রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলাম । বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

লিখেছেন লিখেছেন এ বি এম মুহিউদ্দীন ৩০ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৪২:৩৯ দুপুর



ভূমিকা

রাষ্ট্র একটি সংগঠন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি রাজনৈতিক মতবাদ ও ইসলাম একটি ধর্ম। পৃথক এ তিনটি বিষয় নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। অনেকে রাষ্ট্র কাকে বলে তা না বুঝে রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বলছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হবে না। তারা উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় হিসেবে ইসলামকে চিত্রিত করছে। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে ইসলাম এ যাবত কি কি প্রতিবন্ধকতা তৈরী করেছে, তা তারা বলছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে কি ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, সে সম্পর্কে যেমনি এদের কোন ধারণা নেই তেমনি দেশটিতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকুন সে সম্পর্কেও তারা ভাবতে রাজি নয়। তারা শুধু বলছে, রাষ্ট্রের সাথে ইসলাম সাংঘর্ষিক তাই ইসলামকে বাদ দিতে হবে।

অনেকে আবার ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইসলামের সরাসরি অপব্যাখ্যায় লিপ্ত হয়েছে। বলছে, ইসলাম তো নিজেই ধর্মনিরপেক্ষ। তারা রাসূল সা. এর মদীনা রাষ্ট্রের কথা বলছে। মদীনা সনদের কথা বলছে। অনেকে আবার ইসলামকে এ যুগে অচল বলে মন্তব্য করছে।

আজকের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যদি নিজেদেরকে ইতালীর ম্যাকিয়েভেলীর ভাবাদর্শী বলে দাবী করে তথাপি তাদের সে দাবীর পেছনে কোন যুক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। ম্যাকিয়েভেলী যে পটভূমির উপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত করার শ্লোগান তুলেছিলেন, তার সাথে আজকের পটভূমির কোন মিল নেই। ম্যাকিয়েভেলী হয়তো ইটালির দু:খ-দুর্দশার জন্য খ্রিস্টান পোপদের দায়ী করতেন এবং পোপদের প্রতি অস্বাভাবিক ঘৃণা থেকে তিনি রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে কোন মুসলিম পণ্ডিত কি দেশের উন্নতি অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন? অথবা ইসলাম? অথবা অন্য কোন ধর্ম? বস্তুত এর কোনটি নয়। বাংলাদেশে তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী কোন পটভূমির জন্য?

রাষ্ট্র ধারণা

রাষ্ট্র [State] মানুষের সংঘবদ্ধ জীবনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। একটি দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংগঠন। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সমাজ থেকে। জীবনকে সুসংহত ও অধিকতর কল্যাণকর করে তোলার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তি। রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তি ঠিক কখন তা বলা মুশকিল। দার্শনিক প্লেটোকে [খ্রীস্টপূর্ব ৪২৭, এথেন্স, গ্রিক] পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তক মনে করা হয়। যিনি মনে করেন, মানুষের রাজনৈতিক চেততনাবোধ থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং রাষ্ট্রের বাইরে কারো বসবাস করা সম্ভব নয়।

প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তকরা রাষ্ট্রকে সমাজ থেকে আলাদা করে দেখেন নি। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তকরা রাষ্ট্রকে সমাজ থেকে আলাদা চোখে দেখেন। তারা মনে করেন, রাষ্ট্র হলো মানুষের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংগঠন। সমাজের সাথে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, রাষ্ট্র একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে কিন্তু সমাজ সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে না। সমাজ গড়ে ওঠে সমবায়ের মাধ্যমে। রাষ্ট্রকে বলা হয় সমাজের পুত্র।

হজরত ঈসা আ. পৃথিবীতে আগমনের বহুকাল পূর্বে গ্রিক ও এথেনীয় সমাজ ব্যবস্থায় সর্বপ্রথম ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিশেষ চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটান আরেকজন প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তক প্লেটোশিষ্য এরিস্টটল [খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪, স্ট্যাগিরা, ম্যাসিডন]। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাষ্ট্রে বসবাস করে না সে হয় দেবতা নয়ত পশু।’ পুরাণ ‘রাষ্ট্র’ শব্দটিকে সবচেয়ে জনপ্রিয় অর্থে ব্যবহার করেন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তক ম্যাকিয়েভেলী [১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দ, ফ্লোরেন্স, ইটালি]। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ চৎরহপব –এ বলেন, রাষ্ট্রের সাথে মানুষের জীবনের রয়েছে প্রগাঢ় সম্পর্ক। রাষ্ট্র মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং মানুষের জীবনের উত্থান-পতন ঘটায়। তাই রাষ্ট্র মানবজীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। ম্যাকিয়েভেলীকে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার জনক বলা হয়।

রাষ্ট্র কাকে বলে

রাষ্ট্র সম্পর্কে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেন, The state is union of families and villages having for its end a perfect and self sufficing life. অর্থাৎ- রাষ্ট্র হল কয়েকটি পরিবার ও গ্রামের সমষ্টি, যার উদ্দেশ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন যাপন করা।

উড্রো উইলসন বলেন, The state is a people organized for law within a definite territory. অর্থাৎ-কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত একটি জনসমষ্টিকে রাষ্ট্র বলে।

ব্লুন্টসলি বলেন, State is the politically organized people of a definite territory. অর্থাৎ- একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের আওতাধীন রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনসমাজই রাষ্ট্র।

প্রফেসর বার্জেস বলেন, The state is a particular portion of mankind viewed as an organized unit. অর্থাৎ- মানবজাতির কোন একটি বিশেষ অংশ সংঘবদ্ধ হয়ে বাস করলে রাষ্ট্র গঠিত হয়।

রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা উত্তম সংজ্ঞা দিয়েছেন অধ্যাপক গার্নার। তিনি বলেন, A state is a community of persons, more or less numerous, permanently occupying a definite portion of territory, independent (or nearly so) of external control and possessing an organized government to which the great body of inhabitants render habitual obedience. অর্থাৎ-রাষ্ট্র এমন একটি জনসমষ্টি যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যারা বহি:শক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যাদের একটি সংগঠিত সরকার রয়েছে এবং যার প্রতি জনসাধারণ স্বভাবত আনুগত্য স্বীকার করে।

ম্যাকাইভার বলেন, The state is an association which acting through law as promulgated by government endowed to the end with coercive power maintaining within a community torrential demarcated, the universal external condition of social order. অর্থাৎ- রাষ্ট্র এমন একটি সংঘ, যা সরকারের ঘোষিত আইন অনুসারে কার্মকান্ড পরিচালনা করে। সরকার আইন ঘোষণা করার এবং তা পালন করার শক্তির অধিকারী। ঐ শক্তির সাহায্যে সরকার নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সামাজিক শৃংঙ্খলার বাহ্যিক ও সার্বজনীন অবস্থা বজায় রাখে।

জনপ্রিয় আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তক হ্যারল্ড লাস্কি বলেন, The modern state is a territorial society divided into government and subject’s calming within its allotted physical area supremacy over all other institutions. অর্থাৎ- এটা ভূখণ্ডে অবস্থিত এমন সমাজ, যা শাসকগোষ্ঠী ও শাসিত দু’ভাগে বিভক্ত এবং নিজের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত অন্য সকল সংস্থার ওপর প্রাধান্য দাবী করে।

উপর্যুক্ত মতামতগুলোর আলোকে বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সুসংগঠিত সরকার, সার্বভৌম আধিপত্য এবং স্থায়ীভাবে বসবাকারী জনসমষ্টি -এ সকল কিছুর সমন্বয় যেখানে আছে তাই রাষ্ট্র। এজন্য জনগণ, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব -এ চারটি মৌলিক উপাদান ব্যতিরেকে রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় নয়।

দেশ এবং রাষ্ট্র এক জিনিস নয়

সাধারণত রাষ্ট্র বলতে আমরা কোন দেশকে বুঝে থাকি। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র এবং দেশ এক জিনিস নয়। দেশকে ইংরেজীতে Country বলা হয় আর রাষ্ট্রকে বলা হয় State. Country সম্পর্কে The New Oxford Advanced Learners Dictionary -তে বলা হয়েছে, An area that is away from town and cities, especially one with particular natural features. অর্থাৎ- দেশ হল একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড যা শহর এবং নগর থেকে বিচ্ছিন্ন, যার বিশেষ একটি সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক অবয়ব রয়েছে। অপরদিকে State সম্পর্কে বলা হয়েছে, An organized political community controlled by one government. অর্থাৎ- রাষ্ট্র হল একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন যা একটি সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

Country শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, Country is the most usual, neutral word for a geographical area that has or used to have its own government. অর্থাৎ- দেশ একটি সর্বাধিক সর্বব্যাপী শব্দ যা দ্বারা নির্দিষ্ট কোন ভূভাগ অথবা তার নির্দিষ্ট সরকারকে বুঝানো হয়ে থাকে। অপরদিকে State শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, State emphasizes the political organization of an area under an independent government. অর্থাৎ- রাষ্ট্র শব্দটি ব্যবহৃত হয় বিশেষভাবে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের স্বাধীন সরকারের অধীনে রাজনৈতিক সংগঠনকে বুঝাতে।

মোটকথা রাষ্ট্র একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন। যেটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব পালন করে থাকে। বহিরাক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করে, দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন, আইনের প্রয়োগ, আইনের ব্যাখ্যা প্রভৃতি কাজ সম্পাদন করে এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে। রাষ্ট্রের উপর ভর করে দেশ পদ্ধতিগতভাবে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। দেশ ও রাষ্ট্রের মাঝে সাধারণ একটি পার্থক্য হল, রাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরীন অবকাঠামো কিন্তু দেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নয়। দেশ ছাড়া রাষ্ট্র হয় না কিন্তু রাষ্ট্র ছাড়া দেশ হতে পারে। অর্থাৎ প্রতিটি রাষ্ট্র একটি দেশ কিন্তু প্রতিটি দেশ রাষ্ট্র নাও হতে পারে।

[চলবে]

বিষয়: বিবিধ

২৬০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File