শাহবাগ যাননি বলে ভারতের ভিসা দেয়া হয়নি তাবলীগী সাথীদেরকে

লিখেছেন লিখেছেন টেরা ১৮ মার্চ, ২০১৩, ১১:০৫:০১ সকাল

দিল্লি যাওয়ার জন্য ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করেছিলেন তাবলিগ জামাতের কর্মী আবদুল্লাহ মাহমুদ। সাক্ষাত্কার গ্রহণকালে ভিসা অফিসার তার কাছে শাহবাগ সম্পর্কে জানতে চান। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে গিয়েছেন কিনা। মাহমুদ জানান, তিনি শাহবাগে যাননি। ভিসা অফিসার তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে পাসপোর্ট ফেরত দেন। মাহমুদকে বলা হয়, আগে শাহবাগ যান, তারপর ভারতে যাওয়ার ভিসার জন্য আবেদন করুন।

আবদুল্লাহ মাহমুদ কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা নুরুর রহমানের ভাতিজা। দিল্লিতে অবস্থিত তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজে (দফতর) যেতে তিনি ভিসার আবেদন করেছিলেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি তার সাক্ষাত্কার নেয়া হয়।

এ ঘটনা শুধু মাহমুদের একার ক্ষেত্রেই ঘটেনি। তাবলিগ জামাতের আরও বেশ কয়েকজন বলেছেন, শাহবাগ যাননি বলে তারাও ভারতে যাওয়ার ভিসা পাননি। সাক্ষাত্কারের সময় তাদেরও প্রশ্ন করা হয়েছে শাহবাগে গিয়েছেন কিনা।

শাহবাগ সম্পর্কে ভারতীয় হাইকমিশনের এ দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাবলিগ জামাতের অসংখ্য দায়িত্বশীল। দিল্লি নয়, তাবলিগ জামাতের মুসল্লিদের আগে শাহবাগের কথিত গণজাগরণ মঞ্চে যাওয়ার বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনের এ ধরনের পীড়াপীড়িতে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন তাবলিগ জামাতের মুরব্বিরা ।

আমার দেশকে তারা বলেন, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসাপ্রার্থী তাবলিগ কর্মী ভাইদের সাক্ষাত্কারের সময় শাহবাগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হচ্ছে। শাহবাগে গিয়েছেন কিনা জানতে চাওয়া হচ্ছে। শাহবাগে না যাওয়ার তথ্য দিলে তাদের ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয়েছে।

শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে একাত্মতা না জানানোর কারণে এভাবে অনেকের ভিসা আবেদনই বাতিল করে দেয়া হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে উপর্যুপরি চেষ্টা করেও ভারতীয় হাইকমিশনের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা তাবলিগ জামাতের দায়িত্বশীল মাওলানা রাইহান দিল্লিতে যাওয়ার জন্য কাকরাইলের মুরব্বিদের পরামর্শ চাইলে তাকে বলা হয়েছে, আপনি শাহবাগ গিয়েছেন কিনা? যদি শাহবাগ গিয়ে থাকেন তাহলে ভিসার জন্য আবেদন করেন। আর যদি না গিয়ে থাকেন তাহলে অন্তত একবার শাহবাগে গিয়ে ঘুরে আসুন। সাক্ষাত্কারের সময় আপনি যাতে সত্য কথা বলতে পারেন।

মাওলানা রাইহান আপাতত দিল্লি ও শাহবাগ কোনোটাতেই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগি আন্দোলন বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ প্রত্যাখ্যান করলেও শাহবাগিদের নিয়ে শুরু থেকেই অতি উত্সাহ দেখিয়ে আসছে ভারত। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদসহ দেশটির নীতিনির্ধারকরা প্রকাশ্যেই শাহবাগিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরেই বলা হয়েছে, একটি বৈরী সময়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শাহবাগিদের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন জানানো।

ভারতের কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী ও অনলাইন একটিভিস্টও শাহবাগিদের পক্ষে জোর তত্পরতা চালাচ্ছে। ঢাকায় শাহবাগিরা যতটা না সক্রিয় তারচেয়েও বেশি সক্রিয় কলকাতা ও দিল্লির কিছু ব্যক্তি এবং সংগঠন। ভারতীয় গণমাধ্যমেও শাহবাগিদের উচ্ছসিত প্রশংসা করে একের পর এক রিপোর্ট ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়।

এ অবস্থায় শুরু থেকেই শাহবাগিদের সৃষ্টির জন্য ভারতের ভূমিকা নিয়ে জোরালো সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় একে ‘ঢাকার তাহরির স্কয়ার’ এবং এনডিটিভির অনুষ্ঠানে শাহবাগি আন্দোলনকে ‘বাংলা বসন্ত’ নামে অভিহিত করা হয়। ঠিক এ রকম এক মুহূর্তে ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ভারতের মদতেই চলছে শাহবাগি আন্দোলন। এছাড়া শাহবাগিদের সমর্থনে দিল্লি ও কলকাতায়ও মঞ্চ করা হয়েছে। এছাড়া ভারতের অনেক নাগরিক ও একাধিক সংগঠন প্রকাশ্যে এসে শাহবাগি মঞ্চে যোগ দিয়েছে। শাহবাগিদের সমর্থনে যখন বাংলাদেশের কোনো গীতিকার ও শিল্পী গান করেননি তখন আন্দোলন শুরুর একেবারে প্রথম দিকেই কলকাতার জনপ্রিয় শিল্পী কবির সুমন লেখেন ‘সীমানা চিনি না আছি শাহবাগে’ গানটি, যেটি বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে ব্যাপকভাবে প্র্রচার করা হয়।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহবাগ চত্বরে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায় প্রত্যাখ্যান ফাঁসির দাবিতে ব্লগার এক্টিভিস্টদের নামে ছাত্রলীগ ও বাম ছাত্রসংগঠনুগলোর আয়োজনে সভা শুরু হয়। পরে এতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও মহাজোটের নেতারা যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শাহবাগে ছুটে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন।

সরকার ও মহাজোটভুক্ত বাম রাজনৈতিক দলগুলো শাহবাগের কথিত এ মঞ্চে একাকার হয়ে পড়ে। ওই সময় ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনও শাহবাগের মঞ্চকে জাগিয়ে তোলার জন্য নিরলস ভূমিকা পালন করে বলে কূটনৈতিক মহলে গুঞ্জন ওঠে। ঠিক ওই সময়টাতেই কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা নুরুর রহমানের ভাতিজা আবদুল্লাহ মাহমুদ তাবলিগ জামায়াতের কাজে ভারতের কেন্দ্রীয় মারকাজে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন।

এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ মাহমুদ আমার দেশকে বলেন, তাবলিগ জামায়াতের কাজে (দ্বীনের পথে মানুষকে দাওয়াত দিতে) দিল্লি যাওয়ার জন্য আমি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসার জন্য আবেদন করি। গত ১২ ফেব্রুয়ারি আমার সাক্ষাত্কার নেয়া হয়। ওই সময় শাহবাগের ঘটনা বেশ তুঙ্গে। আমার আবেদনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে ভিসা অফিসার আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি কি শাহবাগে গিয়েছেন?’ ভিসা অফিসারের এ প্রশ্নে আমি রীতিমত হতবাক হয়ে যাই। জবাবে আমি শাহবাগ না যাওয়ার কথা বলি। পরক্ষণে তিনি (ভিসা অফিসার) আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আমার পাসপোর্ট ফেরত দেন। কি কারণে আমাকে ভিসা দেয়া হয়নি, তা বলতে পারব না। তবে শাহবাগ গিয়েছি কিনা, আমার কাছে ভিসা অফিসার জানতে চেয়েছেন। আবদুল্লাহ মাহমুদ আরও বলেন, আমার আগে সাক্ষাত্কার দিয়ে বের হওয়া দু’জনও ভিসা পাননি। হাইকমিশন থেকে বেরিয়ে তারাও একই কথা বলেছেন। তাদের কাছেও শাহবাগ যাওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন ভিসা অফিসার।

রাজধানীর পল্লবীর বাসিন্দা ও তাবলিগের স্থানীয় দায়িত্বশীলতা মাওলানা মোহাম্মদ রাইয়ান তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, দিল্লির মারকাজে যাওয়ার জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ঊর্ধ্বতন মুরব্বিদের (কেন্দ্রীয় নেতা) পরামর্শ নেই। তখন আমাদের কোনো কোনো ভাই পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ভিসার জন্য আবেদন করার আগে একবার হলেও শাহবাগে গিয়ে ঘুরে আসেন। সাক্ষাত্কারের সময় এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও আপনি যাতে সঠিক তথ্যই দিতে পারেন। মাওলানা রাইয়ান আরও বলেন, আপাতত আমি শাহবাগ ও ভারতে না যাওয়ার চিন্তা নিয়েছি। ভারতের ভিসা না দিলেও আমি শাহবাগে যাব না, এটাই হচ্ছে আমার সিদ্ধান্ত।

ভারতের ভিসার আবেদন করলে শাহবাগে যাওয়ার শর্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে কাকরাইল মারকাজের একজন দায়িত্বশীল আমার দেশকে বলেন, আমাদের কাজই হচ্ছে মহান আল্লাহ ও তার প্রিয় হাবিব (স.)-এর প্রদর্শিত পথে মানুষকে আহ্বান করা। আমরা এ মিশন নিয়েই বিশ্বব্যাপী কাজ করছি। কোথাও যেতে বাধা পেলে সেখানে জোর করে যাওয়ার পক্ষে আমরা নই। তিনি বলেন, ভারতীয় দূতাবাসে আমাদের অনেকেই ভিসার আবেদন করে পাননি। কেউ কেউ আবার পেয়েছেনও। শাহবাগের বিষয়ে আমাদের অনেকেই সাক্ষাত্কারের সময় প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

নিরুত্তর ভারতীয় হাইকমিশন : একাধিক ভিসা প্রার্থীর এই অভিযোগ সম্পর্কে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের বক্তব্য জানার জন্য গতকাল প্রেস অফিসার অভিজিত চট্টোপাধ্যায়ের মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। এরপর অভিযোগ জানিয়ে তাকে একটি মেইল পাঠানো হয়। কিন্তু রাত ৯টা পর্যন্ত ওই মেইলেরও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

বিষয়: বিবিধ

১০১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File