জনজীবনে গুজবের প্রভাব ও পরিণতি

লিখেছেন লিখেছেন খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ ২৩ মার্চ, ২০১৩, ০৪:২৫:৪২ বিকাল

পবিত্র কুরআনুল হাকিমের সূরা হুজরাতের ষষ্ঠ আয়াতে বলা হয়েছে, মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনে, তবে তোমরা যাচাই করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত: তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে পস্তাতে না হয়। প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় মহানবীর সা.-এর হাদিসেও। হযরত আবু হুরায়রা রা. সূত্রে সহীহু মুসলিম গ্রন্থে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হবার ক্ষেত্রে যেকোনো তথ্য যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকে শোনামাত্র প্রচার করে দেয়ার প্রবণতাই যথেষ্ট।

এ-হাদিসে একদিকে অতিকথনকে জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অন্যদিকে যাচাই ও অনুসন্ধানের তোয়াক্কা না করে যেনতেন সূত্রে প্রাপ্ত কথা যারা করে প্রচার করে বেড়ায় তাদের নিন্দাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইমাম নবভীর রাহ.-এর উক্তিটি চমৎকার! তিনি বলেন, আল্লাহর বান্দাদের মুখনিঃসৃত কথা তিনটি অবস্থার বাইরে নয়; কথাটি ভালো এবং এর জন্যে তিনি সওয়াবের অধিকারী হন নতুবা তা মন্দ যার কারণে তিনি গুনাহ উপার্জন করলেন। তৃতীয় অবস্থায় তা মুবাহ অর্থাৎ নিষিদ্ধতার আওতামুক্ত। কিন্তু এরূপ মুবাহ কথা-বার্তায় মজে থাকাও নিরাপদ নয় কারণ তা অনেক সময় বহু অনর্থের পথ খুলে দেয়। আপাত, নির্দোষ কথাটি কোনো এক পর্যায়ে জনসমাজে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিরও সৃষ্টি করতে পারে।

কেউ মানুষকে চমকে দেবার হুজুগ থেকে কেউবা আরও দূরপ্রসারী অসৎ উদ্দেশ্যে গুজবের জন্ম দেন। বাতাসেরও আগে যা ছড়িয়ে যায় পুরো সমাজে। মানুষের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ভুল বুঝাবুঝি এমনটি বড় রকমের হাঙ্গামাও তৈরি হতে পারে একটি গুজবের ওপর ভর করে। বিশেষ কোনো অবস্থায় উত্তেজিত জনসাধারণকে উস্কে দেবার মতলবে কোনো কোনো দুরাচার একটি মিথ্যা, মুখরোচক ও পিলে চমকানো তথ্য রাষ্ট্র করে দিয়ে গোটা সমাজে ভয়াবহ অস্থিরতা এমনকি পারস্পরিক সংঘাতের অনুঘটক হিসেবে সকলের সর্বনাশ ঘটাতে পারে। সাধারণত সমাজে স্থির মেজাজ, প্রজ্ঞাবান, চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ লোকের তুলনায় অস্থিরমতি, অশিক্ষিত, আবেগপ্রবণ ও অদূরদর্শী মানুষের সংখ্যা বেশি। সমাজের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে ঝোপ বুঝে কোপ মারার জন্যে কিছু নষ্ট চিন্তার মানুষ ওঁতপেতে থাকে। তাদের পাঁতা গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে সমাজের তরুণদের, রগচটা, আবেগী মানুষগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যার ফলাফল অধিকাংশ সময় শুধু নেতিবাচক নয়; ধ্বংসাত্মক হতে পারে।

যুদ্ধ বা দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষ এরূপ গুজবে নির্বিচারে বিশ্বাস করে বসে। তথ্য-প্রযুক্তির এ স্বর্ণযুগেও গুজবের কদর কমেনি বরং বরাবরই তা হটকেকের মর্যাদায়। আবিষ্কার-উদ্ভাবন আর বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের জন্যে আমরা বুক ফুলিয়ে অহঙ্কার করে বেড়ালেও এই প্রযুক্তিকে আমরা হীনউদ্দেশ্যে গুজব ছড়িয়ে দেবার শক্তিশালী হাতিয়াররূপে ব্যবহার করি। মানুষের তথ্য প্রাপ্তির প্রধান অবলম্বন হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকা যেখানে হওয়া উচিত বস্তুনিষ্ঠ, নির্মোহ এবং সত্যাশ্রয়ী সেখানে আজকের সমাজের প্রধান চিত্রই কি এর বিপরীত নয় ?

কুরআন-সুন্নাহর বাহক, প্রচারক, গবেষক ও ভাষ্যকার ইসলামী জীবনাদর্শের বাস্তব নমুনা আলিমসমাজ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে নিজগুণেই সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। এ সম্মান কারও দয়া বা অনুকম্পা নয়; চরিত্রবলেই অর্জিত অধিকার। সমাজের একটি সুবিধাবাদী অথচ লঘিষ্ঠ অংশ দেশ, জাতি ও স্বধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সুবাদে যুগে যুগে ভিন্দেশি প্রভুদের উচ্চিষ্টে বিলাসী জীবনযাপনের পাশপাশি নানা আনুকুল্য কাজে লাগিয়ে আলিম-ওলামা, ইমাম-খতিব ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জনসমাজে হেয়প্রতিপন্ন এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর সব রকম চেষ্টা-কৌশলে লিপ্ত ছিল। সাধারণত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরত্বে অবস্থানরত এসব আলিমের নেতৃত্বে সর্বস্তরের মু’মিন-মুসলমান নিজেদের ধর্মীয় মর্যাদার অবমাননার প্রশ্নে একাট্টা হয়ে যায়। কারণ তাদের বিশ্বাস; ওলামায়ে কেরাম ইসলামের মর্যাদা ও আদর্শকে সমুন্নত রাখার বেলায় সবসময় নিঃস্বার্থ, নিষ্ঠাবান, নিরাপস ও বিশ্বস্ততার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত।

কোনো অদৃশ্য পক্ষ তাদের বিশেষ লক্ষ্য বাস্তবায়নে আলিমসমাজকে বিতর্কিত করার নানা চক্রান্ত করতেই পারে। সমান্তরালে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে ওদের এদেশীয় কোনো বরকান্দাজ। রাজনৈতিক অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম আলিমসমাজের চরিত্রে কালিমা লেপনের হীনমানসে নিম্নরুচি অপবাদ ও ভয়াবহ কোনো গুজবও ছড়াতে পারে তাদের বিরুদ্ধে। একজন নিষ্ঠাবান মুসলমানের ঈমানের দাবি, দলান্ধ ভাবনার গড়পড়তা চিন্তার স্রোতে গা না ভাসিয়ে ঈমান, ইসলাম, ন্যায়-ইনসাফ ও সত্যের পক্ষে থাকা।

প্রতিপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন বা ঘায়েল করতে তথ্যযুদ্ধ আজকের দুনিয়া খুবই চর্চিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকতার মতো দায়িত্বপূর্ণ একটি পেশা যার ওপর কখনো ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতির জীবন-মরণ অনেকাংশে নির্ভর হয়ে পড়ে সেখানেও পক্ষপাত আর দলান্ধ ভাবনার কাছে সত্য, বস্তুনিষ্ঠতা, কল্যাণচিন্তা আর মানবতা প্রচন্ড রকম হোঁচট খাচ্ছে। ইসলামি দৃষ্টিকোণে সমাজের একজন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে যেখানে লোকের মুখে শুনলাম, অমুক বলছে, অনেকেই তো বলে ইত্যাদি ধাঁচের সূত্রে কোনো খবর বর্ণনা বা বিশ্বাস করার সুযোগ নেই। সেখানে বিবেকের দর্পণ, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম এবং জাতির বিবেকরূপ সাংবাদিকরা বাস্তব তথ্য-উপাত্ত ছাড়া নিজের মতাদর্শগত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অসত্য, অর্ধসত্য, বিকৃত, ভিত্তিহীন বা দুর্বল ভিত্তির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্ট প্রকাশ করে নৈতিকতার বুনিয়াদ ধ্বসে দিচ্ছেন না ? জাতি, নতুন প্রজন্ম, নিজের বিবেক বা ইতিহাসের কাছে কী তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই ?

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এমন সংবাদ যার বিপক্ষে যায় তা ছাপানোর আগে সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাছে ফোন করে মতামত বা বক্তব্য নেয়া হয়। খবরের সঙ্গে তার বক্তব্যও প্রকাশ করা হয়। আমাদের পর্যবেক্ষণ হল, কথাটি সত্য তবে কোনো ক্ষেত্রে চাতুর্যপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, প্রতিবেদনের পক্ষে অকাট্য, নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত না থাকা সত্ত্বেও পত্রিকার অঘোষিত সম্পাদকীয় নীতির পক্ষে হওয়ায় প্রতিবেদকের শিরোনাম ও বর্ণনা ইত্যাদির বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের বক্তব্যটি ক্ষুদ্র ও দায়সারাভাবে উল্লেখ করা হয়। তবে প্রতিবেদকের পক্ষে শক্তিশালী তথ্য-প্রমাণ থাকলে জনস্বার্থে সত্যের প্রকাশ সংবাদপত্রের দায়িত্বের আওতায় পড়ে। তখন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে এরূপ সংবাদ প্রকাশ না করে চেপে যাওয়াটা ভীষণ খেয়ানত। বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।

স্রেফ ব্যক্তিগত দ্বন্ধ, মতাদর্শগত বৈপরিত্য কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে কাউকে অপবাদ দেয়া, কারো বিরুদ্ধে প্রচারিত অপবাদ যাচাই-অনুসন্ধান বিশ্বাস করা আর অন্যদের বলে বেড়ানোর মধ্যে বিকৃত আনন্দ আর রসনা তৃপ্তি মিলতে পারে, এতে ধর্মীয়, সামাজিক, মানবিক কল্যাণচিন্তার প্রতিফলন নেই। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এরূপ ব্যক্তি অবিশ্বস্ত ফাসিকের পরমজন’ বিবেকের দায়বোধ থেকেও যার মুক্তি নেই।

খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ

বিষয়: বিবিধ

১৩৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File