আমার প্রিয় নাগরিক কবি, বাংলাদেশ তোমায় স্বপ্ন দ্যাখে
লিখেছেন লিখেছেন সুমন আখন্দ ২৩ মে, ২০১৫, ০৯:৩৫:০৯ সকাল
২০০৬ আগস্টে চলে গেছেন প্রিয়কবি শামসুর রাহমান (জন্মঃ ২৩ অক্টোবর, ১৯২৯ খৃস্টাব্দ মৃত্যুঃ ১৭ আগস্ট, ২০০৬ খৃস্টাব্দ)। এটাও মানি, কবির মৃত্যু নেই- প্রয়াণ দিয়ে তিনি সবার প্রাণে উঠে আসেন, এবং এটাই তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষীত ও স্থায়ী আসন।
সেই ছোটবেলা হতে তিনি আমাদের সংগে আছেন, আমরা যখন হতে পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দ্র-নজরুল পড়ি তখন হতে শামসুর রাহমানকেও পড়ি। বড় বড় কবিদের সাথেই তিনি আমাদের অন্তরে ঢুকেছেন। তারপর ইশকুল কলেজ পাস করেছি সেখানেও ছিলেন তিনি। পরীক্ষা পাস করার জন্য আমরা লিখেছি, ‘আলোচ্য অংশটুকু খ্যাতিমান কবি শামসুর রাহমানের ট্রেন/স্বাধীনতা তুমি/একটি ফটোগ্রাফ কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে’। বড় হয়ে জেনেছি এবং পড়ে পড়ে আবিস্কার করেছি বাঙালী জাতীয় জীবনে তাঁর অবদানের কথা। কালোত্তীর্ণ কবিদের যেমন হতে হয় তিনি ছিলেন তেমন; মানবদরদী, সাম্যবাদী এবং আগাগোড়া একজন প্রগতিশীল মানুষ। বাঙালী এবং বাংলাদেশীদের জন্য তাঁর প্রগাঢ় মমত্ববোধ ছিল বলেই সকল আন্দোলন-সংগ্রামের বীজমন্ত্র লিখে গেছেন ‘রৌদ্র করোটিতে’(১৯৬৩), ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’(১৯৬৭), ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘বন্দী শিবির থেকে’(১৯৭২), ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’(১৯৭৫), ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’(১৯৭৭), ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’(১৯৮২) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে। গ্রন্থপ্রকাশ বা কবিখ্যাতি বিচার করলে প্রতি দশকে অনেক কবি আনাগোনা করেন কিন্তু কাব্য সাধনার ব্যক্তিক ইতিহাস মনে রাখলে তাকে একটি দীর্ঘধারা না বলে উপায় নেই।
“যদি বাঁচি চার দশকের বেশি
লিখবো।
যদি বাঁচি দুই দশকের কম
লিখবো।
যদি বেঁচে যাই দু’চার বছর
লিখবো।
যদি বেঁচে যাই একটি বছর
লিখবো।
যদি বেঁচে যাই এক মাস কাল
লিখবো।
যদি বেঁচে যাই একদিন আরো
লিখবো।”
কবিতায় যে কথা দিয়েছেন শামসুর রাহমান তা রেখেছেন; বাংলা আধুনিক কবিতার প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও প্রায় ছয় দশক ধরে তিনি কাব্য-সাধনায় ব্রতী থেকেছেন। তিনি বিশ্বাস রেখেছেন সেসব কবিতায় যেগুলো মানুষের জীবন সংগ্রামকে স্বীকার করে, দশজনের জীবন-ভাবনা উপলব্ধি করে, বিপদে বা সংকটে বন্ধুর মতো এগিয়ে আসে, বিপদ কেটে গেলেও পাশে থেকে উৎসাহ যোগায়। অবিরাম লেখার মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার কেন্দ্র করে গেছেন ঢাকা শহরকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেঁটেছেন কখনওবা দৌড়িয়েছেন। এজন্য তাঁকে কোন দশকওয়ারী ভাগে ফেলে সুবিধা করা যায় না; বরং সুবিচার করতে গেলে বলতে হয় তিনি সব যুগের সাথেই সমান মানানসই। আধুনিক কবি, প্রধান কবি, সর্বপ্রধান কবি, অন্যতম কবি, তারুন্যের কবি, প্রেমের কবি, মুক্তিযুদ্ধের কবি -এসব অভিধা ছাড়িয়ে সবচে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তিনি নাগরিক কবি। নগরের কোলে জন্মেছেন এবং নগরের বিছানায়ই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। নাগরিক কবি নীলকন্ঠের মতো তাঁর কন্ঠে ধারণ করেছেন শহুরে জীবনের ক্লেদ, ক্লান্তি, কষ্ট, জটিলতা, নিঃসঙ্গতা, ব্যর্থতা ও হতাশা। রাজধানী ঢাকার তিলোত্তমা নগরী বা মেগাসিটি হয়ে ওঠার ইতিহাস ও চিত্র যেন শামসুর রাহমানের কাব্যগাঁথা। কমনীয় ও স্নিগ্ধ-শহরটি কি করে কর্কশ-নগর হয়ে উঠলো, বাসা-বাড়ি হতে কি করে মমত্ব ও মানবিকতা হারিয়ে গেল তার দলিল পাওয়া যাবে শামসুর রাহমানের কবিতায়। এই শহরের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রপঞ্চের পালাবদল ও পটপরিবর্তনকে তিনি দারুন দক্ষতায় তুলে এনেছেন কবিতায়- নির্মান করেছেন কাব্যিক ইতিহাস ও ছন্দময় চিত্র। নগরের মাঝে থেকে কবি বলে ওঠেন-
“শহরের সব দুঃখ আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে
গাঁথা, আমি দুঃখের বাইরে চলে যেতে চেয়ে আরো
বেশি গাঢ় দুঃখের ভেতরে চলে যাই, যেন কোন
একা আদি মানবের বেলাশেষে নিজের গুহায়
নিঃশব্দ প্রস্থান”
ঢাকা শহরের মানুষের বিষাদ ও বিক্ষোভ, হতাশা ও হুংকার, শোষণ ও সংগ্রাম তাঁর কাব্যে স্থান পেয়েছে। অবশ্য নগর জীবন বর্ণনার পাশাপাশি তাঁর কাব্যে উঠে এসেছে সনাতন ও গ্রামীণ বাংলাদেশের জীবন ও প্রকৃতির মমতা বিজড়িত চালচিত্র। দৈনন্দিনের শব্দ, উপমা ও অলংকারের সন্নিবেশে শামসুর রাহমানের কবিতা সমৃদ্ধ। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিবর্তনের পর ছন্দ সচেতনতার সঙ্গে গদ্যভঙ্গি মিলিয়ে তিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব বলয়- নিজস্ব কবিভাষা। এ কবিভাষায় আছে বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ শব্দসম্ভার। আমার মনে হয় বাংলা ভাষায় এমন কোন চলতি শব্দ নেই যা শামসুর রাহমানের কবিতায় অন্তত একবার ব্যবহৃত হয়নি। সাম্প্রতিককালে অনেককেই রাহমানীয় ভাষায় লিখতে-পড়তে দেখি, আমি নিজেও মাঝেমাঝে লেখার চেস্টা করি। মনে হচ্ছে- এ কবিভাষার অনুশীলন অনেকদিন থাকবে, যেমনটি ছিল রবীন্দ্র যুগে অথবা নজরুল যুগে।
রবীন্দ্র-নজরুল যদি বাংলা সাহিত্যের এরিস্টটল-প্লেটো হন তাহলে শামসুর রাহমান অন্তত ফুঁকো বা দেরিদা। তিনি সর্বত্রগামী হতে পারেননি সত্য- আবার যদি বলি হতে চাননি সেটাও কী অসত্য? তিনি গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, গান রচনা করেছেন, আত্মজীবনী লিখেছেন, কলাম-প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, শিশুতোষ রচনা করেছেন; কিন্তু সবকিছুর পরে নিজ গৃহে ফেরার মতো করে আবার কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছেন। এই ফিরে আসা আসলে কোন মোহে নয় বরং আত্মার টানে কারণ তিনি ছিলেন সহজাত কবি। আর সব বিষয় নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও সবাই নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন- কবিতার ব্যাপারে যে অবদান তিনি রেখে গেছেন তা অনেক উচ্চের। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ষাটটি, কবিতার সংখ্যায় তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন, আর কবিতার মানের ব্যাপারে তিনি নিজেই বলে গেছেন- ‘আমি যখন থাকবো না তখন সবাই বুঝবে কবিতায় কী রেখে গেলাম’। কবিতার বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন রাজনীতি, দেশপ্রীতি, মানবিক চেতনা, প্রেম-বিরহ ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা কবিতায় তিনি এমন সব উপলব্ধিকে আনলেন যা বহুদিন ধরে আমাদের চারপাশে থেকেও গোপনে বাস করতো, সবার মাঝে থেকেও অধরা ছিল। জানা জিনিসগুলোকে আমাদের সামনে এনে চিনিয়ে দিলেন, আমাদের চৈতন্যে বোধোদয় হলো- ‘এভাবে এসব নিয়েও কবিতা লেখা যায়!’। সমাজের আর দশজনের জীবন ভাবনার সাথে কবির জীবন ভাবনাও একইরকম হতে পারে তা জানলাম তাঁর কবিতার পঠনপাঠনে। জাতীয় জীবনকে ধারণ করেই তিনি বলেন-
“কি যুগে আমরা করি বাস। এখন প্রতিটি ঘরে
মিথ্যা দিব্যি পা তুলে রয়েছে বসে; প্রহরে প্রহরে
পাল্টাচ্ছে জামা জুতো।”
যুগের ভাবনা কবিকন্ঠে সোচ্চার হয়েছিল, সবাই যা আবছাভাবে বুঝেছিল অথচ বলতে পারে নি, শামসুর রাহমান তা গুনগুন করে গেয়ে গেছেন। এ গান আমি এবং আমরা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শুনে যাব।
বিষয়: বিবিধ
১৯৩৪ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কবি শামসুর রহমান যদি রাজনিতির মাঠে বেশি আগাতে চেষ্টা না করতেন সেক্ষেত্রে তিনি আরো বিখ্যাত হতেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন