একজন বিতর্কিত আনোয়ার হোসেন !
লিখেছেন লিখেছেন শাহেদ তাসলীম শাহাদাত ০৩ মার্চ, ২০১৩, ০৫:০৮:০৮ বিকাল
আজন্ম আওয়ামীবিরোধী এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা থেকে উত্খাত করার স্বপ্নে বিভোর অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন এখন আওয়ামী লীগেরই বড় তোষামদকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ণচোরা শিক্ষক হিসেবে পরিচিত এই আনোয়ার হোসেন এতোটাই আওয়ামীবিদ্বেষী ছিলেন যে, ওই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বিভিন্ন প্লাটফর্মের মধ্যে আওয়ামীবিরোধী শিবির হিসেবে পরিচিত বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাদা দলের এক সময়ের শুধু নেতাই ছিলেন না, হালুয়া-রুটিরও ভাগ নিয়েছিলেন সেখান থেকে; হয়েছিলেন সিন্ডিকেট সদস্যও।
পরে ভোল পাল্টে গ্রহণ করেন নীল রঙ। ত্যাগ করেন সাদা। এরপর বনে যান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিরোধিতায়। শিক্ষক হয়েও আজন্ম অস্ত্র ও বারুদ এবং রক্তের গন্ধ শোঁকার বিকৃতরুচির এই মানুষটি বিপ্লবের মোড়কে উগ্রপন্থা আর সন্ত্রাসবাদী অনুগামী-অনুসারী ছিলেন।
স্বাধীনতার পর থেকেই এই গোষ্ঠী সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর স্বল্পসময়ের জন্য জাসদ জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। গণবাহিনী অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলে তত্কালীন সরকার কর্নেল তাহেরসহ জাসদ নেতাদের গ্রেফতার করে। কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করার কৌশল হিসেবে আনোয়ার হোসেন ও তার ভাই ওয়ারেস হাসান বেলালসহ জাসদের গণবাহিনীর সদস্যরা ঢাকায় নিযুক্ত তত্কালীন ভারতীয় হাইকমিশনার সমর শেনকে অপহরণের ব্যর্থ চেষ্টা করে।
ওই ঘটনায় তত্কালীন ভারতীয় হাইকমিশনার আহত হয়েছিলেন। পরে সন্ত্রাসবাদীর দায়ে অন্যদের সঙ্গে অধ্যাপক আনোয়ারকে প্রায় ৫ বছর জেলের ঘানি টানতে হয়েছে। ওই ব্যক্তি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার পরও গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতিদের সামনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দিকে তেড়ে যান। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে সচেতন মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে একজন দণ্ডপ্রাপ্ত অসহায় আসামির প্রতি কেমন করে এ আচরণ করতে পারলেন। এই যদি হয় একটি সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিসির আচরণ, তাহলে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে। আর গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশের পর জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কে এই বিতর্কিত আনোয়ার হোসেন!
অধ্যাপক আনোয়ারের যুদ্ধংদেহী মনমানসিকতার তথ্য নিজেই নিজের প্রকাশিত ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী’ এবং ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের’ গ্রন্থে বিবৃত করেছেন। আগামী প্রকাশনী থেকে প্রথম গ্রন্থটি ২০১০ এবং দ্বিতীয়টি ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থে নিজের বর্ণচোরা ও সুবিধাবাদী চরিত্রের অনেক দিক চাতুর্যের সঙ্গে সুকৌশলে এড়িয়ে যান। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ভুল বোঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন সেনা সদস্যের সঙ্গে যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, সেখানে আগুনে ঘি ঢালেন এই আনোয়ার হোসেন। আহত না হওয়া সত্ত্বেও পা ব্যান্ডেজ করে সেনাবাহিনীকে জনগণের সামনে হেয় করার হীন মানসিকতা থেকে পর্যন্ত পিছপা হননি তিনি। খেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সেনা সদস্য ও ছাত্রের কথা কাটাকাটির মতো তুচ্ছ ঘটনাকে মহীরুহে পরিণত করা হয়। আর এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক এই আনোয়ার হোসেন। তিনি ছাত্রদের মাঝে উত্তেজক ও অসত্য নানা বক্তব্য তখন দিয়ে যাচ্ছিলেন। ছাত্র ও সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। এ অপরাধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে গ্রেফতার হন। এরপর ঘটান আরেক ন্যক্কারজনক ঘটনা। বাংলাদেশের সব স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছোট করে প্রকাশ্যে সৈনিক এবং অফিসারদের কাছে করজোড়ে মাফ চান। এর মাধ্যমে অবশ্য স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী আমাদের গর্বিত ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিজের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভাইয়ের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন শুরুতে জাসদ ও গণবাহিনীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি তার নিজের জবানিতেই লিখেছেন—অস্ত্র, বারুদ আর রক্তের প্রতি তার নেশার কথা। তার দুটি বইয়ে মোট পৃষ্ঠা রয়েছে ৩৩৪টি। এর ছত্রে ছত্রে কোথাও আওয়ামী লীগ, কোথাও শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমানবিরোধী কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে—তথাকথিত বিপ্লবের কথার আড়ালে। এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীকে পর্যন্ত ছোট করতে ছাড়েননি। আর এসবই করা হয়েছে ভাই কর্নেল তাহেরসহ নিজের পরিবারের সদস্যদের মহান (!) করে ফুটিয়ে তোলার মানসে। যেমন তার প্রথম গ্রন্থের ১৫তম অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে—‘জন্মলগ্ন থেকেই জাসদ রাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গ ছিল মুজিব সরকারের বিরোধিতা’। ১৯তম অধ্যায়ের ১০৬ নম্বর পৃষ্ঠায় মুজিব সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তত্কালীন কূটনৈতিক পাড়ায় নিজেদের ক্যাডার বাহিনীর পাহারা, প্রয়োজনে দূতাবাসে কর্তাব্যক্তিদের জিম্মি করা, এমনকি দূতাবাসে সামরিক অভিযানের ষড়যন্ত্রের কথা বলা আছে। আর ওই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ভারতীয় তত্কালীন হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি, সমর সেনের গুলিবিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি কাহিনী বর্ণনা করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ওই অভিযানটি পরিচালিত হয়েছিল নিজের ভাই তাহেরকে কারামুক্ত করার লক্ষ্যে। কোনো বিপ্লবী রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যে নয়।
এদিকে আগস্টের ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় এই আনোয়ার হোসেন ২০০৭ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকা মহানগর আদালতের কাঠগড়া থেকে বের হয়ে নিজের উসকানির কারণে সেনাবাহিনীর যে মর্যাদাহানি হয়েছে তার জন্য জোওয়ান থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ অফিসার পর্যন্ত সবার কাছে দুঃখ ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তারপর ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে সমঝোতার মাধ্যমে জেল ও দণ্ড থেকে মুক্ত হয়েই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আবার বিষোদগার করেছিলেন।
শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যক্তি একজন প্রতিক্রিয়াশীল ও স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মতো আচরণ করে থাকেন। নিজের বিভাগের ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের পর্যন্ত নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে নানাভাবে নির্যাতন আর অপছন্দের প্রার্থীদের শিক্ষক হতে প্রতিবন্ধকতা তৈরির লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও শিবির হিসেবে আখ্যা দিতে কুণ্ঠিত হননি। বিগত জোট সরকারের আমলে ছাত্রদলের পদধারী এক নেতাকে পর্যন্ত তিনি শিবির বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। সম্প্রতি জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যু হয়েছে তারই দায়িত্বের অবহেলায়। এতে ক্ষুব্ধ শিক্ষক সমিতি, আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল শিক্ষকরা আন্দোলনে নামলে তাদের পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের দোসর বানাতে তিনি কুণ্ঠিত হননি।
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদী নিজের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শোনার পর আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলতে শুরু করলে ‘কুত্তার বাচ্চা চুপ, একদম চুপ’ বলে তেড়ে যান এই আনোয়ার হোসেন। তিনি শিক্ষক এবং একজন ভিসি হয়েও বস্তিবাসী ও গণিকালয়ের মানুষের ভাষায় গালাগাল করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন মুফাসসেরে কোরআনকে। সব আইন-কানুন, রীতি-নীতি, নৈতিকতা, সভ্যতা-ভব্যতাকে বৃদ্ধাঙলি দেখিয়ে বিচারপতিদের সামনেই এ ধরনের আচারণের ঘটনায় সাধারণ মানুষ হতবাক, লজ্জিত, বিস্মিত ও স্তম্ভিত। অসংখ্য মানুষ আমার দেশ-এ ফোন করে জানতে চেয়েছেন এটা আদালতের প্রতি অসম্মান ও চ্যালেঞ্জ কি-না। ঘটনাটি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার মতো কি-না। এ ঘটনায় আদালত কোনো সুয়োমটো করেছে কি-না তা তারা জানতে চেয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, এই ঘটনায় দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজ্ঞরা পর্যন্ত হতবাক হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ভিসি জানান, ওই ধরনের আচরণ খুবই খারাপ। শিক্ষক হিসেবে তার আদালতে যাওয়া ঠিক হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মুস্তাহিদুর রহমান বলেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি এবং শিক্ষকের কাছ থেকে ওই ধরনের আচরণ প্রত্যাশিত নয়।
নৈতিকতার দিক থেকে একজন শিক্ষক ও ভিসি আদালতে ওই আচরণ করতে পারেন কি-না এ বিষয়ে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি আদালতের বিষয়ে কথা বলতে চাননি। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ‘আপনাদের মতো কিছু পত্রিকায় এমন সংবাদ এসেছে’ বলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
সূত্রঃ আমারদেশ, ০৩/০৩/২০১৩
বিষয়: বিবিধ
৯১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন