শবে বরাত সম্পর্কে কিছু কথা

লিখেছেন লিখেছেন তিতুমীর সাফকাত ২০ জুন, ২০১৩, ০৫:৫৯:০৭ বিকাল

শুরুতে শবে বরাত সম্পর্কে এক সহিহ হাদিস উল্লেখ করা প্রয়োজন । এবং কেন এই দিনে অন্যান্য দিন থেকে আলাদা কিছু সওয়াবের আশায় করা বিদআত হবে তাও স্পষ্ট হওয়া জরুরি ।

শুরুতে শবে বরাতের শাব্দিক অর্থ জানা প্রয়োজন । চলুন এর শাব্দিক অর্থ এবং শরিয়ত অনুযায়ী এর অর্থটি জানি ।

--

‘শব’ ফারসি শব্দ। অর্থ রাত বা রজনী। বরাত শব্দটিও মূলে ফারসি। অর্থ ভাগ্য। দু’শব্দের একত্রে অর্থ হবে, ভাগ্য-রজনী। বরাত শব্দটি আরবি ভেবে অনেকেই ভুল করে থাকেন। কারণ ‘বরাত’ বলতে আরবি ভাষায় কোন শব্দ নেই।

যদি বরাত শব্দটি আরবি বারা’আত শব্দের অপভ্রংশ ধরা হয় তবে তার অর্থ হবে— সম্পর্কচ্ছেদ বা বিমুক্তিকরণ। কিন্তু কয়েকটি কারণে এ অর্থটি এখানে অগ্রাহ্য, মেনে নেয়া যায় না-

১. আগের শব্দটি ফারসি হওয়ায় ‘বরাত’ শব্দটিও ফারসি হবে, এটাই স্বাভাবিক

২. শা’বানের মধ্যরজনীকে আরবি ভাষার দীর্ঘ পরম্পরায় কেউই বারা’আতের রাত্রি হিসাবে আখ্যা দেননি।

৩. রমযান মাসের লাইলাতুল ক্বাদরকে কেউ-কেউ লাইলাতুল বারা’আত হিসাবে নামকরণ করেছেন, শা‘বানের মধ্য রাত্রিকে নয়।

শবে বরাত সম্পর্কিত দুর্বল হাদিস --

আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: এক রাতে আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে খুঁজে না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম, আমি তাকে বাকী গোরস্তানে পেলাম। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন: ‘তুমি কি মনে কর, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর জুলুম করবেন?’ আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অপর কোন স্ত্রীর নিকট চলে গিয়েছেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: ‘মহান আল্লাহ তা’লা শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন এবং কালব গোত্রের ছাগলের পালের পশমের চেয়ে বেশী লোকদের ক্ষমা করেন।

হাদীসটি ইমাম আহমাদ তার মুসনাদে বর্ণনা করেন (৬/২৩৮), তিরমিযি তার সুনানে (২/১২১,১২২) বর্ণনা করে বলেন, এ হাদীসটিকে ইমাম বুখারী দুর্বল বলতে শুনেছি। অনুরূপভাবে হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৯) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির সনদ দুর্বল বলে সমস্ত মুহাদ্দিসগণ একমত।

শবে বরাত সম্পর্কিত হাদিস --

আবু মূসা আল আশ’আরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা‘আলা শাবানের মধ্যরাত্রিতে আগমণ করে, মুশরিক ও ঝগড়ায় লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যতীত, তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে ক্ষমা করে দেন। হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৫৫, হাদীস নং ১৩৯০),এবং তাবরানী তার মু’জামুল কাবীর (২০/১০৭,১০৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

আল্লামা বূছীরি বলেন: ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীসটির সনদ দুর্বল। তাবরানী বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে আল্লামা হাইসামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) মাজমা‘ আয যাওয়ায়েদ (৮/৬৫) গ্রন্থে বলেনঃ ত্বাবরানী বর্ণিত হাদীসটির সনদের সমস্ত বর্ণনাকারী শক্তিশালী। হাদীসটি ইবনে হিব্বানও তার সহীহতে বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে দেখুন, মাওয়ারেদুজ জাম‘আন, হাদীস নং (১৯৮০), পৃঃ (৪৮৬)।

শবে বরাত সম্পর্কিত জাল তথা বানোওাট হাদিস --

আলী ইবনে আবী তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “যখন শা‘বানের মধ্যরাত্রি আসবে তখন তোমরা সে রাতের কিয়াম তথা রাতভর নামায পড়বে, আর সে দিনের রোযা রাখবে; কেননা সে দিন সুর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন: ক্ষমা চাওয়ার কেউ কি আছে যাকে আমি ক্ষমা করব। রিযিক চাওয়ার কেউ কি আছে যাকে আমি রিযিক দেব। সমস্যাগ্রস্ত কেউ কি আছে যে আমার কাছে পরিত্রাণ কামনা করবে আর আমি তাকে উদ্ধার করব। এমন এমন কেউ কি আছে? এমন এমন কেউ কি আছে? ফজর পর্যন্ত তিনি এভাবে বলতে থাকেন”।

হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮) বর্ণনা করেছেন। আল্লামা বূছীরি (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তার যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ (২/১০) গ্রন্থে বলেন, হাদীসটির বর্ণনাকারীদের মধ্যে ইবনে আবি সুবরাহ রয়েছেন যিনি হাদীস বানাতেন। তাই হাদীসটি বানোয়াট।

সবচেয়ে জরুরি কথা --

আল্লাহ তা‘আলা নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানাতে থাকেন — হাদীসদ্বয়ে এ বক্তব্যই উপস্থাপিত হয়েছে। মুলত সহীহ হাদীসে সুস্পষ্ট এসেছে যে, “আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষাংশে – শেষ তৃতীয়াংশে- নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হয়ে আহবান জানাতে থাকেন ‘এমন কেউ কি আছে যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দেব? এমন কেউ কি আছে যে আমার কাছে কিছু চাইবে আর আমি তাকে দেব? আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দেব?” [বুখারী, হাদীস নং ১১৪৫, মুসলিম হাদীস নং ৭৫৮]

এটি কেবল শবে বরাতেই নয় বরং প্রতি রাতে আল্লাহ তা'আলা নিকটবর্তী আসমানে আসেন ।

(জানুন শেয়ার করুন) --

ইসলাম একটি শক্ত দ্বীন । তাই এর বিভিন্ন আমলের দলিলও হতে হবে শক্ত মজবুত. কারণ এই ধর্মটি আল্লাহ হতে প্রেরিত যাতে কোনো সন্দেহ নাই ..

যদি নফল ইবাদতই হয়ে থাকে তাহলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ কি এই দিনে প্রতি দিন থেকে আলাদা কিছু করেছেন এমন কোনো হাদিস দেখাতে পারবেন? আর যদি দেখাতে নাই পারেন তাহলে এই দিনে অতিরিক্ত কিছু করা যা আপনি অন্যান্য দিন করেন না তবে বিশেষ ভাবে এই দিনের জন্য করেন তাহলে তা হবে বিদাআত।

কুরআন তিলওয়াত কেন সুধুই এই দিনেই করব? !!! কুরআন তো জীবন বিধান যা প্রতিদিন পালন করা উচিত।। কেন শুধু এই দিনেই নফল সালাত পড়ব ? যদি পড়তেই হয় তবে প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে আদায় করব ।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন "রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন - "আমার দ্বীণে যা নতুন কিছু যোগ করা হবে তা ই বিদ'আত , আর সকল বিদ'আত ই ভ্রষ্টতা"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন

“যে ব্যক্তি দ্বীনে এমন কিছু শুরু করল যা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে তা প্রত্যখ্যাত হবে”.

[বুখারি ২৬৯৭, মুসলিম ১৭১৮]

তিনি আরো বলেনঃ

“সর্বাপেক্ষা উত্তম বানী হল আল্লাহর, সর্বাপেক্ষা উত্তম পথনির্দেশ হল তাঁর রসুলের আর সর্বাপেক্ষা খারাপ কাজ হল নব উদ্ভাবিত বিষয় গুলো (বিদাত); সকল বিদাত ই পথভ্রষ্টতা” .

মুসলিম ৮৬৭ এবং

“সকল ভ্রষ্টতা জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়”

আন নাসাঈ ১৪৮৭

তাছাড়া আরেকটি হাদিসে আছেঃ

“যখন কোন বিষয়ে মতপার্থক্যের সম্মুখীন হবে তখন আমার সুন্নাহর অনুসরন করবে। সকল প্রকার নব উদ্ভাবিত জিনিস থেকে দূরে থাকবে, কেননা এগুলোই হচ্ছে বিদাত। সকল বিদাত ই ভ্রষ্টতা আর ভ্রষ্টতা শুধু জাহান্নামের আগুনের অভিমুখী করে”

আহমদ ১২৬, আবু দাউদ ৪৬০৭, তিরমিযি ২৬৭৬, ইবন মাজাহ ৪২, সহিহ আল জামে ২৫৪৬.

শেষ কথা শবে বরাত তারপর শবে মেরাজ এ রোজা রাখা ভিন্ন রকম তথা আলাদা কোনো নামাজ পড়া এমন কোনো সহিহ দলিল নেই.. আর মনে রাখবেন ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যা আল্লাহ হতে প্রেরিত.. তাই প্রতিটি আমলের দলিলও হতে হবে শক্ত মজবুত. কারণ এই ধর্মটি আল্লাহ হতে প্রেরিত যাতে কোনো সন্দেহ নাই .. এর জন্য কয়েকটি হাদিস জানা প্রয়োজন --

সহীহ মুসলিমে আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা জুম‘আর রাত্রিকে অন্যান্য রাত থেকে ক্বিয়াম/ নামাযের জন্য সুনির্দিষ্ট করে নিও না, আর জুম‘আর দিনকেও অন্যান্য দিনের থেকে আলাদা করে রোযার জন্য সুনির্দিষ্ট করে নিও না, তবে যদি কারো রোযার দিনে সে দিন ঘটনাচক্রে এসে যায় সেটা ভিন্ন কথা”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৪৪, ১৪৮)।. যদি কোন রাতকে ইবাদতের জন্য সুনির্দিষ্ট করা জায়েজ হতো তাহলে অবশ্যই ‘আর রাতকে ইবাদতের জন্য বিশেষভাবে সুনির্দিষ্ট করা জায়েয হতো; কেননা জুম‘আর দিনের ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে যে, “সুর্য যে দিনগুলোতে উদিত হয় তম্মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ট দিন, জুম‘আর দিন”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৮৪)।. সুতরাং যেহেতু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুম‘আর দিনকে বিশেষভাবে ক্বিয়াম/নামাযের জন্য সুনির্দিষ্ট করা থেকে নিষেধ করেছেন সেহেতু অন্যান্য রাতগুলোতে অবশ্যই ইবাদতের জন্য সুনির্দিষ্ট করে নেয়া জায়েয হবে না। তবে যদি কোন রাত্রের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন দলীল এসে যায় তবে সেটা ভিন্ন কথা। আর যেহেতু লাইলাতুল ক্বাদর এবং রমযানের রাতের ক্বিয়াম/নামায পড়া জায়েয যেহেতু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ রাতগুলোর ব্যাপারে স্পষ্ট হাদীস এসেছে এবং কুরআনেও এর গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।

এই দিনে রোজা ?>

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বহু সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি শা‘বান মাসে সবচেয়ে বেশী রোযা রাখতেন। (এর জন্য দেখুনঃ বুখারী, হাদীস নং ১৯৬৯, ১৯৭০, মুসলিম, হাদীস নং ১১৫৬, ১১৬১, মুসনাদে আহমাদ ৬/১৮৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৩১, সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস নং ২০৭৭, সুনানে তিরমিঝি, হাদীস নং ৬৫৭)।

সে হিসাবে যদি কেউ শা‘বান মাসে রোযা রাখেন তবে তা হবে সুন্নাত। শাবান মাসের শেষ দিন ছাড়া বাকী যে কোন দিন রোযা রাখা জায়েয বা সওয়াবের কাজ। তবে রোজা রাখার সময় মনে করতে হবে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু শা‘বান মাসে রোজা রেখেছিলেন তাকে অনুসরন করে রোযা রাখা হচ্ছে।

অথবা যদি কারও আইয়ামে বিদের নফল রোযা তথা মাসের ১৩,১৪,১৫ এ তিনদিন রোযা রাখার নিয়ম থাকে তিনিও রোযা রাখতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র শা‘বানের পনের তারিখ রোযা রাখা বিদ‘আত হবে। কারণ শরীয়তে এ রোযার কোন ভিত্তি নেই।

শেষ কথা --

যেহেতু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে কোন হাদিস আসে নি কোন আলাদা আমল করার তাহলে আমরা কেন করব?? তাহলে আমরা কি অধিক বিদ্বান হয়ে গেলাম? নাউজুবিল্লাহ... আল্লাহ্‌ আমাদের সকলকেই সহিহ হাদিসের উপর আমল করার তৌফিক দান করুন আমীন।। আল্লাহ্‌ আমাদের সকলকেই বিদআত থেকে বেচে থাকার তৌফিক দান করুক আমীন।। আল্লাহ্‌ আমাদের সকলকেই সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলার তৌফিক দান করুক আমীন।। কারন সকল বিদআতই ভ্রষ্টতা।।

বিষয়: বিবিধ

৩১২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File