কালাপাহাড় ভুলে যাওয়া বাঙ্গালী মুসলিম বীর
লিখেছেন লিখেছেন তিতুমীর সাফকাত ০৩ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:১২:১১ রাত
ছুটে চলেছেন সৈয়দ। সুবিশাল ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লী-তখ্ত-এর গোপন প্রতিনিধি।
ছুটন্ত অশ্বের পায়ের নিচে পার হয়ে যায় আলো অন্ধকার। পার হয়ে যায় ধুলি-ধুসরিত প্রান্তর, শষ্যশ্যামল বসতি, গহন বন। ভ্রূক্ষেপ নেই সৈয়দের। ঘড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছেন তিনি বাংলার দিকে। হাজার মাইল পথ, কিন্তু বিশ্রাম নেই সৈয়দের। বিশ্রামের উপায়ও নেই। কারণ ওদিকে রওনা হয়ে গেছে জোয়ানপুরের (জৌনপুর?) দূতও। ছুটছে তারাও, লক্ষ্য ওই একই, বাংলা। লক্ষ্য ওই একই, অভ্রভেদী সেই বাঙ্গালী লোকটা। এই একটি মাত্র সুতোর ওপর ঝুলে আছে সুবিশাল ভারবর্ষের ভবিষ্যৎ, কে আগে পৌঁছয়। দুই প্রবল বিরোধীপক্ষ, - সামরিক-রাজনীতির গোপন কাজে বাংলার দিকে ছুটে চলেছে মরণপন।
গল্প নয়। আমাদেরই পুর্বপুরুষের অসাধারণ ইতিহাস। বিদ্রোহী জোয়ানপুরের সাথে লড়ছেন দিল্লীরশ্বর সুলতান। জয়-পরাজয়ের সাথে দিল্লীর মসনদ আর গর্দানটাও জড়িত। মরণপনে লড়ছে জোয়ানপুরও। একদিকে বাঁচার লড়াই অন্যদিকে রাজ্যবিস্তার। কিন্তু দু’দলেই এখন হতাশা আর ক্লান্তি। শুরু হবার পর সুদীর্ঘ চব্বিশটা বছর পার হয়ে গেছে, যুদ্ধ চলছেই। কত আর পারা যায়! দু’দলই হন্যে হয়ে খুঁজছে একটা কিছু - একটা অলৌকিক কিছু যা দিয়ে যুদ্ধটা স্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে উঠে শেষ হবে বিজয় দিয়ে। আসম্ভব একটা আশা।
বিস্ফোরণ হল কোথাও। ফিরে তাকাল ভারতবর্ষ। চমকে তাকালেন ভারত-সম্রাট। চমকে তাকালেন জোয়ানপুরের নবাব। উঠে দাঁড়ালেন দু’দলের সেনাপতি। পাওয়া গেছে! নক্ষত্রখচিত নৈশাকাশের মত অসংখ্য সামরিক প্রতিভায় ঝিকমিক আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষ। তার মধ্যে পূর্ণচন্দ্র নয়, একেবারে দোর্দ¨ মার্ত¨ প্রতাপে বাংলার আকাশে জ্বলে জ্বলে উঠছে কে ঐ? শক্তি-সম্ভারের যুদ্ধনীতির সমস্ত হিসেব পায়ে দলে উঠে দাঁড়িয়েছে কে ও কালাপাহাড়? এই তো সেই অলৌকিক, এই তো সেই চিরবিজয়ের গর্বতিলক খচিত উদ্ধত ললাট! একেই তো চাই!!
ছুটলেন সৈয়দ, ছুটল জোয়ানপুরের দূত, বাংলার দিকে। ঐ বাঙ্গালীকে চাই।
বাংলার চিরকালের রাজশাহী, মান্দা এলাকা। তখনও ছিল, এখনও আছে। সেখানে জন্মেছিল জেদী একগুঁয়ে ছেলেটা। কালাচাঁদ রায়, ডাকনাম রাজু। নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মণ জমিদারের পিতৃহীন ছেলে। দাদু আর মা-মাসী মিলে কত আদরে বড় করেছে তাকে। মা’র চেয়ে তার মাসীই বেশী, আশৈশব বালকের চিরনির্ভয় নির্ভর, আদরের আশ্রয় সেই মাসী। বাংলার রাজা বুরবক শাহ-এর দরবারে চাকরী নিয়েই কালাচাঁদ রায় রাজু, চলনে বলনে রঙ্গেরূপে শাত্রজ্ঞানে অস্ত্রশিক্ষায় অসাধারণ মেধাবী সেই সুকণ্ঠ তরুণ তরতর করে উঠে গেল ওপরে যেখানে পৌঁছতে মানুষের চুল সাদা হয়ে যায়।
তারপর এল সেই বাঁক, যেখানে ঘটনা ঘটে। যেখানে হাজার তারা ঝিকমিক করে ওঠে মানুষের চোখে, মাতালের মত টলমল করে ওঠে জীবনের পা’। বিধবা মিসেস সিম্পসনকে বুকে জড়িয়ে অর্ধ-পৃথিবীর সিংহাসন অবলীলায় ত্যাগ করেন ইংল্যান্ডের সম্রাট অষ্টম এডয়ার্ড। সুবিশাল চীনের মসনদ পায়ে ঠেলে নামহীন পতিতাকে বুকে জড়িয়ে গ্রামে সুখের জীবন কাটান সম্রাট শু চি। প্রকাশ্যে-গোপনে গড়ে ওঠে লক্ষকোটি তাজমহল..... সর্বদেশে ..... সর্বকালে....... ভিক্ষুকের প্রেমিকাকে নিয়ে বনফুল লেখেন আধা-পৃষ্ঠার কালজয়ী গল্প - ‘‘তাজমহল’’।
প্রতি সকালে মহানন্দা নদীতে øান শেষে ‘‘সুকণ্ঠে স্তোস্ত্র আবৃত্তি করিতে করিতে’’ ঘরে ফেরে কালাচাঁদ। সে জানে না, ঠিক তখনই রাজপ্রাসাদের গবাক্ষে নির্ভুল এসে দাঁড়ায় কেউ। প্রতিদিন। সুরলোকে বেজে ওঠে শংখ। দেবলোকে নৃত্যছন্দে মনোহর পেখম মেলে ধরে প্রেম-দেবতা কার্তিকের ময়ুর। চুপি চুপি ছড়িয়ে গেল খবর চারিদিকে। কালাচাঁদ জানে না, তার প্রতি অতনু শরবিদ্ধা হয়েছেন সপ্তদশী রাজকন্যা। খবর পৌঁছে গেল বুরবক শাহ-এর কানে, - খুশীই হলেন তিনি। ছেলে হিসেবে কালাচাাঁদের তুলনাই হয়না। প্রস্তাব দিলেন, যেন হুকুম, মুসলমান হয়ে বিয়ে কর, অর্ধেক রাজত্ব লিখে দেবেন তিনি। ব্যাপারটা নুতন নয়, ভালো অমুসলিম পাত্র মুসলমান হয়ে রাজপরিবারে বিয়ে করেছে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।
ঘটল সেটাই, যা আগে ঘটে নি। বিয়ের প্রস্তাবে কালাচাাঁদের হে হে কৃতজ্ঞ হাসি আশা করেছিলেন বাদশা। উল্টে বাদশার মুখের ওপর তেলে-বেগুনে ফেটে পড়ল জেদী কালাচাঁদ। কি মনে করেন রাজা নিজেকে? রাজ্য আর রাজকন্যার লোভ দেখিয়ে ধর্মত্যাগ? প্রশ্নই ওঠেনা। সবার সামনে অপমানিত হয়ে কালো হয়ে গেল বুরবক শাহ-এর মুখ। চাপের পর চাপ দিয়ে গেলেন তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে কিন্তু কালাচাঁদ ভাঙ্গবে তবু মচকাবার পাত্র নয়। বাধল বিরোধ, কথায় বেড়ে গেল কথা। পরাজিত ক্রুদ্ধ বাদশা ঘোষণা করে দিলেন জনসমক্ষে কালাচাঁদের মৃত্যুদ¨। প্রস্তুত হল মৃত্যুবেদী, থমকে গেল সময়। উদ্যত খÍগ হাতে প্রস্তুত হল ঘাতক, প্রস্তুত হল কালাচাঁদও। চারিদিকে স্তব্ধ অপেক্ষামাণ লোকারণ্য।
আর রাজকন্যা?
ছেলেখেলার বস্তু নয় ভালবাসা। সে যেমন ‘‘জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য্য আর মৃত্যুকে দেয় মহিমা’’ - (যাযাবর) তেমনি তারও একটা দাবী আছে। কখনো সে প্রাণ পর্য্যন্ত দাবী করে বসে, সে দাবী মেটাতে হয় মাটির মানুষকে। সাক্ষী তার দেবদাস-পারু, সাক্ষী তার লায়লা-মজনু, শিরী-ফরহাদ, মহুয়া-নদের চাঁদ, হীর-রা³া। এক-কে বাঁচানোর জন্য যদি ছুটে না আসেন অন্য তাহলে কিসের প্রেম? না, - তিনি বেঁচে থাকতে ঘাতকের খÍগ স্পর্শ করবে না তাঁর দয়িতকে। অন্তপুরের পর্দা ছিঁড়ে ফেলে হাহাকারে ছুটে এলেন রাজকন্যা জনসমক্ষে।, খÍেগর নীচে পেতে দিলেন দেহ। স্বপ্ন নয়, গল্প নয়। বিস্ফারিত চেয়ে রইল জনতা। উদ্যত খÍগ হাতে থমকে গেল ঘাতক, পলকহীন মায়াময় চোখে চেয়ে রইল কালাচাঁদ। চেনা ধর্মের চেয়ে অনেক বড় এক অচেনা মহাধর্মের আহ্বান-গীত তখন তার তন্ত্রীতে বেজেছে, ভেতরে সে বদলে যাচ্ছে - বদলে যাচ্ছে চিনি যেমন বদলে যায় পানির ভেতর।
‘‘ফুলশরের আঘাতে ধর্মবেদী বিদীর্ণ হইল। কালাচাঁদ বিবাহে রাজী হইলেন’’। মুসলমান হয়ে মুহম্মদ ফরমুলি (ফরম আলী? - হাসান) নাম নিয়ে কালাচাঁদের বিয়ে হয়ে গেল রাজকন্যার সাথে।
তারপর? হিন্দুধর্মেও মুরতাদের শাস্তি ভয়াবহ, সেই ফতোয়াবাজেরাও অত্যাচারের মাত্রাটাকেই সওয়াবের মাত্রা মনে করে। এত মন্দিরে এত দিনের এত সম্মানিত কালাচাঁদ পড়ে গেল সেই ষ্টিমরোলারের ভেতর। সবাই কুকুরের মত তাড়িয়ে দিল তাকে। কত প¨িত-মহাপ¨িতের কাছে ছুটে গিয়ে ধর্ণা দিল দিশেহারা কালাচাঁদ, উদভ্রান্ত সে ছুটে গেল উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরেও, - কিন্তু জগৎ নাথ তখনও চিরকালের মতই পুরুত-পা¨ার হাতে বন্দী। দুর দুর করে তারা ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিল তাকে। জেদী কালাচাঁদ অনশন করে পড়ে রইল মন্দিরের দ্বারে সাত সাতটা দিন, অনশনক্লিষ্ট সেই দুর্বল দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে বের করে দিল পুরুত-পান্ডার দল।
তারপর।
শরবিদ্ধ ক্রৌঞ্চমিথুনের মর্মভেদী আর্তনাদ শুনে ভারত-ত্রাস মহাদস্যু রত্নাকর হয়েছিলেন মহাঋষি বাল্মিকী। এখানে ঘটল উল্টোটা। পুরুত-পা¨ার অত্যাচারে মরে গেল, হারিয়ে গেল সুদর্শন প্রেমিক কালাচাঁদ রায় - প্রতিশোধের রক্তচক্ষু মেলে উঠে দাঁড়াল ভয়াবহ কালাপাহাড়। ‘‘হিন্দু’’ শব্দটাকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলবে সে। এ নামে না থাকবে কোন মন্দির-দেবতা, না থাকবে পুরুত-পা¨া। রাজ্যবিস্তারের আশায় জামাইকে সৈন্য দিলেন বুরবক শাহ। এর পর যে চিত্র ফুটে উঠল তা যেমন একদিকে উন্মত্ত ধর্মবিকার অন্যদিকে ক্রমাগত বিজয়ের অসাধারণ সামরিক প্রতিভা। সে প্রতিভার কাছে শক্তি-সম্ভারের হিসেব যন ঝড়ের মুখে বাঁশপাতার মত উড়ে গেল। কিসের কালাচাঁদ আর কিসের ফরমুলি, - আতংকিত ত্রস্ত জনগণের মুখে মুখে সে হয়ে গেল কালাপাহাড়। সে পাহাড় প্রথমেই ভেঙ্গে পড়ল উড়িষ্যার সেনাবাহিনীর ওপর, জগন্নাথ মন্দিরের ওপর, পুরুত-পা¨ার ওপর। ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে গেল সবকিছু। (বাংলার মারাঠা-বর্গীর মত আজ এই এতদিন পরেও উড়িষ্যাবাসী সভয়ে মনে করে কালাপাহাড়ের গণহত্যার কথা, কিছুদিন আগে পর্য্যন্তও স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানো হত)। এর পরের কাহিনী যেন ক্রুদ্ধ এক কালবৈশাখীর সামনে একের পর এক সৈন্যদলের উড়ে যাবার কাহিনী। হিন্দুর বিরুদ্ধে বিবেকহীন-বéাহীন এক আশ্চর্য্য প্রতিভাবান অথচ নৃশংস সেনাপতি, বিজয়লক্ষ্মীর বরপুত্র তা সে বিপক্ষে যত বেশী সৈন্যই থাকুক না কেন।
খবর পৌঁছে গেল ভারতবর্ষের কোণে কোণে, পৌঁছে গেল দিল্লীতে আর জোয়ানপুরে। ছুটলেন সৈয়দ, তুরন্ত গতিতে ছুটে জোয়ানপুরের দূতকে পরাস্ত করে কালাপাহাড়কে এনে হাজির করলেন দিল্লীর দরবারে। পত্রপাঠ জোয়ানপুর যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির পদ। পত্রপাঠ জোয়ানপুরের পরাজয়, চবিশ বছর যুদ্ধের পর। সারা ভারত তখন অবিশ্বাসে চেয়ে আছে এই বাঙ্গালীর দিকে। ‘‘জোয়ানপুর হইতে আসিবার পথে তিনি সেই প্রদেশের নিকটবর্তী সমস্ত দেবতা ও দেবমন্দির ভগ্ন করিয়াছিলেন..............’’। ফেরার পথে কাছেই পড়ল মন্দিরনগর কাশী। আর যায় কোথায়। হিংস্র ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল কালাপাহাড়, - ‘‘পা¨ারা ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়িল’’....... ভাঙ্গা মন্দিরে মন্দিরে তখন রক্তে রক্তে রক্তাক্ত হয়ে গেছে কাশী শহরটা।
তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষ্মণ, সেই বুকফাটা বিয়োগান্ত নাটক। স্বপ্ন নয়, গল্পও নয়। পাগলিনীর মত ছুটে আসছে স্খলিতবসনা স্ত্রীলোক। ভারত-ত্রাস মহাবিদ্রোহী কালাপাহাড় উঠে দাঁড়াল বিদ্যুতাহতের মত .....আর্ত চিৎকার করে উঠতে চাইল - ‘‘মা - সী’’ !!!
আশৈশব বালকের সেই চিরনির্ভয় নির্ভর, সে আশ্রয় হাহাকারে ভেঙ্গে পড়ল চোখের সামনে। হাতের বিষ ঢেলে দিল গলায়, কয়েকটা তীব্র মোচড় খেয়ে স্থির হয়ে গেল দেহ। আদরের রাজুর সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিতা লা®িতা আদরের মাসীর দেহ। দু’হাতে মুখ ঢাকা বিশাল কালাপাহাড়ের বিশাল দেহ তখন যেন একের পর এক বিস্ফোরণের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে।
মরণছোবলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত কালনাগ, নিজের মনিবের ওপরেই।
তামস অন্ধকার। নিস্তব্ধ নিঝুম রাত, নিস্পন্দ নীরব। সবরকম অত্যাচার বন্ধের অপ্রত্যাশিত আদেশে বিষ্মিত বিহ্বল সেনাবাহিনী। সবার অলক্ষ্যে নিঃশব্দে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল কেউ। আকাশ থেকে তারারা দেখল, সাগর-গিরি-অরণ্যানী সবাই দেখল, - আসমুদ্র হিমাচল সুবিশাল ভারতবর্ষের বিস্ময় চির-অপরাজিত সর্বশ্রেষ্ঠ সমরবিদ, রাজশাহীর মান্দা এলাকার ছেলেটা ভারসাম্যহীন উদভ্রান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে অন্ধকারে ..... একা ........ গন্তব্যহীন.........
এর পরে তাকে কখনো দেখেনি কেউ - জীবিত বা মৃত।
(সুত্রঃ - বৃহৎ বঙ্গ - ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন)।
বিষয়: বিবিধ
৩১৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন