গোলমরিচের ঔষধি গুণ
লিখেছেন লিখেছেন প্রিন্সিপাল ০৩ জুন, ২০১৩, ০৩:০১:৪২ দুপুর
মশলার জগতে এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে গোলমরিচ। স্বাদে ঝাল হলেও কাঁচা মরিচ বা শুকনো মরিচের মত গোলমরিচের ঝাল তেমন উগ্র নয়। উপরন্তু একটু সুঘ্রাণও রয়েছে গোলমরিচের ঝালের। একারণে খাদ্যদ্রব্য ও নানা ধরনের তরকারিকে মুখরোচক করতে ব্যবহৃত হয় গোলমরিচের গুঁড়ো। এছাড়া মাছ ও মাংস রান্নার ক্ষেত্রে গোলমরিচের এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এমনকি সুপ, আলুর দম, অর্ধসিদ্ধ ডিম ইত্যাদিকে মুখরোচক করতেও গৃহিণীরা আশ্রয় নেন গোলমরিচের। মরিচের গুঁড়ো সহযোগে তৈরি নাড়ু মজাদারই বটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে গোলমরিচের আদি জন্মস্থান হলো দক্ষিণ এশিয়া। চিরঞ্জীব বনৌষধিতে উল্লেখ রয়েছে যে ভারতের দাক্ষিণাত্যের কানাড়া জেলার জঙ্গলে আগে গোলমরিচ অনাদরে অবহেলায় জন্মাতে দেখা যেত। পরে অবশ্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ওইসব এলাকায় গোলমরিচের চাষ ছড়িয়ে পড়ে। লতা জাতীয় বর্ষজীবী এই উদ্ভিদের জন্যে আমাদের দেশের মাটি বেশ উপযোগী। কারণ যেসব জায়গা সব সময় ভেজা থাকে সেখানে গোলমরিচ ভাল জন্মে। তবু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এর চাষ বিস্তৃত হয়নি। তবে সুখের বিষয় এই যে, শহর বন্দর এমনকি গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় মুদির দোকানে গোলমরিচ পাওয়া যায়। এ কারণে বলা যায় গোলমরিচ এমন একটা উপকারী মশলা যা সব সময় আমাদের হাতের কাছেই পাওয়া যায়।
গোলমরিচের উদ্ভিদগত নাম পাইপার নাইগ্রাম লিন। কেবল তরকারি রুচিসম্মত করার জন্যেই যে গোলমরিচ মশলা হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা নয় আয়ুর্বেদিক মতে ওষুধ তৈরিতেও গোলমরিচ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই হিসেবে গোলমরিচের রয়েছে যথেষ্ট ভেষজগুণ। নিদ্রাহীনতা, টাক রোগ, ঢুলুনি রোগ, বিষাক্ত পোকার জ্বালা, ফিক ব্যথা, গনোরিয়া, ক্রিমি, নাসা রোগ, আমাশয় ইত্যাদি রোগে গোলমরিচের সফল ব্যবহার রয়েছে।
স্থূলদেহী বা হাল্কা পাতলা যে কোন ধরনের মানুষ নিদ্রাহীনতায় ভুগতে পারেন। এক্ষেত্রে একটি গোলমরিচ নিয়ে নিজের মুখের লালায় ঘষে কাজলের মত চোখে লাগাতে হবে (অবশ্য পুরো গোলমরিচটা ঘষে নেয়ার দরকার নেই)। এর দ্বারা নিদ্রাহীনতা চলে যাবে।
যেসব কীটপতঙ্গ কামড়ালে বা হুল ফোটালে জ্বালা করে যেমন বোলতা, ভীমরুল, কাঁকড়া, বিছা, ডাঁস ইত্যাদির জ্বালা দমন করতে গোলমরিচ পানিতে ঘষে তার সাথে 2-5 ফোঁটা ভিনিগার মিশিয়ে হুলবিদ্ধ স্থানে লাগালে জ্বালা প্রশমিত হয়।
কেবল যে মাথায় টাক রোগে চুল ওঠে যায় তা নয়। ভ্রু, গোঁফ, দাড়ি ইত্যাদি লোমশ জায়গায়ও টাক রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে ধানি পেঁয়াজের রস টাকের স্থানে লাগাতে হবে। এরপর ওই জায়গায় গোলমরিচ ও সৈন্ধব লবণ একসাথে বেটে লাগিয়ে রাখতে হবে। দেখা যাবে ব্যবহারের কয়েকদিন পর সেখানে নতুন চুল গজিয়েছে।
অনেকে ঢুলুনি রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। কথা বলতে বলতে মনের অগোচরেই তিনি ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। এই অহেতুক দুষ্ট ব্যাধি দমনে মরিচ বেশ উপকারী। এক্ষেত্রে মুখের লালায় গোলমরিচ ঘষে চোখে কাজলের মত লাগাতে হবে।
কোমরে, পাঁজরে বা ঘাড়ে অনেকের ফিক ব্যথা হয়ে থাকে। এই ব্যথা নিরাময়ে আশ্রয় নিতে হবে গোলমরিচের। গোলমরিচের গুঁড়ো এক বা দেড় গ্রাম মাত্রায় গরম পানিসহ সকালে ও বিকেলে খেলে এই ব্যথা উপশম হবে।
এমন অনেক রোগ আছে যেগুলো হঠাৎ আক্রমণ করে থাকে। মূত্রাবরোধ হলো এমন একটি বেদনাদায়ক রোগ। এই রোগে প্রস্রাব একটু একটু হতে থাকে আবার থেমেও যায়। এক্ষেত্রে গোলমরিচ দু'গ্রাম নিয়ে চন্দনের মত বেটে একটু মিশ্রি বা চিনি দিয়ে শরবত করে খেতে হবে।
গনোরিয়া রোগকে আয়ুর্বেদিক মতে বলা হয় উপসর্গিক মেহ। এ রোগে প্রস্রাবের সময় বা পরে অথবা অন্য সময়েও টিপলে একটু পুঁজের মত বেরোয়। এক্ষেত্রে মরিচচূর্ণ 800 মিলিগ্রাম মাত্রায় দু'বেলা মধুসহ খেতে হবে। প্রথমে 2_3 দিন একবার করে খাওয়া ভাল।
শিশুদের ফুলো রোগেও মরিচ উপকারী। অনেক সময় দেখা যায় ঠাণ্ডা হাওয়া লাগলে বা প্রস্রাবের ওপর শিশু শুয়ে থাকলে এমনকি শীতকালে উপযুক্ত বস্ত্রের অভাবে শিশু ফুলে গেছে। এই অবস্থায় টাট্কা মাখনের সাথে 50 মিলিগ্রাম মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে সেটা একটু একটু করে জিভে লাগিয়ে দিতে হবে। শিশু তা চেটে খেয়ে ফেলবে, এতে ফুলোর উপকার হবে।
আয়ুর্বেদিক মতে অগ্নাশয় বা প্যানক্রিয়াস বিকারগ্রস্ত হলে তার পরিণতিতে রসবহ স্রোতের বিকার উপস্থিত হয়। আর এর ফলে জন্ম নেয় ক্রিমি। এর দরুন 2 থেকে 7-8 বছরের ছেলেমেয়েদের পেটের উপরের অংশে (দু'ধারের পাঁজরের হাড়গুলোর সংযোগস্থলের নিচে) মোচড়ানি ব্যথা হয়। এর ফলে শিশুর মাথা একটু বড় হয়ে যায়। মুখ দিয়ে পানি ওঠে না। যখন তখন পেটে ব্যথা ধরে। এক্ষেত্রে এই বয়সের বাচ্চাদের জন্যে 50 মিলিগ্রাম মাত্রায় মরিচের গুঁড়োর সাথে একটু দুধ মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। দরকারবশত সকাল বিকাল দু'বেলাই খেতে দেয়া যায়।
নাসা রোগ ভয়ঙ্কর না হলেও ছোট নয়। এর লক্ষণ হলো: প্রথমে নাকে সর্দি, তারপর নাক বন্ধ হয়। কোন কোন সময় কপালে যন্ত্রণা হয়। ঘ্রাণশক্তির হ্রাস ঘটে। দুর্গন্ধও বেরোয় মুখ থেকে। খাবারের রুচি থাকে না। কারও কারও ঘাড়ে যন্ত্রণা হতে শুরু করে। আবার নাক দিয়ে রক্তও পড়ে। এক্ষেত্রে পুরনো আখের গুড় 5 গ্রাম, গরুর দুধের দই 25 গ্রাম এবং সেই সাথে এক গ্রাম মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে সকালে ও বিকেলে দু'বার খেতে হবে।
কথায় বলে লোভে পাপ আর পাপে মৃতু্য। খাওয়ার সময় লোভ সামলানো যায় না। আবার খেলেও হজম হয় না। একটু তেল, ঘি জাতীয় গুরুপাক জিনিস খেলে তো কথাই নেই। গলা, বুক জ্বালা করবে, অম্বলের ঢেকুর উঠবে। তারপর বমি হবে। কোন সময় এই ক্ষেত্র উপস্থিত হলে খাওয়ার পরই গোলমরিচের গুঁড়ো এক গ্রাম বা দেড় গ্রাম মাত্রায় পানিসহ খেতে হবে। এর দ্বারা সেদিনকার মত নিষকৃতি পাওয়া যাবে।
অনেকে প্রায়শই আমাশয় রোগে ভুগে থাকেন। আমাশয় হলে অনেক সময় আম বা মল বেশি পড়ে না। কিন্তু শুলুনি বা কোঁথানি থাকে যথেষ্ট। এক্ষেত্রে মরিচচূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকেলে দু'বার পানিসহ খেতে হবে। এর দ্বারা আমদোষ 2-3 দিনের মধ্যেই চলে যাবে।
পেট গরম হলে অনেকক্ষত্রে কাশি দেখা দেয়। এ ধরনের কাশিতে সর্দি উঠে যাবার পর একটু উপশম হয় কিংবা পানি খেয়ে বমি হয়ে গেলে সেই কাশির উদ্বেগটা চলে যায়। এই অবস্থার সৃষ্টি হয় অগ্নাশয়ের বিকৃতি থেকে। এক্ষেত্রে গোলমরিচ গুঁড়ো করে কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে সেই গুঁড়ো এক গ্রাম মাত্রায় নিয়ে একটু গাওয়া ঘি ও মধু মিশিয়ে অথবা ঘি ও চিনি মিশিয়ে সকাল থেকে মাঝে মাঝে একটু একটু করে 7/8 ঘণ্টার মধ্যে এটি চেটে খেতে হবে।
এখন বোঝা গেল গোলমরিচ মানুষের দেহের জন্যে কত উপকারী। আমাদের দেশে গোলমরিচের চাষ ব্যাপকভিত্তিতে করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুস্থ রাখুন। আমীন
বিষয়: বিবিধ
২৭৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন