কালাম ভাইয়ের চলে যাওয়া আর আমার অবসর
লিখেছেন লিখেছেন এ বি এম মুহিউদ্দীন ২২ মার্চ, ২০১৩, ০৮:২৯:০৫ রাত
২০০৬-এ যখন অনার্স পড়তে ঢাকা আসি, ইচ্ছা ছিল নিজদায়িত্বে থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু আব্বার কড়া নির্দেশ ছিল –যেন মেসে না থাকি এবং অবশ্যই যেন আপার বাসায় থেকে পড়াশুনা করি। যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম এবং আব্বার কথামত আপার বাসায় থেকে অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করতে যেতাম। যদিও অল্প কিছু দিনের মাথায় গোঁ ধরেছিলাম যে, আমি মেসে চলে যাব –যাতায়াত সমস্যা এবং সময় বাঁচানোর জন্য। কারণ, প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ায় আমাকে ২.৩০+২.৩০ ঘন্টা সময় নিরেট অপচয় হিসেবে বাসে ঝুলে ঝুলে ব্যয় করতে হতো। আমি সে সময় খুব শারীরিক ও মানসিক চাপ অনুভব করছিলাম। কিন্তু ঠিক তখন উল্টো পিঠে আরো কিছু অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের একটা পরিস্থিতি তৈরী হয়ে গেল। আমার ভগ্নিপতি কালাম ভাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। তিনি হয়ে পড়েন ডায়ালাইসিসের রোগী। তাই আব্বার আর বলা লাগলো না, আমি নিজেই তার ভার মাথায় তুলে নিলাম।
কালাম ভাইকে নিয়ে এজন্য লিখছি- কারণ তার সাথে আমার জীবনের নিরস অনেকগুলো সময় অতিবাহিত হয়েছে।
আমি সাধারণত কি কাজ করি এবং কিভাবে জীবনযাপন করি তা অন্যকে বুঝতে দিতে চাই না। তাই বন্ধুরা যখন বিভিন্ন জায়গায় আমার অনিয়ম বা অনুপস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে –তার কোন উত্তর পায় নি। যেমন আমি আমার অনেক ভাই-বন্ধুদের কাছে এখনো –কেমন জানি একটা মানুষ!
কালাম ভাইকে আমি বহুবার কোলে তুলে হাসপাতাল নিয়ে গিয়েছি। সুঠাম দেহ আর দেখতে সুন্দর একজন মানুষকে চোখের সামনে দিন গুনতে দেখে আমি নিভৃতে বহুবার অশ্রুপাত করেছি। টানা চারটি বছর আমার পড়াশুনা-ক্লাশ আর কালাম ভাইয়ের ট্রিটমেন্ট একাকার হয়ে গিয়েছিল।
তাকে সপ্তাহে ২দিন ডায়ালাইসিসে নিয়ে যেতে হতো। পাশাপাশি নিয়মিত টেস্ট করানো এবং প্রয়োজনীয় ব্লাড জোগাড় করা। অন্যদিকে তিনি আবার নিয়মিত ঔষধ-বড়ি খেতেন না। অতিরিক্ত তদারকির প্রয়োজন পড়তো। সকাল-সন্ধায় গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হতো –ঔষুধ খেয়েছেন? এবং খাবার-দাবার ঠিক সেভাবে নিশ্চিত করতে হতো যেভাবে ডাক্তার প্রেসক্রাইব করতেন।
অনার্সের ২য় বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত আমি এমনি ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছি। কখনো ক্লাসে আমি নিথর হয়ে বসে থাকতাম। আবার কখনো ক্লাসে বসে থাকতাম ঠিকই কিন্তু আমার মন খুঁজে বেড়াতো ঐ দিনের ব্লাড ডোনারকে।
কালাম ভাই প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। একদম চলাচলের অযোগ্য। হাসপাতালে ভর্তি করতাম। সপ্তাহ খানেক থাকতাম। আবার সুস্থ্য হলে নিয়ে আসতাম। আবার নিয়ে যেতাম। আবার সপ্তাহ খানেক থাকতাম। আবার সুস্থ হলে নিয়ে আসতাম। এভাবে আমার অগুনতি দিন কেটেছে হাসপাতালে তার পাশের বেডে আর বারান্দায় পায়চারী করে।
আজ আমারও পড়াশুনা শেষ হলো আর কালাম ভাইও চলে গেলেন। আমি এখন সে সময়গুলোতে বেকারত্ম অনুভব করি। তীব্রভাবে অনুভব করি রাত-বিরাতে ব্লাড আনতে যাওয়ার সময়গুলো। হাসপাতালের বেড আর বারান্দা। সময় সময় মনে হয় কোথায় জানি যাওয়ার কথা?
কালাম ভাই ৩ছেলে রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার মাঝে খুব ছোট দুটি বাচ্চা, যারা তাদের বাবার জানাজায় স্ফূর্তি করেছে, মজা করেছে, খেলা-ধুলায় মত্ত থেকেছে। ছোট ছেলেটা ওর বাবার দাফনের পরের দিন কবরের কাছে গিয়ে ওর নানাকে বলে বসল- নানা, আমি আব্বুর মুখ দেখবো। আজ যখন ওদের ঢাকায় নিয়ে আসলাম- একজন বলে বসল, মামা-আব্বু কৈ?
বহুরাতে আমি ঢাকার ফুটপাত ধরে হেঁটে বেড়িয়েছি হাতে কালাম ভাইয়ের জন্য সংগৃহীত ব্লাডের ব্যাগ নিয়ে। প্রায়ই গভীর রাত হয়ে যেত আমার বাসায় ফিরতে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পতিতাদের দেখে যখন আমি মৃদু হাসতাম, ওরা আমাকে খদ্দের ভেবে কি সব উদ্ভট কথা বলতো। আমি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসতাম।
কালাম ভাইয়ের জন্য আমার ভীষণ মায়া জন্মে গিয়েছিল। প্রায়ই হাতদুটি ধরে অঝোরে কেঁদে দিতেন। আর বলতেন, আমার ছোট বাচ্চা দুটির কি হবে! আমি প্রবোধ দিতাম। আল্লাহ আছেন, আমরা আছি। আপনি আল্লাহর ওপর ভরসা করুন।
কালাম ভাইয়ের আর্থিক অভাব ছিল না। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনে তিনি পূর্ণ সক্ষম ছিলেন। কিন্তু তার যে অভাবটি ছিল- তা হল তাকে সময় দেওয়ার মত মানুষের। তাকে দেবার মত দীর্ঘ সময় কারো ছিল না। এজন্য যখন তার ফোন পেতাম, যেখানেই থাকতাম ছুটে চলে আসতাম।
কালাম ভাই আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। যা বলতাম শুনতেন। হয়ত তার যত্ন নিতাম বলেই আমার সব রাগ-ক্ষোভ-বকাঝকা হজম করতেন। আমি তাকে অনিয়মের জন্য অনেক বকেছি। আমি এজন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই!
কালাম ভাই ভাল একজন মুসলিম ছিলেন। একেবারেই সরল মনের মানুষ যাকে বলে। যা বুঝতেন তাই বলতেন, তাই করতেন। তাকে কখনো কুটকৌশলের আশ্রয় নিতে দেখিনি। নিয়মিত জামায়াতে সালাত আদায় করতেন। ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান মেনে চলতেন। আব্বা তার জামাইদের ভেতর তাকে খুব পছন্দ করতেন। কারো জন্য তাই আব্বাকে এমন অঝোরে কাঁদতে দেখিনি আমি যেমনটি দেখেছি তার জানাজা পড়াবার সময়।
কালাম ভাইয়ের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্তবাসী করেন। এবং তার পরিবারকে রক্ষা করেন।
বিষয়: বিবিধ
২৩০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন