রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলাম । বাংলাদেশ প্রেক্ষিত [২য় পর্ব]
লিখেছেন লিখেছেন এ বি এম মুহিউদ্দীন ০১ মে, ২০১৩, ১১:০০:৩৮ সকাল
বাংলাদেশ রাষ্ট্র
বাংলাদেশকে বলা হয়- People's Republic of Bangladesh. অর্থাৎ- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। সুতরাং এটি প্রচলিত অর্থে State নয়। যদিও বাংলাদেশকে অনেকে State বলে থাকেন কিন্তু এটি আসলে একটি Republic. The New Oxford Advanced Learners Dictionary -তে Republic সম্পর্কে বলা হয়েছে, A country that is governed by a president and politicians elected by the people and where there is no king or queen. অর্থাৎ- Republic বা প্রজাতন্ত্র হল, এমন একটি দেশ যেটি প্রেসিডেন্ট ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হয় এবং যাতে কোন রাজা বা রাণী থাকে না। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা। যেখানে জনগণ কেবল ভোটের মাধ্যমে তাদের শাসক নিয়োগ করার সুযোগ পায়।
রাষ্ট্রচিন্তকরা বাংলাদেশকে এখনো রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করেন না। তারা মনে করেন, বাংলাদেশ এখনো একটি দেশ। দেশ একটি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য যেসব উপাদান থাকা জরুরী বাংলাদেশে এখনো সেসব অর্জিত হয় নি। রাষ্ট্রের মূল চারটি উপাদান অর্জিত হলেও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যান্য যেসব অবশ্যম্ভাবী গুণ থাকা প্রয়োজন তা বাংলাদেশে অনুপস্থিত। বাংলাদেশে নেই সুষম আইন, আইনের শাসন, নাগরিক সাম্য, সাংবিধানিক মৌলিকতা, গণতন্ত্র, কার্যকর সংসদ, নিরপেক্ষ শাসন ও বিচার বিভাগ, ক্ষমতা হস্তান্তরের নির্ভরযোগ্যতা, বহুদলীয় গণতন্ত্র, অবাধ নির্বাচন ইত্যাদি। তাই অনেকে বলেন, বাংলাদেশ এখনো রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্র হওয়ার লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে।
রাষ্ট্রতত্ত্ব
রাষ্ট্র সম্পর্কিত আধুনিক চিন্তা-ভাবনার উৎকর্ষ সাধনের জন্য যে সকল রাষ্ট্রচিন্তক বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছেন, ইটালির ম্যাকিয়াভেলী তাদের অন্যতম। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রতত্ত্বের [Theory of Secular State] জনক। এছাড়া আরো যে সকল রাষ্ট্রচিন্তক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাত্ত্বিক অবদান রেখেছেন, তন্মধ্যে টমাস হাবস তার সামাজিক চুক্তি [Theory of Socio Contract] ও সার্বভৌম তত্ত্বের [Theory of Sovereignty] জন্য, জন লক তার সম্মতি তত্ত্ব [Theory of Consent] ও সংসদীয় গণতন্ত্রের [Parliamentary Democracy] জন্য, রুশো তার সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্বের [Theory of General Will] জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত। তবে আমরা এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে রাষ্ট্র সম্পর্কে শুধুমাত্র ম্যাকিয়াভেলীর চিন্তা-দর্শন নিয়ে আলোচনা করব।
ম্যাকিয়াভেলীবাদ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ম্যাকিয়াভেলীকে রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তা-দর্শনে নতুন যুগের সূচনাকারী হিসেবে অভিহীত করা হয়। বলা হয় সর্বপ্রথম তিনিই মধ্য যুগীয় কুসংস্কার থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করেন। তাকে এ বিশেষ কৃতিত্ব দেয়া হয় এ জন্য যে, ধর্ম ও নৈতিকতা থেকে রাষ্ট্রকে তিনিই প্রথম মুক্ত করেন।
রাষ্ট্রকে অধিকতর শক্তিশালী এবং স্থায়ী করে তোলার লক্ষ্যে সমঝোতা, প্রেমপ্রীতি, সহমর্মিতা, দয়াদাক্ষিণ্য ইত্যাদি জলাঞ্জলি দিয়ে নিষ্ঠুরতা, কপটতা, প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের মনে ভয়ের উদ্রেক সৃষ্টি করে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য শাসককে ম্যাকিয়াভেলী যে উপদেশ দিয়েছেন, তাকে ম্যাকিয়াভেলীবাদ [Machiavelinism] বলে আখ্যায়িত করা হয়।
ম্যাকিয়াভেলী মনে করেন, শাসনকার্য পরিচালনার জন্য যা কিছু প্রয়োজন শাসক সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। তিনি রাষ্ট্রের স্বার্থে শাসককে ধর্ম ও নৈতিকতার ভান ধরতে বলেছেন। অর্থাৎ শাসক তার উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। রাষ্ট্র সম্পর্কে তার এমন অভিপ্রায় রাষ্ট্রদর্শনে Double standard of morality হিসেবে পরিচিত।
ম্যাকিয়াভেলীবাদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য
১. লক্ষ্য যথার্থ হলে মাধ্যম অবশ্য গ্রহণযোগ্য : ম্যাকিয়েভালী মনে করেন, The end will justify the means. অর্থাৎ রাষ্ট্রের মঙ্গল সাধনের লক্ষ্যে শাসক যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। উদ্দেশ্য সুনির্ধারিত হলে তা চরিতার্থ করার জন্য যে কোন পথই গ্রহণযোগ্য।
২. সাফল্যই চূড়ান্ত লক্ষ্য : শাসক যতই হীন, বিশ্বঘাতক, অকৃতজ্ঞ হোক না কেন সাফল্য তার সব দোষ মুছে দেয়।
৩. যে যেমন তার প্রতি তেমন আচরণ : ম্যাকিয়াভেলীর মতে, সাধারণ মানুষ অকৃতজ্ঞ, অস্থিরমতি, ভীরু, অর্থলোভী। শ্রদ্ধা নয় বরং কঠোর শাসনের মাধ্যমে শাসক সম্পর্কে এদের মনে ভীতির উদ্রেক করা শাসকের সাফল্যের পূর্ব শর্ত।
৪. শক্তি ও কৌশলে সাফল্য নির্ভর করে : শাসককে হতে হবে সিংহের মত শক্তিশালী এবং শৃগালের মত চতুর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শক্তিই সাফল্যের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু শক্তি যেখানে অক্ষম কৌশল সেখানে সাফল্যের জন্য সক্ষম। এজন্য ম্যাকিয়েভালী বলেন, A Prince should combine the qualities of a fox and a lion.
তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের শাসককে হতে হবে নিষ্ঠুর, নির্মম, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক। তাছাড়া দেশকে সর্বদা যুদ্ধাবস্থায় রাখতে হবে। ফলে জনগণের ভিতরকার ছোট-খাটো মতপার্থক্য দূরীভূত হবে এবং নতুন আকাক্সক্ষার অবদমন ঘটবে।
রাষ্ট্রে ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলী
ম্যাকিয়েভালী ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে দেখতেন। তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার দিশারী। রাজনীতি, ধর্ম ও নৈতিকতা একত্রিত হলে রাষ্ট্রের ঐক্য ও শক্তি ক্ষয় হবে এবং রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে বলে ম্যাকিয়েভালী মনে করতেন। তিনি রাষ্ট্রকে ধর্মের আওতায় নয় বরং ধর্মকে রাষ্ট্রের আওতায় আনার পক্ষপাতি।
ম্যাকিয়েভালী ধর্মকে শাসকের হাতের হাতিয়ার হিসেবে বিবচনা করতেন। শাসকের প্রতি তার উপদেশ হচ্ছে- জনগণের সমর্থন, আনুগত্য ও শ্রদ্ধা লাভ করার জন্য জনগণের ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগাতে পারেন। জনগণের সমর্থন লাভের জন্য শাসক ধর্মানুরাগের ভান করতে পারেন। তার মতে, ধর্ম রাষ্ট্রের ঊর্দ্ধে নয়। তিনি আরো মনে করেন, ধর্ম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রানাধীন এবং চার্চ বা ধর্মীয় উপাসনালয় রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ বিশেষ। তিনি বলেন, ধর্ম রাজনীতিকে নয় বরং রাজনীতি ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ম্যাকিয়াভেলীর মতে, রাজনীতিই ধর্ম ও নৈতিকতার নিয়ন্ত্রক। ধর্ম মানুষকে পার্থিব জীবন সম্পর্কে উদাসীন করে তোলে এবং তার কর্মপ্রেরণা বিনষ্ট করে। সুতরাং রাষ্ট্রকে কর্মচঞ্চল রাখতে হলে তা থেকে ধর্মকে বিতাড়িত করতে হবে।
তিনি মনে করেন সরল ও বিনয়ী লোক দিয়ে রাষ্ট্রের কোন কল্যাণ হতে পারে না। কাজেই ধর্মের কথা চিন্তা না করে শাসক রাষ্ট্রের স্বার্থে যখন যা করা প্রয়োজন তখন তাই করবেন।
ম্যাকিয়াভেলীবাদের নেপথ্যে
রাষ্ট্র সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলীর এমন চিন্তা-দর্শনের উৎপত্তির কারণ খুঁজতে গিয়ে বিশ্লেষকরা তার নিজ জন্মভূমির বিশৃঙ্খলতাকে বিশেষভাবে দায়ী করেছেন। ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইটালির ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহনকারী ম্যাকিয়াভেলী তার রাষ্ট্রকে দেখতে পান চরম এক অধ:পতিত অবস্থায়। শিক্ষা জীবন সমাপ্তির পর ম্যকিয়াভেলী ইটালির বৈদেশিক বিভাগে চাকরি নেন। এ সুবাদে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পান। সরকারী দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মুখোমুখি হন এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
রাষ্ট্র সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলীর অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত এবং বিষাদময়। তিনি তার জন্মভূমিকে একটি বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখতে পান। দেখতে পান ইটালির সে সময়কার চরম অধ:পতিত ও রাজনৈতিক কলহে লিপ্ত ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থা। খ্রিস্টান পোপদের তিনি দেখতে পান ধর্মের নামে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনাচার করে বেড়াতে। তিনি আরো দেখতে পান সরকার ও নাগরিকদের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। রাষ্ট্রের এরূপ অবস্থা অবলোকন করে ম্যাকিয়াভেলী বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তিনি রাষ্ট্রকে সকলপ্রকার দূরাচারীদের হাত থেকে মুক্ত করতে সরকারকে যে কোন পন্থা অবলম্বনের পরামর্শ দেন। তিনি বিশেষভাবে পোপদের কতৃত্ব থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করার নির্দেশ দেন এবং রাষ্ট্র দ্বারা ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন।
[চলবে]
বিষয়: বিবিধ
২৫৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন