দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর হয়তো ফাঁসি হবে, তবে তার পরে.........
লিখেছেন লিখেছেন খালিদ বিন ওয়ালিদ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৯:০৭:৫৬ রাত
অবশেষে আগামীকাল বহুল প্রতীক্ষিত রায় আসছে। যদিও স্কাইপে কথোপকথন মারফত অবশ্য আমরা জেনেছি, এই রায়টি সবার আগে দেবার কথা ছিলো। যাহোক, ট্রাইবুন্যাল-১ আগামীকাল রায় ঘোষণা করবেন, আর শাহবাগ শোডাউনের পর সেই রায় কি হবে তাও দেশবাসীর অজানা নয়। জামায়াত-শিবির হয়তো দেশব্যাপী প্রতিরোধের চেষ্টা করবে, রক্তারক্তি হবে কিন্তু আল্টিমেটলি তাতে কোন লাভ হবে না। একটি সংগঠন কখনো রাষ্ট্রশক্তির চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে না।
নিন্দুকেরা বলছেন, সারা দেশে ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারদের বিরুদ্ধে যে বিক্ষুদ্ধ কণ্ঠস্বর জেগে উঠেছিলো, তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই হঠাত করে রায়ের তারিখ দেয়া হলো...... তবে আমরা মনে করি, এটা স্বাভাবিকই ছিলো।
আইনের মারপ্যাচের দিকে যেতে চাচ্ছি না, রায় কি হবে সেটাও বলতে চাচ্ছি না কারণ............ এ নিয়ে আলোচনা অবান্তর। রায়ে ফাসী হলে সারা দেশেই জামায়াত-শিবিরের তান্ডব শুরু হবে, ফাসী না হলে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়বে শাহবাগ, আরও সহিংস হয়ে। সামনে আসলেই ঘোর দুর্দিন।
তবে এর মধ্যে, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য জানলাম যা শেয়ার করা প্রয়োজন মনে করছি। যেহেতু ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ এবং বামজোট, এ মুহূর্তে তাই রাজাকার যুদ্ধাপরাধী মানেই জামায়াত-বিএনপি ঘরানার লোকজন। এই সময়ে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকলেও একই ঘটনা ঘটত...... আওয়ামী লীগের নেতারাই ফেসে যেতেন। তবে যে ইতিহাস আমরা জানি না, বা আমাদের জানানো হয় না............ সে দিকেই ইঙ্গিত দিতে চাই।
জেনারেল জিয়ার সরকার, এরশাদ, খালেদার দুই টার্ম এবং হাসিনার দুই টার্ম, স্বাধীনতার পরে এই ৩৫-৩৬ বছরে প্রশাসনে সেই সমস্ত লোকদের ব্যাপকভাবে পুনর্বাসন, এবং মূল্যায়ন (??!!) করা হয়েছে, ৭১ সালের যুদ্ধের সময়ে যারা অন্ধ আনুগত্য দেখিয়ে গেছেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রতি। তাদের মধ্যে বর্তমান হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে শুরু করে সরকারী আমলা, ব্যবসাদার সবাই রয়েছেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বদৌলতে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা তো আজ সবাই জানেন। তার বাইরেও কিছু নাম শুনে রাখতে পারেন, যাদের পাকিস্তানী আনুগত্য সম্পর্কে আমরা আগে কখনো জানতাম না, বা গুরুত্ব দিতাম না।
ডঃ আকবর আলী খানের মতে (যিনি মুজিবনগর সরকারের অধীনে কাজ করতেন) ৭১ সালে বাংলাদেশে প্রায় দুই শতাধিক সিএসপি (আমলা) ছিলেন, যাদের মধ্যে মাত্র ১৩ জন মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন, বাকীরা চাকরি করে যান পাকিস্তান সরকারের অধীনে......... শেষ পর্যন্ত !!! এদের মধ্যে আমরা দেখেছি প্রচুর অফিসার, যারা সে সময় জুনিয়র ছিলেন, নয় মাস পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরী করার পরও কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে সচিব এমনকি কেবিনেট সচিব, আইজিপি, সিইসি ও গভর্নর সহ নানা উচ্চপদে আসীন হন ! (তথ্যসূত্র - বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, এইচ টি ইমাম পৃষ্ঠা ১৩৯)
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দীন, ৭১ সালে ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার এডিসি। উল্লেখ্য, মহীউদ্দিন খান আলমগীরও সে সময় ময়মনসিংহের এডিসি ছিলেন। এমনকি সাবেক সিইসি, ডঃ এটিএম শামসুল হুদা ছিলেন ময়মনসিংহের অতিঃ জেলা প্রশাসক। আমাদের বর্তমান প্রধাণমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডঃ মশিউর রহমান, ৭১ সালে ছিলেন চট্টগ্রামের এডিসি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সি এম শফী সামি ছিলেন খুলনার এডিসি, আইউব কাদরী ছিলেন পটুয়াখালীর সহকারী কমিশনার। প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী ছিলেন শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগের যুগ্ন সচিব। সাবেক সচিব মারগুব মোরশেদ ছিলেন নওগাঁ জেলায় মহকুমা প্রশাসক। এদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি রাজাকার বাহিনী গঠন ও তাদের তদারকীর দায়িত্ব পালন করেন (তথ্যসূত্র - চরমপত্র, এম আর আখতার মুকুল পৃষ্ঠা ৩৩৩-৩৪৭)
এমনকি বর্তমান প্রধাণমন্ত্রীর স্বামী মরহুম ডঃ ওয়াজেদ যুদ্ধের সময়ে পাক সরকারের অধীনে পরমাণু শক্তি কমিশনে চাকুরীরত ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম তখন পিজি হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন, যা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়লে আমরা পাই। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইট ঘাঁটলে দেখা যাবে, বর্তমান হাইকোর্টে দু’জন বিচারক রয়েছেন যারা যুদ্ধকালীন সময়ে (৭১ এর নভেম্বরে) পাক সরকারের অধীনে মুন্সেফ (সহকারী জজ) হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেন।
পুলিশের সাবেক আইজিপি এসএম শাহজাহান একাত্তরে কুমিল্লা জেলার এসপি ছিলেন। সাবেক আইজিপি এনামুল হক ছিলেন যশোরের এসপি। সাবেক আইজিপি শহুদুল হক তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে ২৯ ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। প্রাণ গ্রুপের কর্ণধার মেজর জেনারেল (অবঃ) আমজাদ হোসেন তখন মেজর হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৩ ব্রিগেডে কর্মরত ছিলেন। (তথ্যসূত্র - মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, এ এস এম সামছুল আরেফীন, পৃষ্ঠা ৩৬২ - ৩৭৫)
এই হিসাব শেষ হবার নয়, আর এই নিয়ে কথা শুরু করলে সে কথাও শেষ হবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের গঠনের মধ্য দিয়ে সরকার চারটি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করে, কিন্তু আন্দোলন বা রাজনৈতিক খেলার মাধ্যমে তা আজ ব্যাংক, হাসপাতাল ও পত্রিকার বিরুদ্ধে চলে গেছে, যার ফলে জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত। সত্যিকার ইতিহাস না জেনে আমরা যদি কেবল অন্ধ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ধর্মীয় বিদ্বেষ বা আরো নানা কিছুর বশবর্তী হয়ে একটি দু’টি সংগঠন, গোটাদশেক মানুষ বা কিছু আর্থিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে যাই......... আজন্মকাল এই বিভাজন চলতে থাকবে যা একপর্যায়ে হুতু-টুটসী বা অন্য জাতিগত বিভেদ থেকেও খারারপ ফলাফল বয়ে আনবে। ফলাফল...... দেশের আকাশ হবে মেঘাচ্ছন্ন আর কাটা খালে ঢুকে পড়বে দেশী-বিদেশি রাঘব বোয়াল আর কুমির।
যদি পাকিস্তান সমর্থন করা অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে সে অপরাধে দোষী সবাইকে বিচারের মুখোমুখী করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধাপরাধ ব্যতীত অন্য কোন কারণে, কিংবা গুটিকয়েক ব্যক্তির জন্য কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া এমনকি স্কুল-মাদ্রাসা-এতিমখানা জ্বালিয়ে দেয়াটা সভ্যতার ভেতর পড়ে না। ইসলামপ্রিয় মানুষ এবং দেশের সম্মানিত আলেম উলামাদেরকে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে (এমনকি তারা আদর্শিকভাবে ঘোর জামায়াতবিরোধী) ব্যংগ-উপহাস করে, কোমলমতি শিশুদের হিংস্রতা শিখিয়ে আমরা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তা ভেবে দেখা উচিত।
বিষয়: বিবিধ
১৩২৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন