বাঙালী মুসলিমদের মতিভ্রম ও যুগে যুগে সংস্কার আন্দোলন : আজকের প্রেক্ষিত
লিখেছেন লিখেছেন এ বি এম মুহিউদ্দীন ২৭ মার্চ, ২০১৩, ০৯:২১:৫৮ রাত
৯০% মুসলিমের বাংলাদেশে হুজুরদের আজ বড়ই দুর্দিন। উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হুজুর খুনি, ধর্ষক আর মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে আদালতে বিচারাধীন রয়েছেন। তন্মধ্যে দুজন তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আদালতকতৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। যদিও এখনো রায় কার্যকর হয়নি। আর বাইরে তাদের ভক্তদের উপর চালানো হচ্ছে নির্বিচারে গুলি।
যেসব হুজুররা ইসলামের কথা বলে ক্ষমতায় আসতে চায় এবং দেশ শাসন করতে চায় তাদের উপর বাংলাদেশের বর্তমান শাসক শ্রেণী বড্ড ক্ষেপে গেছে। তাই এসব হুজুরদের জন্য বাংলাদেশ এখন একটি মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে বললে ভুল হয় না। এমনকি এসব হুজুরদের জন্য বাকী অন্যসব হুজুররাও আজ ভুক্তভূগী। যারা কখনো কোন শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে রাস্তায় মিছিল বা অবরোধ করতে শোনা যায়নি, তারাও আজ ‘হেফাজতে ইসলাম’ নিয়ে দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইছে। ইতিমধ্যে ইসলাম রক্ষার তাগিদে প্রথমবারের মত ৩১৩জনের বদর স্কোয়াডও গঠিত হতে দেখা গেছে বাংলাদেশে। সবমিলিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়- স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও হুজুরদের মাঝে এমন কঠিন পরিস্থিতি আর তৈরী হয়নি। কিভাবে বাংলাদেশে এত মুসলিম থাকতে হুজুরদের উপর শাসকশ্রেণী এমন চড়াও হয়? আর হুজুররাই বা কেন উঠেপড়ে লাগে না? এর সম্ভাব্য ফলই বা কি হতে পারে? আজকের নিবন্ধে ইতিহাসের আলোক আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করবো।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় অতীতে বাঙালী মুসলিমদের বহুবার মতিবিভ্রম ঘটেছে। এদেশের মুসলিমরা ঈমান ও ইসলাম থেকে বহুবার দুরে সরে গেছে অত্যন্ত চমকপ্রদভাবে। অথবা আমরা এটাকে এভাবে বলতে পারি যে, বাঙালি মুসলিমরা বহুবার পথভ্রষ্ট হয়েছে। এমনটি ঘটেছে কখনো শাসক শ্রেণীর জোর-জবরদস্তির ফলে, আবার কখনো নিজস্ব পদচ্যুতির কারণে। কারণ যাইহোক, তবে বাঙালী মুসলিমদেরকে সে ভ্রষ্টতা থেকে সঠিকপথে ফিরিয়ে আনতে এদেশে কোন নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে, ইতিহাসে এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তাহলে বাঙালী মুসলিমদের সে ভ্রষ্টতা থেকে উত্তরণ ঘটলো কিভাবে এবং কাদের দ্বারা? আমরা খুব দূর অতীতের ইতিহাস ঘাটতে যাবো না বরং যথাসম্ভব নিকট অতীত থেকে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবো।
কোন কোন ইতিহাসবিদ অতীত বাংলাদেশে মাত্র একবার পূর্ণ ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জোর দাবী করেন । আর তা হল, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি যখন ১২০৪ সালে ঘোড়া হাঁকিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। ইতিহাসবিদগণ আরো দাবী করেন, সে সময় ইখতিয়ারের ইসলামী শাসনব্যস্থার প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে আফগানিস্তান, ইরান, ভারতবর্ষ এবং পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকার অসংখ্য মুসলিম বাংলাদেশে চিরস্থায়ী বসবাসের জন্য চলে আসে। আর তখনই বাংলাদেশ হয়ে ওঠে উপমহাদেশের সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি অঞ্চল। এখানে আমরা এ তথ্যটি এজন্য তুলে আনলাম যাতে বাংলাদেশী মুসলিমদের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে আমাদের সহজ হয়। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ইখতিয়ারের শাসনের পর বাংলাদেশ আবার হিন্দু রাজাদের শাসনে চলে যায় এবং এ অঞ্চলের মুসলিমরা পুনরায় হিন্দুদের প্রজায় পরিণত হয়।
এবার আমরা চলে আসি আঠারো শতকের শুরুর দিকে, যখন বাংলাদেশসহ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ ইংরেজ শাসনাধীন-
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের মুসলিমদের অবস্থা ছিল এই যে, হিন্দু জমিদাররা মুসলিমদের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতির উপর এতটাই প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছিল যে, হিন্দুরা মুসলিমদেরকে তাদের ধুতি-নাগরা পরতে বাধ্য করেছিল। মুসলিমরা তখন হিন্দুদের মত উলুধ্বনি দিতে শুরু করে। তারা হিন্দুদের সাথে তাদের মন্দিরে গিয়ে একসাথে মুর্তিকে প্রণাম এবং তাদের সাথে একাত্ম হয়ে পূজা-পার্বন উদযাপন করা শুরু করে। এমনকি কোন কোন মুসলিমের দ্বারা হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করার ঘটনাও ঘটে। এছাড়া মুসলিমরা কবর পুজাসহ অন্যান্য শিরকী কাজে মারাত্মভাবে জড়িয়ে পড়ে। মোটকথা বাঙালী মুসলিম আর হিন্দুদের মাঝে তফাৎ করাটা দু:সাধ্য হয়ে পড়ে। তখন বাঙালী মুসলিমদের এমন পরিস্থিতি হয়েছিল, হিন্দু শাসক শ্রেণীর চাপে এবং তাদের ইন্ধনে।
বাংলাদেশের তৎকালিন মুসলিম চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন এবং সমাজ সংস্কারে প্রথম যে হুজুর আত্মনিয়োগ করেন, তিনি হলেন হাজী শরিয়তুল্লাহ। তিনি তখন মুসলিমদের ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্ত অবস্থান নেন এবং সমগ্র ভারতবর্ষে এক ব্যতিক্রমী আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ঘোষণা করেন, যে সকল মুসলিম হিন্দুদের ধুতি পরা ছাড়বে না এবং তাদের মন্দিরে যাওয়া থেকে বিরত থাকবে না, তারা মুসলিম থাকার কোন সুযোগ নেই। হাজী সাহেব ঘোষণা করেন, যারা তওবা পড়ে কবরপূজা থেকে বেরিয়ে আসবে না এবং ইসলামের মূল বিধি-বিধান [ফরজ কাজসমূহ] পালন করবে না, তারা তার আন্দোলনে শরীক হতে পারবে না। হাজী শরীয়তুল্লাহর সে সংস্কার আন্দোলন তৎকালিন বাংলাদেশের ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইতিহাসে হাজী শরিয়তুল্লাহর সে আন্দোলন ‘ফারায়েজী’ আন্দোলন নামে পরিচিত। এখানে একটি বিষয় আমরা বলে রাখি যে, ফারায়েজী আন্দোলন কোন সশস্ত্র আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল শান্তিপূর্ণ মূলধারার একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। যাতে বাংলাদেশর মুসলিমগণ অত্যন্ত উপকৃত হয়েছিল।
আমরা এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংস্কার আন্দোলন যেটি সশস্ত্রভাবে সংগঠিত হয়েছিল ফারায়েজী আন্দোলনের ঠিক পরপর, সে আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইছি। হাজী শরিয়তুল্লাহর মৃত্যু পরবর্তী তারপুত্র দুদুমিয়ার শেষ সময়ে ফারায়েজী আন্দোলন কিছুটা নেতিয়ে পড়ে। অন্যদিকে ফারায়েজী আন্দোলন সশস্ত্র কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ না হওয়ার হিন্দুরা মুসলিমদের সে সংস্কার আন্দোলনকে পাত্তা না দিয়ে উপরন্তু মুসলিমদের উপর নতুন উদ্যমে আগ্রাসন পরিচালনা করে। তখন হিন্দুদের সে আগ্রাসন থেকে মুসলিমদের রক্ষার জন্য শসস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন আরেক হুজুর সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর। তিনি হিন্দু রাজন্য কতৃক মুসলিমদের ধুতি পরতে বাধ্য করা, দাঁড়ি ও টুপির জন্য ট্যাক্স প্রদান এবং মসজিদের খাজনা প্রথার বিরুদ্ধে স্বল্প সংখ্যক অথচ সাঁচ্চা মুসলিম নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি শেষপর্যন্ত ইংরেজদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মোকাবেলায় সফল হতে পারেননি। তবে তাঁর সে অভূতপূর্ব বাঁশের কেল্লার আন্দোলন হিন্দু রাজন্যসহ ইংরেজদের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যে আন্দোলনের পথ ধরে পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত হয়।
আমরা এখানে এ দুটি ঘটনা থেকে মৌলিক যে বিষয়গুলো তুলে আনতে চাইছি সেগুলো হল-
. বিভিন্ন সময় ইসলাম থেকে বাংলাদেশের মুসলিমদের পদচ্যুত হওয়া।
. ধর্মীয়ভাবে হিন্দুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া।
. হুজুরদের শান্তিপূর্ণ সংস্কার আন্দোলন।
. হুজুরদের সশস্ত্র সংস্কার আন্দোলন।
এখন আমরা যদি ইতিহাস থেকে তুলে আনা এ বিষয়গুলোর আলোকে আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করি, তাহলে এখানে যে মৌলিক পার্থক্যগুলো দেখতে পাই তা হল-
. আজকের বাংলাদেশের মুসলিমরা হিন্দুদের দ্বারা আক্রান্ত নয়।
. আজকের বাংলাদেশের মুসলিমগণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত। যদিও এখনো এখনো মুসলিমদের দাড়ি-টুপি ও মসজিদের উপর ট্যাক্স আরোপ করা হয়নি, তবে মুসলিমগণ ঝুঁকিতে রয়েছে।
. হুজুররা শান্তিপূর্ণ সংস্কার আন্দোলন করছেন।
. হুজুররা সশস্ত্র কোন প্রতিরোধ আন্দোলন পরিচালনা করছেন না।
আমরা এখানে দেখতে পেলাম যে, প্রাচীন বাংলার মত আজকের বাংলাদেশে মুসলিমরা ধর্মীয়ভাবে হিন্দুদের দ্বারা নিষ্পেষিত বা আক্রান্ত নয়। তবে তারা তৎকালিন হিন্দুদের শাসনে যেভাবে ধর্মীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছিল, ঠিক একইভাবে আজকের মুসলিম শাসনেও আক্রান্ত হয়ে আছে। অথচ এদেশের মুসলিমরা সেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে না। এর অন্যতম কারণ, হুজুররা এদেশের মুসলিমদের কাছে শাসকশ্রেণীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা পরিচয় পরিস্কারভাবে তুলে ধরতে পারছে না। অন্যদিকে শাসকশ্রেণীর মানসপটে ধর্মবিদ্বেষী যে খায়েস বিরাজমান, তা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে হুজুরদের নিপাত ঘটানোর কোন বিকল্প নেই। তাই আজ প্রকাশ্যেই হুজুর নিধনযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু হুজুররা এখনো শান্তিপূর্ণভাবে ফারায়েজী আন্দোলন পরিচালনা করছেন। এতে শাসক শ্রেণীর এখনো টনক নড়েনি এবং নড়বে বলেও মনে হয় না। তবে একটি বিষয় আগ থেকেই খুব স্পষ্টভাবে মনে গেঁথে নেয়া ভাল যে, বাংলাদেশে যখন ফারায়েজী আন্দোলনের পর বাঁশেরকেল্লার আন্দোলন শুরু হবে, তখন তিতুমীরের পেছনে লোকবল হয়তো কম হবে কিন্তু বিজয় সুনিশ্চিত। কারণ লড়াইয়ের ময়দানে বর্তমান শাসকশ্রেণীর সবচেয়ে বড় যে নৈতিক সংকট দেখা দেবে তা হল- তারা হিন্দুও নয় মুসলিমও নয়।
বিষয়: বিবিধ
১৪৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন