প্রবাস জীবনের ভালোবাসা

লিখেছেন লিখেছেন রক্তচোষা ০১ মে, ২০১৩, ১০:১৪:৫৮ রাত



মিতুর ফোন,

- এই শোন, শোন, নিতু না আজকে 'মাব্ִদি' বলছে। জানো কত্ত সুইট করে বলেছে। আমি কেঁদে ফেলেছি জানো!!

- মানে? 'মাব্ִদি' কি? আর এতে কাঁদছো কেন?

- আরে গাধা 'মাব্ִদি' মানে 'মামনী' সেই এক সপ্তাহ থেকে ওরে ফুল দেখাইছি, পাখি দেখাইছি, হাত তালি দিয়ে বলেছি 'মামনী' বল…বল মামনি'। সে আজ 'মাব্ִদি' বলেছে। কয়েকদিনের ভেতর দেইখ 'মামনী' বলা শিখে যাবে.…উফ…তুমি যদি দেখতে!!!কত্ত মিষ্টি করে ডেকেছে আমাকে!!

- এইটা বলাতেই এতো আনন্দ??? মামনি বললে তো হার্ট ফেইল করবা দেখছি।

- করলে করবো। তা তে তোমার কি? আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যা খুশি করবো তুমি খবরদার নাক গলাবা না!!

- আজিব!! সে কি তোমার একার মেয়ে নাকি? আমার না?

- খবরদার!! ভাগ বসাতে আসবা না। ও আমার একার একটা ছোট্ট পুতুল। শুধুই আমার। জানো ও এখন ঘুমুচ্ছে। একদম রাজকন্যার মত লাগছে।

- তাই!!! প্লিজ ওর একটা ছবি MMS করে পাঠাও না!!! আমার রাজকন্যাকে দেখবো।

- এই ও আমার রাজকন্যা তোমার না!!

- ওকে বাবা.…তোমার রাজকন্যার একটা ছবি দাও প্লিজ।

- আচ্ছা বাবা!! একটু ওয়েট করো।

- ওকে।

কল রেখে দিলাম। মিতু কে ভালো বেসে বিয়ে করেছিলাম দুই বছরের বেশি হয়ে গেলো। আমার ভালোবাসার উপহার হিসেবে সে আমাকে এই ছোট্ট পরী কে গিফ্ট করেছে। কিন্তু বেশিদিন মেয়ের কাছে থাকতে পারিনি। বিদেশে চলে আসতে হয়েছে। মেয়েটাকে খুব মিস করি। মেয়ের মা কেও!!!

ফোনে মেসেজ আসলো। মিতু মেয়ের ছবি পাঠিয়েছে। আসলেই ঘুমন্ত পরী কে অনেক সুন্দর লাগছে। মিতু যে আসলে ওর মেয়ে ওর মেয়ে করে এতে কিন্তু কোন দোষ নেই। কারন মেয়েটা হয়েছে একদম ওর মায়ের মতো। আমার সাথে এতটুকু মিল ও নেই।

মিতু ফোন দিলো আবার…

- এই দেখেছো?

- হ্যা দেখলাম।

- কেমন লাগছে? ছোট্ট হুরপরী তাই না?

- হুম…আসলেই। শোন ওকে বাবা ডাক শিখাবা না?

- এই রাসকেল!! বাবা কেন? ও তো তোমাকে বাপি বলে ডাকবে।

- ও তাই তো। আচ্ছা ওকে শিখাও প্লিজ…ওর মুখ থেকে বাপি ডাক শুনতে ইচ্ছা করছে।

- আগে মামনী বলা শিখাই। তারপর তোমারটা।

- ওকে সোনা.…এই শোন তোমাকে না খুব মিস করছি।

- আমিও। এই কবে আসবা?

- এই তো আর চার বছর পর।

- এই কে জানি ডাকছে। রাখি।

- ওকে রাখো।

এই ভাবে কেটে গেলো অনেক দিন। মেয়ে নতুন কিছু করলেই মিতু আমাকে ফোন দিয়ে বলে, 'এই জানো আজকে নিতু আমাদের বিড়ালটার লেজ ধরেছিলো.…জানো আজ নিতু আমার চুল মুঠি করে ধরেছিলো আমি ছাড়াতেই পারছিলাম না,.… শোন আজ খুব ভয় পাইছি, ঘুম থেকে উঠে দেখি নিতু নাই, পরে খুজতে গিয়ে দেখি বিড়ালটার লেজ ধরে টানতে টানতে শেলফের কোনায় চলে গেছে..…

তারপর একদিন শুনলাম সেই সুসংবাদ। নিতু মামনী বলা শিখে গেছে। যেদিন এই খবরটা দিলো মিতু সেদিন সে খুব কাঁদছিলো আর বার বার বলছিলো, 'পলাশ তোমাকে অনেক থ্যান্ক্স, তুমি আমাকে এত্ত মিষ্টি একটা মেয়ে গিফ্ট করেছো, আমার এতোদিনের পরিশ্রম স্বার্থক, কত সুন্দর করে মামনী বললো জানো? আই লাভ ইউ পলাশ।'

আমাকেও শোনালো। সে নিতু কে বললো, 'বলো বলো মা…ম…নী.…বল .…মামনি…মা.…ম.…নী..…'

আমি স্পষ্ট ফোনে শুনলাম নিতু বললো, 'মাম…নি…মাম্ִনি.…' সাথে সাথে মিতুর কান্নাও শুনলাম।

আসলে নিতু যে কখন আমাদের আত্মার ভেতর ঢুকে গেছে বুঝতেই পারিনি। আগে একে অপরকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতাম না। কিন্তু এখন নিতু কে ছাড়া কিচ্ছু বুঝিনা আমরা।

আমি তখন ওকে বলেছিলাম এবার তো বাবা ডাক শিখাও।

- এই খ্যাতুশ…বাবা কি? বাপি…বাপি…ও তোমাকে বাপি বলে ডাকবে বুঝছো??

- ও সরি…ওকে বাপি বলাটাই শিখাও।

তারপর কেটে গেলো অনেকদিন। হঠাৎ একদিন ফোনে নিতুর গলাটা কেমন জানি ভার ভার লাগছিলো। আমি ওকে বললাম, 'কি হয়েছে মিতু?? নিতু ঠিক আছে তো??'

- নিতু ঠিক আছে কিন্তু ওর আচড়ন ঠিক নেই।

- মানে? কি হয়েছে নিতুর? (ঘাবড়ে গেলাম আমি)

- তেমন কিছুনা। ও তোমাকে কিছু বলবে শোন।

- তাই!!! কি বলবে শুনাও তারাতারি।

মিতু তখন বলছে, 'বল…বল.…বা…পি…বাপ্পি…বাপি.…বল তো জানপাখি আমার.…বাপি…!!!'

কিন্তু কি আজব কথা নিতু স্পষ্ট বললো, 'বাব্বা.…বা…বা.…বাব…বা.…'

আমার বুকটা ভরে গেলো আনন্দে…মেয়ের মুখ থেকে প্রথম বাবা ডাক শুনলাম। সাথে সাথে বুকটা গর্বেও ভরে গেলো। অদ্ভুত এক প্রশান্তি পেলাম মনে। কিসের যেনো এক অপুর্নতা ছিল তা পুরন হয়ে গেলো। অজান্তেই চোখ দিয়ে আনন্দ অশ্রু নেমে এলো।

- এই শুনছো??

- হ্যা শুনলাম তো।

- কি মাথা শুনলা?

- বাবা ডাক শুনলাম।

- ধুর…আমি এতো কষ্ট করে ওকে বাপি বলা শিখাইতে চাচ্ছি কিন্তু নিতু বাপি বলে না বলে বাবা। আমি যখনই বাপি বলতে বলি তখনই সে বাব্বা, বাবা করে ডাকে।

- তো কি হইছে? বাবা ডাক শুনে আজকে যত শান্তি পাইছি বাপি বলে ডাকলে হয়তো এতোটা শান্তি পেতাম না!!

- ও তাহলে তোমাকে বাবা বলেই ডাকবে?

- হ্যা ডাকুক। বরং এটাই শুনতে আমার ভালো লাগছে।

.

.

.

.

.

.

হঠাৎ প্রবল হাঁচির শব্দে ঘোর কেটে গেলো। চোখের সামনে সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। প্লেনের গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনতে পেলাম। আসলে আজকে আমি বাংলাদেশ যাচ্ছি।হঠাৎ করেই দেশে যেতে হচ্ছে। আমার মিতু এবং ছোট্ট নিতুর কাছে। প্লেনে উঠে ঘোরের ভেতর চলে গিয়েছিলাম। অতীতের কথা মনে পরে গেছিলো।

নাহ…আর দেরী ভাল লাগছেনা। কখন যে আমার সোনার দেশটাতে পা রাখবো। কখন যে নিতুর হামাগুরি দেয়া দেখবো, বিড়ালের লেজ টানাটানি দেখবো, মিতুর চোখের ভালোবাসা দেখবো,!!

আমি উদগ্রীব হয়ে আছি আমার মিতুর জন্য। নিতুর বাবা ডাক শোনার জন্য। কানে হেডফোন লাগালাম। নিতুর রেকর্ড করা বাবা, বাব্বা ডাকটা প্লে করলাম। মাঝে মাঝে শোনার সুবিধার্থে ওর ডাকটা রেকর্ড করে নিছিলাম।

চোখ বন্ধ করলাম।

এখন আমার কানে… না না…আমার হ্রিদয়ে বাজছে 'বা…বা…বাব্বা…বাবা' আর চোখে ভাসছে দুইটা মিষ্টি নিশ্পাপ মুখ।

বিষয়: বিবিধ

১২৮৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File