সাইয়্যেদ কুতুব হাসানুল বান্না

লিখেছেন লিখেছেন তিতুমীর সাফকাত ১০ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:২৪:১৭ দুপুর

১৯০৬ খৃস্টাব্দে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র শায়খ হাসানুল বান্না মাহমুদিয়ায় এক ইসলামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শায়খ আহমদ আবদুর রহমান ছিলেন উঁচু স্তরের আলেম, একদিকে কুরআনে হাফেজ অন্যদিকে এলমে হাদিস ও ফেকাহ শাস্ত্রে গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী। শায়খ আবদুর রহমান শিশু পুত্র হাসানকে শৈশবে কুরআন হেফজ করান এবং দীনি ইলম শেখার প্রতি আগ্রহ পয়দা করেন। ঘরেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়, পাশাপাশি তাকে ভর্তি করে দেয়া হয় ইসমাঈলিয়ায় অবস্থিত আররাশাদ আদদীনিয়া বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি প্রাথমিকভাবেদীনি তালিম ও তরবিয়ত লাভ করেন। পরে ১৪ বছর বয়সে তাকে ভর্তি করে দেয়া হয় মানহুরের টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে, এরপরে তাকে এক শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষকতার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। অল্পদিন দায়িত্ব পালনের পরে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে মিসরের দারুল উলুম বর্তমান কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯২৭ সালে হাসানুল বান্না দারুল উলুম থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইসমাঈলিয়ার আমীরিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। ১৯৩৩ সালে তাকে ইসমাঈলিয়া থেকে কায়রোয় বদলি করা হয়। এরপর থেকে তিনি কায়রোতেই বসবাস করেন, ১৯৪৬ সালে চাকরি থেকে ইস্তেফা দিয়ে একান্ত মনে নিজকে দাওয়াতী কাজে এবং সংগঠন গড়ে তুলতে নিয়োজিত করেন।

ঈমানী চেতনায় বলিয়ান হাসানুল বান্না যখন আররাশাদুদ দীনিয়ার ছাত্র তখন সেখানকার ছাত্ররা জমিয়তে আখলাকে আদাবিয়া নামে একটি সংসদ গঠন করে এবং হাসানুল বান্নাকে এর সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এ সংগঠনটি চিঠিপত্রের মাধ্যমে মানুষকে সৎ কাজের শিক্ষা দিত।

দামানহুরের টিচার্স স্কুলে যখন হাসানুল বান্না পৌঁছেন তখন সেখানে তিনি তরীকায়ে হিসাফিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট হন। তরীকায়ে হিসাফিয়া তাসাউফের একটি সিলসিলা ছিল। এখান থেকে তিনি রুহানী শক্তি অর্জন করেন এবং আমর বিলমারুফ ও নেহি আনেল মুনকারের জযবার পরিপুষ্টি লাভ করেন। তিনি দাওয়াতে দীনের কাজকে বিশেষ পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যাপক ও সম্প্রসারিত করার দিকে মনোযোগ প্রদান করেন। হাসানুল বান্না হিসাফি ভাইদের একত্রিত করে একটি সংঘ কায়েম করেন যার নাম দেয়া হয় জমিয়তে হিসাফিয়া খাইরিয়া। হাসানুল বান্না বিদ্বানের চেয়ে অনেক বড় দায়ী ছিলেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচক্ষণতার পাশাপাশি তার মাঝে একজন দায়ী ইলাল্লাহর পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা বিদ্যমান ছিল।

কায়রোর দারুল উলুমে ভর্তি হবার পরে তিনি সেখানকার একমাত্র সংস্কারমূলক সংগঠন ‘জমিয়তে মাতারিমে আখলাকে' সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। এ সংগঠনের কার্যসীমা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ, যা মিসরে নাস্তিকতার যে জোয়ার বইতে শুরু করেছিল তার মোকাবিলায় যথেষ্ট ছিল না। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আড়ালে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার নামে চলছিল জনগণের মন থেকে দীনের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধকে নির্মূল করা ও দীনি চেতনাকে দুর্বল করার কাজ। হাসানুল বান্নার দৃষ্টিতে পরিস্থিতিকোনো বড় এবং পরিপূর্ণ কাজের দাবি জানাচ্ছিল। তাই তিনি ওলামা ও মাশায়েখদেরকে এ কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে এবং দলবদ্ধভাবে ময়দানে অবতীর্ণ হতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি আলমানার পত্রিকার সম্পাদক সাইয়েদ রশীদ রেজার সাথে সাক্ষাত করেন। আলমাকতাবুস সালফিয়ার মালিক মহিবুদ্দীন আলখতিবেরসাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আযহারের প্রখ্যাত আলেমে দীন শাইখ উজভী, শাইখ মুহাম্মদ খাজার হোসাইন ও ফরিদ উজদির সাথে মতবিনিময় করেন এবং তাদেরকে ইসলামের জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করার আহবান জানান। তাঁর এই তৎপরতার ফলে ওলামা মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং প্রথমে সাপ্তাহিক আলফাতহ প্রকাশ ও পরে জমিয়তে শুববানুল মুসলেমুন প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই ছাত্র জীবনে তিনি দায়ী ইলাল্লাহর ভূমিকা পালন করেন।

১৯২৭ সালে দারুল উলুমের ডিপ্লোমা শেষে ইসমাঈলিয়ায় তিনি বক্তৃতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মানুষের মাঝে ইকামতে দীনের দায়িত্বানুভূতি পয়দার প্রচেষ্টায় লেগে যান। ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে ইসমাঈলিয়ার ছয়জন সম্ভ্রান্ত ও সচেতন ব্যক্তি নিয়ে গঠিত হয় ইখওয়ানুল মুসলেমুন নামে এক সংগঠন। সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর হাসানুল বান্না পাঁচ বছর ইসমাঈলিয়ায় অবস্থান করেন। এ সময় এ সংগঠন অত্যন্ত চুপে চুপে তৎপরতা চালায়। এ পাঁচ বছরে আবু সবীর, পোর্ট সায়ীদ ও সুয়েজসহ বিভিন্ন স্থানে ইখওয়ানের দশটি শাখা কায়েম হয়।

‘‘হাসানুল বান্না ইখওয়ানুল মুসলেমুন প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন তাহলো মিসরের নি্রাণ ও হতাশ জাতির মাঝে জিহাদের জযবা সৃষ্টি। জিহাদ সম্পর্কে তার বিখ্যাত পুস্তিকা ছিল ইখওয়ানের প্রাথমিক যুগের শক্তিশালী আওয়াজ। এ পুস্তিকায় ইমাম বান্না ভাষার অলঙ্কার মিশিয়ে মিসরীয় জনগণকে এর প্রতিষেধক। ইমাম বান্না এ পুষ্টি আকৃষ্ট করেন- যা ছিল মুসলমান জাতির পশ্চাৎপদতা এবং পতনের হাত থেকে মুক্তির আসল প্রতিষেধক। ইমাম বান্না এ পুস্তিকায় প্রথমে কুরআনের সে সমস্ত আয়াত উল্লেখ করেন যেখানে জিহাদের সুস্পষ্ট ফরযিয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর হাদিস দ্বারা বিস্তারিতভাবে এর সাক্ষ্য পেশ করেন। তার পুস্তিকাটির গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো, জিহাদ সম্পর্কে উম্মতে মুসলিমার সকল ইসলামী আইন বিশারদদের মতামত উল্লেখ। এ প্রসঙ্গে তিনি ইবনে কুদামার মতামত বর্ণনা করেন যে, ‘যখন কোনো শহরে কাফির বাহিনী চড়াও হবে তখন এর অধিবাসীদের ওপর তাদের সাথে যুদ্ধ করে শহর থেকে হটিয়ে দেয়া ফরজে আইন হয়ে দাঁড়ায়।' ‘‘আযহারের উলামাদের তেজস্বী বক্তব্য হলো-বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাতা ইমাম বদরুদ্দীন আইনী থেকে বড় আলেম আর কে আছে। তার অভ্যাস ছিল, এক বছর জিহাদ করতেন, এক বছর শিক্ষা ও পাঠদানে নিয়োজিত থাকতেন এবং এক বছর অতিবাহিত করতেন হজ্বের মধ্যে।’’ পরিশেষে সেই লোকদেরও সমালোচনা করেন- যারা যুদ্ধকে জিহাদে আসগর জিহাদে নফসকে জিহাদে আকবর সাব্যস্ত করে আত্মশুদ্ধি ও দোহাই দিয়ে লোকদেরকে উদ্যমহীন করে থাকে।’’

হাসানুল বান্নার ইসমাইলিয়া থেকে কায়রোয় স্থানান্তরিত হওয়ায় দাওয়াতী তৎপরতা এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। কিছু কিছু লোক ইখওয়ানুল মুসলেমুনকে রাজনৈতিক দল আখ্যা দিয়ে তার দাওয়াতী কাজের বিরোধিতা করেন।তাদেরকে লক্ষ্য করে হাসানুল বান্না বলেন, ‘‘কিছু লোক বলে থাকে, ইখওয়ানুল মুসলেমুন একটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের আহবান রাজনৈতিক আহবান আর তাদের এই আহবানের পেছনে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। আমরা বুঝতে পারিনা যে, আমাদের সম্প্রদায় কোন ভিত্তিতে এই অপবাদ প্রচারে লিপ্ত। তারা কল্পনা ও অনুমান নির্ভর হয়ে এসব বলে এবং সত্য পথ পরিহার করে সংশয় ও সন্দেহপূর্ণ পথ অবলম্বন করে।’’

কায়রোয় প্রাথমিক পর্যায়ে এ দাওয়াত আগের মতোই নীরব ও প্রচ্ছন্নতার সাথে অব্যাহত ছিল। মাহমুদ পাশা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্তযে ক'জন মন্ত্রীর মন্ত্রিসভা দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়, ইমাম তাদের সকলকে দলেরপক্ষ থেকে পত্র লেখেন। এ পত্রগুলোতে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেশের অবস্থা শোধরানোর পরামর্শ দেয়া হয়। এ ছাড়া ইসলামী শরীয়তচালু করার দাবি জানানো হয়। ইখওয়ানের পক্ষ থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটি ১৯৩৬ সালে লেখা হয়। মিসরের প্রেসিডেন্ট ফারুক, প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা নাহাস পাশা এবং আরব ও মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের কাছে। পত্রটিরসমাপ্তি টানা হয় একথা বলে আমরা আমাদেরসকল শ্রম, যোগ্যতা ও উপকরণ প্রত্যেক সেই সরকারের জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত আছি- যারা উম্মতে মুসলিমার উন্নতি ও কল্যাণের জন্য নিবেদিত প্রাণ হতে বদ্ধপরিকর হবে। আমরা তাদের প্রতিটি ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেবো এবং সকল ত্যাগ ও কোরবানী করতে প্রস্তুত থাকবো।

এভাবে ১৯৩৮ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নুহাস পাশাকে পত্র ও স্মারকলিপি দেয়া হয়। ইখওয়ান শুধুমাত্র চিঠিতেই দাওয়াতী কাজ সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং মিসরীয় শাসক গোষ্ঠীকে নসীহত ও বোঝানোর যত সর্বোত্তম পন্থা ও মাধ্যম ছিল সবই ব্যবহার করে। ১৯৩৬ সালে হাসানুল বান্না নাহাস পাশার সঙ্গে সাক্ষাত করে রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। হুসাইন সিররী পাশা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইখওয়ানের ওপর চরম নির্যাতন-নিপীড়ন নেমে আসে। হুসাইন সিররী পাশার পর মুস্তফা নাহাস পাশার মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়। নাহাস পাশার পরে আহমদ মাহেরের সময় ইখওয়ান নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং হাসানুল বান্না ইসমাঈলিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে বিজয় লাভ করেন। কিন্তু ইংরেজদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে মিসরীয় সরকার সাজানো অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করে। দ্বিতীয়বার নির্বাচনে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এমন তৎপরতা চালান হয় যে ইখওয়ানের কোনো প্রার্থীকে বিজয়ের মুখ দেখতে দেয়া হয়নি। অভ্যন্তরীণ মজবুতি ও দৃঢ় মনোবলের কারণে ক'বছরের মধ্যে এ আন্দোলন।

অধ্যাত্মিক, বৈষয়িক এবং সামরিক প্রশিক্ষণের দিক থেকে উন্নতির উঁচু শিখরে উপনীত হয়। ১৫ই মে ১৯৪৮ সালে ইখওয়ানের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আরব সেনাবাহিনীর সাথে ফিলিস্তিনে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। ফলে আমেরিকা ও বৃটেনের ইহুদী পত্রিকাগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং কতিপয় দূতাবাস কনফারেন্স করে নাকাশী পাশা কর্তৃক ইখওয়ানকে অবৈধ ঘোষণা করার দাবি উত্থাপন করে। নাকাশী পাশা প্রভুদের সন্তুষ্টি অর্জনের খাতিরে ৮ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে ইখওয়ানকে অবৈধ ঘোষণা করেন। ইখওয়ান নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর এর হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। জেল-যুলমের মাধ্যমেইখওয়ানকে রোধ করা যাবে না বলে শাসকগোষ্ঠী শঙ্কিত হয়। যালিমরা ইখওয়ানের প্রাণ শক্তি বিপ্লবী নেতাকে গ্রেফতার না করে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মিসর ত্যাগ করতে তাকে প্রশাসনিকভাবে বাধা দেয়া হয়, এমনকি দেশের ভিতরেও সরকারের অনুমতি ছাড়া তার চলাফেরার উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এই প্রখ্যাত নেতাকে আখ ক্ষেতে নজর বন্দি করে রাখা হয়, অতঃপর ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ সালে সন্ধ্যাবেলা এই সত্য ও সুন্দরের প্রতিচ্ছবি ঈমানের পথে আহবানকারীকে শুববানুল মুসলিমুনের কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে প্রকাশ্যে গুলী করে শহীদ করা হয়। ইমাম হাসানুল বান্না এমন এক সময় শহীদ হন যখন ইসলামী দুনিয়া তার মতো একজন নেতার জন্য কাঙ্গাল ছিল। হাসানুল বান্নার শাহাদতের মধ্যদিয়ে ইখওয়ান এক নব জীবন লাভ করে। জাহেলিয়াতের নেতারা একমাত্র ইসলামকে ভয় পায়। এ জন্য তারা ইসলাম নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য শহীদ হাসানুল বান্নার পরে তারই পথে চলমান নেতৃত্বকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে।

- < সমাপ্ত > -

বিষয়: বিবিধ

১৫৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File