মুসলিম হিসেবে ডাঃ জাকির নায়েককে শ্রদ্ধা করা গেলে, মাওলানা মওদুদী বা নিজামীকে নয় কেন?
লিখেছেন লিখেছেন সময়ের কথা ২৭ জুলাই, ২০১৩, ০৩:২৫:৫৩ রাত
একজন আমার ফেসবুক একাউন্টে বললেনঃ
আমার সন্দেহ আপনার জন্ম যদি হিন্দু ঘরে হত তাহলে আপনি পুরোহিত হতেন এখন যেমন মুসলিম বিধায় ইসলামের কান্ডারি হয়েছেন।
তবে আপনার একটি লেখার পুরোটার সাথে আমি একমত শুধু একটি লাইন ছাড়া। বিখ্যাত যাদের নাম (যেমন, জাকির নায়েক, সাইদী, মওদুদী, নিজামী) উল্লেখ করে আপনি বলেছেন যে এদের আমরা শ্রদ্ধা করতে পারি সেখান থেকে মওদূদী আর নিজামীর নামটা কেটে দিন। এরা সরাসরি মূল ইসলাম না মানবতার দুশমন। এদের মান্য করলে ঈমান আকিদা বা মুসলমানিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে।
আমার উত্তরঃ
ভাইঃ সালাম। আমার কমেন্টগুলো পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
১। আমি পারিবারিকভাবে ইসলাম শিখে নামাজটাও ঠিকমত পড়তাম না। কুরআন পড়া ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার মাতা-পিতার চেষ্টার ত্রুটি হয়তো ছিল না। কিন্তু মানুষতো স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবেই তার মনকে নিয়ন্ত্রন করে। এই কারনেই কাফিরদের ঘরে জন্ম নিয়েও ওমর (রা), আবু বকর (রা), এমনকি বর্তমান সময়ে হাজার হাজার আমেরিকান, ইউরোপিয়ান, কোরিয়ান, জাপানিজ, চাইনিজ এবং হিন্দুরা ইসলাম গ্রহন করছে। ইসলামের সৌন্দর্যই এবং আল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতাই তার শক্তি এবং এর সমর্থকদের শক্তি। আমি হিন্দু পরিবারে জন্মালে হয়তো নাস্তিক হতাম বা পুরোহিত হতাম বা মুসলিমও হতে পারতাম আব্দুর রহমান গ্রীন বা আরো অনেক নওমুসলিমের মত।
২। একমত হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। একজন মুসলিম হিসেবে ইসলামের ব্যাপারে আমি কোন ভুল কথা বললে আর একজন মুসলিম হিসেবে আপনি আমার জন্য আয়না স্বরুপ। অবশ্যই আমার ভুল ধরিয়ে দিবেন আর একজন ভাই হিসেবে দুয়া করবেন যেন আমি ভুলের উপর না থেকে সঠিক পথে থাকতে পারি।
৩। যে কারনে আপনি আজ মাওলানা মওদুদীকে ঘৃনা করছেন, সেই একই কারনে জাকির নায়েককে অনেকে ঘৃনা করেন। কিন্তু আপনি হয়তো তাকে পছন্দ করেন। আর আমার অবস্থা হল, আমি জাকির নায়েক বা মাওলানা মওদুদী দুইজনের চিন্তা-চেতনার উপরই কিছু স্টাডি করেছি। কিন্তু দুইজনের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য খুজে পাইনি। জাকির নায়েক আজ যা করছে তা ৫০ বছর আগে করেছেন মওদুদী। জাকির নায়েকের মুল শ্রোতা যখন অমুসলিমরা, মওদুদীর মুল শ্রোতা ছিল তখনকার সময়ের ইমানের ব্যাপারে দুর্বলতা চলে আসা মুসলিমরা। কিন্তু দুইজনই সুবক্তা ছিলেন আর দায়ী হিসেবে জাকির নায়েকের অবদান সুস্পষ্ট। কিন্তু মওদুদীর অবদান কেবল দায়ী হিসেবে নয় বরং কুরআনের তাফসীর কারক (৩০ বছর লেগেছিল যে তাফসীরটি লিখতে এবং এই তাফসীরটির কেবল ভুমিকা পড়লেই আপনি বুঝবেন তার মত মেধাবী ও অধ্যবসায়ী মানুষের এতো সময় কেন লেগেছিল এটি লিখতে), ইসলাম ও অন্য জীবন মতবাদ গুলোর পার্থক্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, ইসলামের প্রতিটি বিষয়ের অন্ধ বিশ্বাস নয় বরং যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা, ইসলামি সমাজ, অর্থনিতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাসুলুল্লাহ (স) এর জীবনী, এমন কোন ক্ষেত্র নেই যে বিষয়ে মাওলানা মওদুদী ইসলামের প্রসারের জন্য কলম চালাননি। টানা ২০-৪০ (আমার exactly মনে নেই) এশার নামাজের পর থেকে ফজরের নামাজের পুর্ব পর্যন্ত তিনি লিখেছেন ইসলামের জন্য।
তার লিখা 'ইসলাম পরিচিতি' - 'Towards understanding islam' এখনো সমগ্র বিশ্বে একটি অন্যতম রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহারিত হয়। তার ফিলসফীর উপরে পৃথিবীতে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় আর তার উপর অসংখ্য গবেষনা জার্নাল পেপার আছে ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত 'মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়' সৃষ্টি থেকে শুরু করে কারিকুলাম প্রনয়ন থেকে শুরু করে পরিচালনা বোর্ডের আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। আমি জানি না কতটূকু স্টাডি বা জানা-শুনার মাধ্যমে আপনার মনে তার মত একজন ইসলামী চিন্তাবিদ সম্পর্কে নেগেটিভ ধারনা ঢুকেছে। তবে আপনি তার সাহিত্য-কর্মগুলো দেখুন, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ বা হুমায়ুন আহমদ বা নজরুল বা শরতচন্দ্রের যে অবদান, মাওলানা মওদুদীকে ইসলামী সাহিত্যের জগতে এর চাইতেও অনেক বেশী খেদমত করার তাওফীক দিয়েছিলেন। তিনি ১২০ টিরও বেশী গবেষনাধর্মী ইসলামের যুক্তিভিত্তিক বই লিখেছেন, আর ১০০০ টিরও বেশী বক্তব্য দিয়েছেন যার মধ্যে ৭০০ টিরও বেশী রেকর্ড করা হয়েছে পরবর্তী প্রচারের জন্য। আপনার যদি সময় থাকে তাহলে আমি বলব এমন মহান মানুষটি সম্পর্কে পড়াশোনা করুন তারপর কোন সমালোচনা থাকলে বলুন। তানা হলে আল্লাহর কাছে হয়তো আপনাকে জবাবদিহী করতে হবে।
৪। মাওলানা নিজামী ডাঃ জাকির বা মাওলানা মওদুদীর মত কারিশম্যাটিক নেতা, বক্তা, চিন্তাবিদ বা লেখক নন, কিন্তু আপনাকেতো আমি আগেই বলেছি ভাই, ইসলামে মর্যাদা হল তাকওয়া (খোদাভীতির ভিত্তিতে)। এই সম্মানিত ব্যক্তিদের আমি বা মুসলিমরা শ্রদ্ধা করে তাদের তাকওয়া জন্য, পাশাপাশি তাদের বৈষয়িক জ্ঞান গরিমা আমাদের মুগ্ধ করে। মাওলান নিজামি জামাত ইসলামীর একজন সার্থক আমির। তার লিখা কিছু বই আছে ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয়ে। আপনি পড়ে দেখতে পারেন। আমার কাছে তিনি পরম শ্রদ্ধেয় মানুষ, এবং একটি সুন্দর ও বাংলাদেশে বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন জামাত ইসলামির তিনি আমির। আমার মনে হয় না, তার ব্যাপারে আপনার ঘৃনার কোন সুন্দর কারন দেখানো সম্ভব। হয়তো আপনার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী ভিন্ন বা কেঊ আপনার কান ভারী করেছে। কিন্তু বাস্তব যুক্তিসঙ্গত কারন নিতান্তই অসম্ভব।
৫। ডাঃ জাকির নায়েক ও মাওলানা আবুল আ'লা মওদুদী সম্পর্কে যারা তুলনায় যেতে চান তাদের জন্য আরো কিছু কথাঃ
জাকির নায়েক এবং মওদুদী দুইজনি আমার কাছে পরম শ্রদ্ধেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত জাকির নায়েকের কাজ মওদুদীর কাজের একটি অংশের (দায়ীর দায়িত্ব) মাঝেই সীমাবদ্ধ। দুইজনই এই অংশে (বক্তব্য ও মিডিয়ায় দাওয়াতী কাজ) সফল, আলহামদুলিল্লাহ। একজন অমুসলিমদের ব্যাপারে, আরেকজন মুসলিমদের ব্যাপারে। তবে বর্তমান মিডিয়ার যুগে জাকির নায়েক সমসাময়িক কাভারেজ বেশি পেয়েছেন। তাতে করে মওদুদী অবদানকে খাট করে দেখার সুযোগ নেই।
কেউ কেউ হয়তো চিন্তা করবেন জাকির নায়েক হয়তো বেশী বৈজ্ঞানিক ও প্রাক্টিক্যালিটি বজায় রেখেছেন। আমি এই ব্যপারে যতটুকু বুঝেছি তা হল, বৈজ্ঞানিক ও প্রাক্টিক্যালিটির ব্যাপারে জাকির নায়েক মওদুদীরই উত্তরসুরী। মওদুদীইতো প্রথম ইসলামের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে নতুন ফলক উম্মোচন করেছেন এই শতাব্দীতে, যার ধারা অব্যাহত রাখছেন জাকির নায়েক। যারা এটি জানেন না তারা হয়তো মওদুদীর সাহিত্য বেশী স্টাডি করেননি বা বক্তব্য শোনেননি, আর যেহেতু জাকির নায়েকের বক্তব্য মিডিয়াতে সহজে পাওয়া যাচ্ছে তাই শুনেছেন। একবার চেখে দেখুন, স্বাদ-গন্ধ সবই একই রকম, তাদের যারা সমালোচনা করে তারাও একই গোত্রভুক্ত। মাওলানা মওদুদীর সাহিত্য যারা পড়েছেন তারা অবলিলায় শিকার করবেন যে, জাকির নায়েক যা বলছেন তা তাদের শোনা কোন নতুন কথা নয়। (কোন কিছুই নতুন নয়, এমনতো আর হয় না, কিছু তথ্য নতুন থাকতে পারে বৈজ্ঞানিক ব্যাপারে এবং ধর্মগ্রন্থগুলোর ব্যাপারে) বরং তারা আনন্দ পান এই ভেবে যে, ইসলামের একজন সুমহান বক্তা এবং দায়ী জাকির নায়েকও ইসলামের সঠিক কথাটিই মানুষের মাঝে পৌছে দিচ্ছেন।
ভাই, এই হল আমার কথা। ভুল হতে পারে। শুধরে দিবেন। তবে লম্বা কমেন্ট তাই পড়ার জন্য আগেই ধন্যবাদ দিচ্ছি। ভাই আপনি জানেন আপনি কেন কষ্ট করছেন আমার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলে। আমি মনে করি আপনি অন্ধভাবে হয়তো কাউকে সমর্থন বা অপছন্দ করা পছন্দ করে না বলেই হয়তো এত সময় দিয়েছেন। পাশাপাশি, আমিও জম্ম থেকে ভাল ইসলামী বা জামাত ইসলামী করি না। বরং দুর্বল হিসেবে আল্লাহ পড়াশোনা ও বোঝার যতটুকু তাওফীক দিয়েছেন তার আলোকেই জামাত ইসলামীতে যোগ দিয়েছি। আর ইসলামী চিন্তা চেতনা ও এর অনুসারিদের শ্রদ্ধা করা শুরু করেছি এবং আল্লাহর শত্রুদের চিন্তা চেতনা ও অনুসারীদেরকে ঘৃনা করতে শুরু করেছি। আমি মনে করি এটাই আমার ইবাদত যার জন্যে আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আপনি চাইলে আমাকে ভালবাসতে পারেন আবার ঘৃনাও করতে পারেন। তবে আমাকে ভালবাসা একটু কঠিন। কারন আমি সবসময় প্রগতিশীল নই, মাঝে মাঝে প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রতিবাদমুখর। তাই আমার ভাই-বোনরা যারা আমাকে ভালবাসে তারাও বেশীর ভাগই এই রকম। আপনাকে এই ভালবাসার ভুবনে স্বাগতম।
---------------------------
জামায়াত ইসলামীর জোট ভাঙ্গার জন্যে আওয়ামীলীগের প্রচেষ্টার একটি এনালাইসিস, এই ব্লগের সবচেয়ে বেশী পঠিত একটি পোষ্টঃ বিএনপিকে ত্যাগ করে আলাদা নির্বাচনে জামায়াতঃ আওয়ামী আবদারে জামায়াতের ভাবনা
তামীম ইকবালের বিয়েতে মাওলানা নিজামীর উপস্থিতি নিয়ে একটি স্বপ্নচিত্র আকা হয়েছে এই পোষ্টটিতেঃ তামিমের বিয়েতে সপরিবারে মাওলানা নিজামীঃ কেসস্টাডি
ইসলামে গোড়ামীর কোন স্থান নেই। তাই গোড়ামীর জাল ছিন্ন করে সঠিক চিন্তায় ইসলামের সৌন্দর্যকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা দেখুন এই পোষ্টেঃ গোঁড়াদের ঘোড়সওয়ারী ও তীরন্দাজীর ইসলাম বনাম বুঝদারদের ক্রিকেট-ফুটবল সমেত ইসলাম
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান নিয়ে অনেকের প্রশ্নের অন্ত নেই। শিয়া-সুন্নীর বিভেদ কেবল নয়, বরং কাফির-মুসলিমের বিভেদে গিয়েও আলোচনা শেষ হয় না। ইরান নিয়ে কিছু চিন্তাকর্ষক কথা পড়ুন এক নিঃশ্বাসেঃ ইসলামী ঐক্যের ভিত্তিঃ ইরান প্রসঙ্গে আলোচনা
ইসলামের সঠিক বুঝ পাওয়ার ক্ষেত্রে এই পোষ্টটিতে কিছু চিন্তাকর্ষক পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছেঃ ইসলামের যুগ বা জাতিবদ্ধতার বিশ্লেষনঃ ইসলাম কি আরবীয়, মধ্যযুগীয় বা প্রাচীন যুগীয়
আমার ফেসবুকঃ Mohamad Ahsanul Haque Arif
বিষয়: বিবিধ
৫২১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন