিক প্রতপক্ষের এলাকা। তবে সত্যপন্থী আলিম, মুজাহিদ এবং সাধারণ মানুষ জালালুদ্দিনের পক্ষে ছিলো, তবে আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্য, তাই তাকওয়াবান এই ক্ষুদ্র বাহিনী সামান্য সাহায্যের অভাবে পরাজিত হয়েছিল (পরবর্তিতে এই তাতারীরাই খলিফাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল এবং কিছুদিনের জন্য মুসলিম উম্মাহ খলিফাশূন্য ছিল)।
ইমাম ইবন তাইমিয়া এই সময়ই বর্তমান ছিলেন এবং তিনিই একমাত্র আলিম ছিলেন যিনি এমন তাতারী শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন এবং নিজেও সশস্ত্র জিহাদ করেছিলেন যে বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করতো না। শাইখ ইবন তাইমিয়াহ বর্ণনা করেছেন, “যারা ঈমানের দুটি বিষয়ের উপর সাক্ষ্য দেয় (আশ শাহাদাতাইন) তারপরও ইসলামের শারিয়া ছাড়া অন্য বিধান দিয়ে শাসন করে, সেই (তাতারদের বিরুদ্ধে) জিহাদরত গোষ্ঠীরাও আত-তাইফাতুল মানসুরায় (সাহায্যপ্রাপ্ত দল) অন্তর্ভুক্ত হবার অধিক উপযুক্ত। যেমন (তিনি উল্লেখ করেন) শাম এবং মিশরের তাইফা এবং তাদের মত অন্যান্যরা যারা এ সময় দীন ইসলামের জন্য জিহাদরত যোদ্ধা, এবং আত তাইফা আল মান্সুরাতে অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য তারাই সবচেয়ে উপযুক্ত, যা রাসুল সাঃ প্রায়ই তাঁর বর্ণনাতে তুলে ধরতেন, যা বিশুদ্ধ এবং প্রায়ই বর্ণিত হতো, এবং তিনি বর্ণনা করতেন, “আমার উম্মাতের মধ্যে একটি দল যারা সত্যের উপর অবিচল থাকবে, (এ থেকে) তারা কখনই বিরত হবেনা। যার তাদের সাথে প্রতারণা করবে বা তাদের বিরুদ্ধাচারণ করবে, তারা তাদের কোন ক্ষতিই করতে পারবেনা যতক্ষন শেষ সময় না আসবে। এবং মুসলিমের বর্ণনাতে এসেছে পশ্চিমের গোষ্ঠী কখনওই থামবেনা” (আল মাজমু আল ফাতওয়া)। কিন্তু তখনকার উম্মাহর অধিকাংশ আলিম তার বিরোধিতা করেছিল কিন্তু সত্য ছিল তাঁর পক্ষে। তখন উম্মাহ দেখছিল এমন একটি অবস্থা যেখানে খলিফা নেই কিন্তু জিহাদ বন্ধ হয়নি।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যখন তাঁর সামান্য সরঞ্জাম কিন্তু অদম্য মনোবল দ্বারা ক্রুসেডার কাফিরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তখন মিশরে চলছিল শিয়া ফাতিমীয় খিলাফাহ। খালিফার কাছ থেকে চেয়েও কোন সাহায্য তিনি পাননি, অধিকন্তু খলিফার গুপ্তচর এবং গুপ্ত ঘাতকের দল তাঁকে হত্যা করতে অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাঁর সাথে ছিলেন যেহেতু আল্লাহ নিজেই মুমিনদের সাহায্য করার কথা বলেছেন। শেষ পর্যন্ত সালাহউদ্দীন সেই ফাতিমিয় খিলাফা বিলুপ্ত করে দেন যা উম্মাহর বিরুদ্ধে কাজ করছিল এবং কাফিরদের সাহায্য করছিল। তিনি নিজেকে খলিফা দাবী না করে বাগদাদের ক্ষয়িষ্ণু আব্বাসীয় খিলাফার সাথে নিজেকে একাত্ম করেছিলেন। তবে তার পরও বিপদ কিংবা প্রয়োজন কোন সময়েই বাগদাদের খলিফা সালাহউদ্দিনকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেননি। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে বিজয় দিয়েছিলেন, যেভাবে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন কুরআনে।
ঐতিহাসিক ইবন আসীর স্পেন প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন, আল আন্দালুস চারটি রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। প্রতি রাষ্ট্রপ্রধানই নিজেকে আমিরুল মুমিনীন বলে দাবী করতেন। তিনি বলেন এ ঘটনাটি কৌতুকে পরিণত হয়েছিল। সে সময় উম্মাহ হয়ত বর্তমানের চেয়ে বেশী বিভক্ত ছিল।
কিন্তু তখনও মুসলিমরা জিহাদের জন্য একক আমিরের জন্য বসে ছিলোনা। যে সকল আলিম শাসকদের সাথে দীনের ব্যাপারে আপোষ করেননি তারা বসে ছিলেননা। আমরা দেখতে পাই খৃস্টান সম্রাট আলফানসো যখন স্পেনের মুসলিম শাসকদের একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে সাহায্য করে বিনা যুদ্ধে সমস্ত স্পেন থেকে মুসলিম উৎখাতের ষড়যন্ত্রে নেমেছিল আর শাসক দলের আলিমরা নিজ নিজ শাসকদের পক্ষে ফাতওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছিল, সত্যপন্থী আলিমদের একটি দল তখন দেশের দূর-দূরান্ত থেকে এসে গোপন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জাতির এই দুঃসময়ে আলফানসোর বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ের। দেশের কোন শাসককে এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেবার যোগ্য তারা পায়নি। সে সময় তারা মহাসাগরের ওপাড়ে মরোক্কতে দুনিয়া ত্যাগি মুসলিম মুজাহিদ ইউসুফ বিন তাশফিনের শরণাপন্ন হয়েছিল। নিজ দেশের ময়দানে ভীষণ প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অসহায় সে মানুষদের ডাক তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্পেনে যাবার। প্রতিশ্রুত দিনে স্পেনের উপকূলে আলিম সমাজের সে সত্যপন্থী দলটি অপেক্ষা করছিলো। যখন ইউসুফের জাহাজের নিশানা তারা দেখতে পেয়েছিলেন, আল্লাহর কাছে তাঁরা সিজদায় পড়ে পড়ে কাঁদছিলেন। আল্লাহ ইউসুফকে পাঠিয়েছিলেন কাফিরদের উপর এক ভায়াবহ সাইক্লোন রূপে। তাঁর পর্বত প্রমাণ দৃঢ়তার সামনে আলফানসোর বিশাল বাহিনী উড়ে গিয়েছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ককেশাস অঞ্চলের দাগেস্তান, চেচনিয়া আর ইঙ্গুটিশিয়ায় রাশিয়ান জারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন ইমাম শামিল নামের এক অকুতভয় মুসলিম। অত্যাধুনিক জার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্মরণীয় সব বিজয় তিনি লাভ করেছিলেন। তখন ছিল উসমানিয়া খিলাফাহ। ইমাম শামিল কয়েকবার দুত পাঠিয়ে খলিফার কাছে সাহায্য চান কিন্তু দুর্বলতা ও কুটনৈতিক কারণে খলিফা ইমাম শামিলের সাহায্যে কাউকে পাঠাননি।
আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।
এ পর্যায়ে ইসলামের ইতিহাসে জিহাদ ও আলিম সমাজের ভুমিকা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
খুলাফায়ে রাশিদার পর মুসলিম বিশ্বে উমাইয়া শাসন শুরু হয়েছিল। যদিও উমাইয়া শাসনকালে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল এবং বিশ্বের আর সকল স্থান থেকে মুসলিম ভূমিই ছিল আদল-ইনসাফের শ্রেষ্ঠ স্থান কিন্তু তখন থেকে মুসলিম বিশ্ব শাসন ব্যবস্থায় নানা জুলুম এবং পক্ষপাতিত্ব দেখতে শুরু করেছিল। এহেন অবস্থায় সত্যিকার আলিম সমাজ রাষ্ট্রের জুলুমের সাথে কোন আপোষ করেনি এবং যার ফলশ্রুতিতে সাহাবাদের উপর অত্যাচার হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে অসংখ্য মানুষ। সে সময় থেকেই আলিমদের মধ্যকার একটি অংশ রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা, আর্থিক লাভ বা ক্ষমতার বলয়ে থেকে লাভবান হবার জন্য শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে ফাতওয়া দেয়ে শুরু করেছিল। তারা ইসলামের সকল বিষয়ে ছিল সোচ্চার কেবল শাসক এবং শাসনের ব্যাপারগুলোতে ছিল নিরব। ধীরে ধীরে এই শ্রেণীর আলিম সমাজ শাসকদের পক্ষাবলম্বন বা নিজেদের সামান্য সুবিধার জন্য দীনের উপর আরো ব্যাপকভাবে তাদের থাবা বিস্তার করেছিল। নিজেদের সুবিধামত দীনের কোন কিছুর উপর তারা জোর দিত আবার নিজেদের সুবিধা বুঝে দীনের কোন অংশ গোপন করত বা ভুল ফাতওয়া দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করত।
তবে যারা ছিল সত্যিকার আলিম ও ঈলম অনুযায়ী আমল করা ব্যক্তি, তারা কখনও আপোষ করেনি। শাসক কিংবা খোদ খলিফার মুখের সামনে তারা সত্য প্রকাশ করতেও পিছপা হতোনা। তারা নিজেদের সরকারী পদ থেকে দূরে রাখত অথবা সরকারী পদে থাকলেও সত্য গোপন করতনা। এজন্যই আমরা দেখি জাবির বিন আব্দুল্লাহর (রাঃ) শরীরে সীল মেরে দেয়া হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল সাঈদ বিন মুসায়্যিব এর মত বিখ্যাত তাবেয়ি, কারাগারের গোপন কুঠুরীতে ধুঁকে ধুঁকে মরেছিল আবু হানিফা সহ আরো অসংখ্য আলিম।
ইসলামের ইতিহাসে সময় গড়ানোর সঙ্গে এক শ্রেণীর আলিমদের এই পদস্খলন বেড়েছে। আমরা আগে সালাহউদ্দীন আইয়্যুবী সম্বন্ধে আলোচনা করেছি যিনি ছিলেন এই শ্রেণীর আলিম সমাজের নিষ্ঠুর শিকার। তাঁর সময় মুসলিম উম্মাহ ছিল শতধা বিভক্ত। সে সময় সম্মিলিত খৃস্টান বাহিনী ধীরে ধীরে মুসলিম ভূমিগুলো দখল করছিল। কোন মুসলিম শাসক তো তাদের বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি বরং মুনাফিকীর চরম সীমায় পৌঁছে তারা গোপনে কুফফারদের সাহায্য করছিল। এমনি সময় সালাহউদ্দীন আইয়্যুবী অল্প সংখ্যক জানবাজ মুজাহিদ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সম্মিলিত ক্রুসেডেরদের বিরুদ্ধে। তাঁর সাহায্যের জন্য কোন মুসলিম শাসক এগিয়ে আসেনি বরং চরম বিরোধিতা করে তারা তার বিরুদ্ধেই যুদ্ধের ডাক দিয়েছিল। আল্লাহ তাদের পরাজিত করেছিলেন এবং সালাহউদ্দীনের জন্য বিজয় নির্ধারিত করেছিলেন। সে সময় এক পর্যায়ে জেরুজালেম রক্ষা করা আর মুসলিমদের পরাজিত করার জন্য পোপের আহবানে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানীর সম্মিলিত বাহিনী এগিয়ে আসে। এমনকি সকল দেশের রাজারা স্বয়ং ফিলিস্তিনে গিয়ে যুদ্ধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। এই সম্মিলিত বাহিনীর সংখ্যা ছিলো অগণিত। সাধারণ কোন মানুষ এই সংখ্যা শুনলে মুর্ছা যেত। এক জার্মানীর রাজা ফ্রেডরিক বার্বারোসা তিন লক্ষ সৈন্য নিয়ে আগিয়ে আসেন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, সকল যুদ্ধ জাহাজ, বাণিজ্যিক জাহাজ ব্যবহার করেও এই বিপুল সেনাদল বহন সম্ভব ছিল না। জার্মানীর রাজা ফ্রেডরিক তখন তাঁর তিন লক্ষ সেনা নিয়ে পায়ে হেঁটে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের সংখ্যা ছিল পংগপালের মত। শহর জনপদ দাপিয়ে তারা এগিয়ে আসছিল।
সালাহউদ্দীনের ক্রমাগত বিজয়ে এবং জিহাদের প্রতি ভালবাসা থেকে সে সময়কার অনেক আলিম তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। তবে সম্মিলিত ক্রুসেডর বাহিনীর এই ভয়ংকর অগ্রযাত্রার কথা শুনে অনেক আলিম পিছু হটে যান। ঐতিহাসিক ইবন আসীর বর্ণনা করেছেন, সংখ্যাধিক্যের কারণে কিছু সংখ্যক আলিম পিছু হটে গিয়েছিলেন আর আলিম হওয়ার কারণে তারা ওজর খুঁজতে দলীলের শরণাপন্ন হলেন। তারা ভালো করেই জানতেন কিভাবে আয়াত বা হাদীস বিকৃত করে তা শরীয়া অনুমদিত বলে প্রমাণ করা যায়। তারা এই বলে ফাতওয়া দিল যে, এখন জিহাদে যাওয়া হিকমার নয়, সালাহউদ্দীন একজন অবুঝ, আমরা তাকে বারণ করা সত্বেও সে এই জিহাদে গিয়েছে কিংবা সালাহউদ্দীনের ঈলম নেই কিংবা সে ঠিকমত আরবী জানেনা, সুতরাং ফাতওয়া জারি করে এত শক্তিধর শত্রুর মোকাবেলায় নেমে উম্মাতকে সমস্যায় ফেলার অধিকার তার নেই। এই বলে তারা তার সঙ্গ ত্যাগ করেছিল এবং কতক লোক তাদের ফাতওয়ায় সরে গিয়েছিল। কিন্তু শেষে কি হয়েছিল? আল্লাহ তাঁকে মানব ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজয় দিয়েছিলেন এবং তাঁর দ্বারা আবার জেরুজালেম এবং আল আকসা মুসলিমদের অধিকারে দিয়েছিলেন যে ঘটনার পরোক্ষ ইঙ্গিত কুরআনে রয়েছে।
ইবন তাইমিয়াহ যখন ইসলামে মাজহাব ও দলাদলীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, সে দেশের অধিকাংশ আলিম তাঁকে বাতিল বলে দিয়েছিল। নামে মুসলিম তাতারী শাসকের বিরুদ্ধে যখন তিনি জিহাদে গিয়েছিলেন আর মানুষকে এর জন্য ডাকছিলেন তখন অনেক আলিম তাঁকে কাফির ফাতওয়া দিয়েছিল।
নিকট অতীতে কমিউনিস্ট রাশিয়ার শাসকরা যখন ইমাম বুখারীর স্মৃতিবিজড়িত বুখারা (যা ছিল মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান স্থান) আক্রমন করতে আসছিল, সেখানকার আলিমদের একটি দল জিহাদের মাধ্যমে তাদের রুখে দাঁড়াতে মত দিয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ আলিম মত দিয়েছিল যে, তারা অন্যদের মত নায়, তারা যে সাম্যের কথা বলে তা ইসলামের সাথে অনেক সামঞ্জস্যপূর্ণ, সুতরাং তাদের সাথে আপোষ করেই তাদের এদেশে আসতে দেয়া সঙ্গত হবে। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় দলের মতই টিকে গিয়েছিল। কিন্তু আফসোস, কম্যুনিস্ট বাহিনী বিনা বাধায় বুখারায় ঢুকে সকল মাদ্রাসাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, তারা কুরআন সহ সকল কিতাব পুড়িয়ে দিয়েছিল, সকল আলিমদের পাইকারী হারে হত্যা করেছিল, তারাও রক্ষা পায়নি যারা তাদের পক্ষাবলম্বন করেছিল।
সকল যুগেই জিহাদের কথা আসলে এভাবেই একদল আলিম নানা অজুহাত দেখাতে চেয়েছে। আল্লাহ আমাদের সামনে যে সকল দলীল প্রমাণ রেখে দিয়েছেন এর পরও আমাদের কোন অজুহাত দেয়ার সুযোগ থাকবেনা। আমাদের মনে রাখতে হবে কোন মানুষের সকল কথাই ঠিক হতে পারেনা। যদি আল্লাহ আর তার রাসুলের কোন কথা তার বিপরীতে যায় তাহলে সে যত বড় স্কলারই হোকনা কেন আমরা তার কথা মেনে নেবনা।
তবে এ কথাও সত্যি, যারা জিহাদে রত আছে বা মুজাহিদ, তাদেরও ভুল হবে। আল্লাহর পথে যারা জিহাদ করবে তারা আমাদেরই মত মানুষ, আকাশ থেকে নেমে আসা কোন ফেরেশতা নন। এদের অপরাধ থাকবে, ভুল থাকবে। এদের ইজতিহাদে ভুল হতে পারে বা স্ট্র্যাটেজিতেও ভুল থাকতে পারে, এমনকি এই পথে নবীরাও ভুল করেছে বলে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন। আল্লাহ বলেন-
“আর নবীদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধ করেছে, তাদের সাথে ছিল বহু আল্লাহওয়ালা। তারা সাহস হারায়নি আল্লাহর পথে তাদের উপর আপতিত বিপদ-আপদের কারণে, আর না তারা দুর্বল হয়েছে, না তারা দমে গেছে। আল্লাহ এরূপ দৃঢ়পদ ধৈর্য্যশীলদের ভালোবাসেন। আর তাদের কোন কথা ছিল না এ ছাড়াঃ ও আমাদের প্রতিপালক, আমাদের অপরাধ মার্জনা করে দিন আর আমাদের কাজে যে বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে তাও (মার্জনা করুন)। আর আমাদের দৃঢ়পদ রাখুন এবং কাফিরদের মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন”। – সুরা আল ইমরানঃ ১৪৬
কিন্তু তাদের কোন ভুলের জন্য বর্তমানের গোটা জিহাদই ভুল বলে বিবেচিত হবার নয়। তাদের প্রতি বিদ্বেষ বশতঃ গোটা জিহাদকে ফিতনা বলে দেয়াটা হবে বড় অন্যায়। পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, আজ আমরা কাফির নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার খবরে বড় বেশী প্রভাবিত হয়ে পড়ছি। আমরা ভুলে গেছি আল্লাহর সেই আয়াত যেখানে তিনি বলেছেন “যদি কোন ফাসিক ব্যক্তি কোন সংবাদ তোমাদের কাছে নিয়ে আসে তোমরা যাচাই বাছাই করে নাও”। ‘আফগানিস্তানে আত্মঘাতী বোমায় সাধারণ মানুষ নিহত’ এ রকম খবর যখন আমরা পড়ব তখন অবশ্যই যাচাই করে নেব সত্যিই এখানে কি ঘটেছে বা কারা নিহত হয়েছে। ইন্টারনেটের এই যুগে যাচাই করাটা আমদের আঙ্গুলের ডগায় এসে বসে আছে। যখন পত্রিকায় বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় জিহাদের ফলে নিহত কোন ব্যক্তির ছোট্ট শিশুটি নিয়ে “বাবার পথ চেয়ে এখনো বসে আছে শিশুটি”-এমন ধরণের মর্মস্পর্শী সংবাদ বের হয়, তখন আমাদের যেন এটাও মনে থাকে যে, কয়েক লক্ষ মুসলিম শিশু এভাবেই বাবাদের পথ চেয়ে আফগান, চেচনিয়া, কাশ্মির, বসনিয়া, ফিলিস্তিন, সুদান, ইয়েমেন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, সোমালিয়াতে বসে আছে।
বর্তমান যুগেও জিহাদের বিরুদ্ধে বলার জন্য আলিম সমাজের কমতি নেই। ভারী ভারী নামের আলিমগন আজ রাষ্ট্রীয় পুলিশে পাহারায়, এসি কনফারেন্স রুমে বসে তাদের বিরুদ্ধে বলে চলেছে, যারা আল্লাহর নির্যাতিত বান্দাদের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেদের সকল সুখ আর সম্পদ বিসর্জন দিয়ে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মাসজিদুল হারাম আর মদীনা মুনাওয়ারায় রাষ্ট্রীয় রাজকীয় পুলিশের কর্ডনে, মিনিস্টার প্রোটকল নিয়ে, হজ্জ্বের সময় আরাফায় নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের চোখে বড় আলিম হলেও আল্লাহর কাছে সেই লোকটিই শ্রেষ্ঠ, যিনি রুক্ষ ময়দানে মৃত্যু মাথায় নিয়ে জিহাদে রত আছে। আল্লাহ বলেছেন,
“তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো আর ক্বাবা ঘরকে আবাদ করাকে সেই ব্যক্তির কাজের সমপর্যায়ের বলে মনে কর, যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, আখিরাতের উপর ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে? এরা কখনও সমান নয়, আল্লাহ কখনও যালিমদের সঠিক পথ দেখাননা। যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে তাদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে তাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সবার চেয়ে বড় এবং এ ধরণের লোকেরাই (পরিণামে) সফলকাম হবে ” – সুরা তাওবাঃ ১৯-২০।
তারা জিহাদ না করতে পারে এবং এটা ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা হতে পারে, কিন্তু এর বিরুদ্ধে বলার ভয়ংকর চর্চায় আজ তারা ব্যস্ত। কিন্তু যখন চেচেন কোন বোনের সতীত্ব তার মা-বাবার সামনে ছিনিয়ে নেয়া হয় তখন তাদের মুখ দিয়ে কোন ফাতওয়া বের হয়না, যখন একটি বোমা দিয়ে ইয়েমেনের কোন গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয় তখন এরা কোন ফাতওয়া দেয়না, যখন ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়ে কয়েক হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হয় এদের মুখ থেকে এর বিরুদ্ধে একটি কথাও বের হয়না। নিজ চাকরি হারানোর ভয় এবং শাসকের ভয়ে তারা আল্লহর আয়াতকে বিক্রি করে দিয়েছে। এরা এবং এদের অনুসারীদের অনেকেই বলে থাকে ‘সত্যিকার’ জিহাদের ডাক যেদিন আসবে সেদিন তারা সামনের সারিতেই থাকবে। তাহলে কি এর জন্য কোন প্রস্তুতি তারা নিচ্ছে? তবে যে আল্লাহ বলেছেন- “সত্যিই যদি তারা (আল্লাহর প্রথে জিহাদে) বের হতে চাইত, তারা এর জন্য কিছু না কিছু প্রস্তুতি নিত” –সুরা তাওবাঃ ৪৬
আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।
এখন সময় নিজেদের দিকে তাকানোর। যেই মহাপরাক্রমশালী সত্ত্বা আমাদের অন্তরের সূক্ষ্মতম ব্যাপারের খবরও রাখেন, তাঁকে উপস্থিত জেনেই আমাদের দেখে নিতে হবে আমরা এই আয়াতের ভেতর পড়ে যাচ্ছি কিনা-
“(হে নবী) বল- যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তানাদি, তোমাদের ভাই, তোমাদের পরিবার পরিজন, তোমাদের বংশ-গোত্র, তোমাদের ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ এবং তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যা অচল হয়ে যাবে বলে তোমরা আশংকা কর, তোমাদের বাড়ী-ঘর সমূহ যা তোমরা একান্তভাবে কামনা কর- এগুলো যদি আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং তাঁর সাথে জিহাদ করা থেকে তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় তাহলে (আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাবের) ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আল্লাহ কখনও ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দান করেন না”। – সুরা তাওবাঃ ২৪।
এবং রাসুলুল্লাহ সাঃ এর হাদিসে বর্ণিত এই দলে আমরা পড়ি কিনা-
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মারা গেল যে, সে কখনও জিহাদে অংশগ্রহণ করেনি, তার অন্তরে কোনদিন জিহাদের সংকল্প বা নিয়ত ছিলো না, তবে সে যেন মুনাফিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলো”। -সহীহ মুসলিম
আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, তাঁদের পথ আমাদের ভাগ্যে লিখে দিন যাদের উপর তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাদের পথ থেকে আমাদের আশ্রয় দিন যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।
বিষয়: বিবিধ
৩৫৮৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন