ঈদুল ফিতরের আনন্দ সন্ধান
লিখেছেন লিখেছেন এ বি এম মুহিউদ্দীন ২৮ জুলাই, ২০১৩, ১১:৪০:৩৮ রাত
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে আমরা একজন আরেকজনকে বলি- ‘ঈদ মোবারক’। এর অর্থ কি? আমরা কি কখনো তা ভেবে দেখেছি? ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। মোবারক মানে হল, বরকতময় বা যে জিনিসটিকে বরকতময় করা হয়েছে। আর তা হল ঈদ। সুতরাং ঈদ মোবারক অর্থ হল- বরকতময় আনন্দ বা বরকতময় খুশি। আমাদের মুসলিম জীবনে এমন বরকতময় আনন্দক্ষণ বছরে মাত্র দুটি। আমরা এই দুটি দিনে ভীষণ খুশি হই, আনন্দিত হই, প্রীত হই। তবে এই আনন্দ আর অন্যসব আনন্দের মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য অনুভূতির, উপলব্ধির, ধরণের, ঐক্যের, সমতা ও নির্মলতার।
আমাদের মন নানাভাবে আনন্দ উদযাপন করে। কেউ আনন্দে হেসে উঠি, কেউ লাফিয়ে উঠি আবার কেউ আনন্দের আতিশয্যে কেঁদে উঠি। আনন্দ উদযাপনের এই সবগুলো ধরণই আমরা ঈদুল ফিতরের আনন্দে খুঁজে পাই। এতে হয়তো শ্রেণীগত পার্থক্য রয়েছে। রয়েছে উপলব্ধির স্তরগত পার্থক্যও। যেমন, আমরা শিশু বেলায় যেভাবে ঈদের আনন্দ অনুভব করতাম, বড় হয়ে তেমনটি অনুভব করি না। তবে আমরা একেবারে নিরানন্দ থাকি না। বড়দের ঈদ আনন্দের অভিপ্রকাশ হয়েতো ভিন্ন তবে তা অনেক বেশী পরিণত। আনন্দের এই স্বকীয় অনুভূতি কেবল বড় হলেই অর্জিত হয়। একটি শিশু কখনো আনন্দে কেঁদে উঠে না। কেননা বয়স এবং উপলব্ধি তাকে সেই সক্ষমতা দান করে না।
ঈদের দিন মদীনার ঘরে ঘরে বা রাস্তায় যেমন আনন্দের নহর বয়ে যেতো, শিশু কিশোররা দলে দলে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে বেরিয়ে আসতো রাস্তায় অথবা ঈদের নামাজের পর মহান মালিকের উদ্দেশ্যে দু’হাত তুলে বয়জেষ্ঠ্য রোজাদারদেরকে যেমন দেখা যেতো ক্ষণে ক্ষণে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠতে। আমাদের আজকের মুসলিম সমাজেও ঈদের সেই একই আনন্দের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়।
ঈদের আনন্দে কোন কমতি হওয়া উচিত নয়। এই আনন্দের পেছনে থাকে অনেক খাটুনি, অনেক ত্যাগ আর পরিশ্রম। ঈদের দিন ছোটরা আনন্দ করতে হয় বলে আনন্দ করা অর্থে খুশি হয় কিন্তু বড়দের আনন্দ সম অনুভূতিসম্পন্ন নয়। তাতে থাকে বিবেক-বুদ্ধি এবং গভীর দৃষ্টিভঙ্গী ও অনুভূতির ছাপ। শিশুদের আনন্দ নির্মল বলে আমরা হয়তো ঈদের দিন শিশুদের মত আনন্দ পেতে চাই। কিন্তু বড়দের ঈদ আনন্দ আরো মহৎ। নিজে খেয়ে শুধু হাসির আনন্দ অনুভব করা যায় কিন্তু কান্নার আনন্দ অনুভব করা যায় না। কান্নার আনন্দের অনুভূতি পেতে হলে নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতে হয়। ঈদুল ফিতরের আনন্দে তেমন আনন্দেরই মিশেল রয়েছে।
মনে নির্মল আনন্দের যোগান দিতে হলে সত্যের পথে প্রাগ্রসর হতে হয়। দুষ্কর্ম আর অনাচারের ভেতর বাস করে মনকে নির্মল আনন্দে আনন্দিত করা যায় না। সততা-সাধুতার যে হৃদিক প্রশান্তি তা কেবল সৎ-সজ্জনরাই অনুভব করতে পারেন। দীর্ঘ এক মাসব্যাপী ত্যাগ-তিতিক্ষার পর ঈদের দিন রোজাদারদের চোখের কোনে যে আনন্দ নহর বয়ে যায়, তা অনুভব করার সামর্থ কেবল তারাই অর্জন করেন, যারা সর্বদা আল্লাহর হুকুম মেনে চলেন। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাইয়েছেন, নিজের অল্প প্রয়োজনের উপর অন্যের অধিক প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে দান-সদকা করেছেন, রাগকে অবদমন করে প্রতিটি মুহূর্ত শান্ত থাকার লড়াই করেছেন, মন্দ কথা ও কাজ থেকে বিরত থেকেছেন -যারা পুরো রমজান মাস এমন ত্যাগ-তিতিক্ষায় লিপ্ত থেকেছেন, তাঁদের আনন্দের উর্বরতা অনুমান করা যায় না।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর বিন খাত্তাব রা.। যাঁকে আরবের সবাই ইস্পাত কঠিন হৃদয়ের দৃঢ়চেতা এক মানুষ হিসেবে চেনে। যে মানুষটির চোখের কোনে অশ্রুবিন্দু জমা হতে খুব কমই দেখা যেতো। কিন্তু কেনইবা উমর বিন খাত্তাব ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহের এক কোনে বসে হাইমাউ করে কাঁদতেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা নিজেরাই না হয় আবিষ্কার করি।
ত্যাগ আর কষ্টের পুরস্কার হিসেবে ঈদুল ফিতরের দিন ক্ষমা এবং চিরসুখের আবাস জান্নাতের সুসংবাদ প্রতিটি রোজাদারের হৃদয়কে এক ব্যতিক্রমী আনন্দের মাঝে ডুবিয়ে দেয়। যে আনন্দ অনুভব করতে হলে নিজেকে আগ থেকে রমজানের দরিয়ায় ডুবিয়ে দিতে হয়। নতুবা ঈদের দিন আনন্দের দরিয়ায় কেবল সাঁতার কাটা যায় ঠিকই, পূণ্যস্নান আর হয় না।
কেউ যদি ঈদ আনন্দের পূর্ণ রস সিঞ্চন করতে চায়, তবে তাকে অন্য কোন কারণ ছাড়াই পুরো একমাস রোজা রাখতে হবে। ভিন্নপন্থায় ঈদুল ফিতরের প্রকৃত আনন্দ অনুভব করা সম্ভব নয়। এই দিনটির সমস্ত খুশি আর আনন্দ কেবল রোজার কষ্টের মাঝেই নিহিত। আতর মাখামাখি, নতুন জামা-কাপড়, শীর্ণী-ফিরনি ইত্যাদি করে যে কেউ যে কোন সময় নিজেকে আনন্দিত করতে পারে কিন্তু ঈদের আধ্যাত্মিক যেই স্বর্গীয় আনন্দ, তা লাভ করা যায় না।
রোজাদারদের কাছে ঈদুল ফিতরের আনন্দ রোজা থেকে নিষ্কৃতি লাভের আনন্দ নয়। এই আনন্দ হল, দীর্ঘ একমাস নিরবচ্ছিন্নভাবে একমাত্র স্রষ্টার আনুগত্য করতে পারার আনন্দ, তাঁর নির্দেশে দীর্ঘদিন উপবাস থাকতে পারার আনন্দ, তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করতে পারার আনন্দ, পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারার আনন্দ, অভুক্ত-অভাবী-দরিদ্র মানুষের কষ্ট অনুভব করতে পারার আনন্দ। সর্বপোরি কাছ থেকে হৃদয় দিয়ে মানুষকে ভালবাসতে পারার আনন্দ। এমন আনন্দের কি কোন বিকল্প হয়?
বিষয়: বিবিধ
১৮২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন