আমার প্রিয় লেখকঃ কাজী নজরুল ইসলাম
লিখেছেন লিখেছেন সুমন আখন্দ ১৭ মে, ২০১৫, ০৬:২৯:৩৭ সন্ধ্যা
বাংলা কাব্যের ভিত হাজার বছরের লাখো কবির শ্রমে নির্মিত। সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে সসংকোচে কাব্যের যে যাত্রা শুরু তা বর্তমানে অগণিত কবির কলকাকলিতে মুখর হয়ে বিচিত্র চিত্রে উপনীত। বাংলা কাব্যধারার সবচেয়ে ব্যতিক্রমী স্রোতের জনক, বাইশ বছরের ছন্দ সাধনায় যিনি নতুন যুগের প্রবর্তন করেছেন, ঘুমন্ত জাতিকে ঘোরাচ্ছন্ন যুবশক্তিকে ছন্দের চাবুক মেরে জাগিয়েছিলেন; যিনি প্রমত্ত প্রেমিক হিসেবে যার দীপ্র আবির্ভাব তিনি কবিতার দ্রোহীমুখ কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।
নম নম নম বাংলাদেশ মম
চির মনোরম চির মধূর
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নুপুর
দারুন দেশপ্রেম মনেপ্রাণে থাকলেও তিনি কখনো খণ্ডিত হননি বরং পূর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে তিনি কাজ করে গেছেন পুরো সাহিত্যজীবনে।
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন মনি হিন্দু তাহার প্রাণ
এভাবে দেখার পরেও জীবদ্দশায় নজরুলকে প্রাণে-মনে গ্রহণ করেছে এমন লোক ছিল হাতে গোনা; হিন্দুরা তাঁকে ‘যবন’ এবং মুসলমানেরা ‘কাফের’ আখ্যা দিয়েছিল। এদের উত্তরসূরী এখনও আমাদের মাঝে বিদ্যমান। বছরখানেক আগে জোট সরকারের অন্যতম শরীক দলের জনৈক এমপির বয়ানে শুনেছিলামঃ ‘দেব খোঁপায় তারার ফুল’ এই গানটি লিখে না-কি কাজী নজরুল ইসলাম ঘোরতর শিরক করেছেন। উপস্থিত মুগ্ধমুখেরাও ‘নাউজুবিল্লা মিন যালেক’ বলে ধুয়া তোলে। আমি মূর্খের মত চুপ থেকে বেঁচেছিলাম, এদের কে বুঝাবে উপমা-রূপক-অলঙ্কারের কথা। হুমায়ুন আজাদের মত সাহসী আজ আর নেই- আছে হাঁটু কাঁপা ভয়, বুঝাতে গিয়ে যদি বোমা খেতে হয়! এটা তো গেল গোলকের একটা দিক, আবার উল্টো ঘটনাও আছে- বহাল তবিয়তে। আমার মত অনেকে নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন, ইদানিং জোরপূর্বক বিভিন্ন মিডিয়ার খাৎনায় তাঁকে খন্ডিত করে কেবল মুসলমানের কবি বানানোর অপচেষ্টা চলছে। বস্তুতঃ গবেষকরা তো বটেই, সাধারণ নজরুল-পাঠকরাও অবশ্যই বিস্মৃত হননি যে, তিনি আসলে সব কালের সব স্থানের সব মানুষের কবি। এ ব্যাপারে নজরুলের নিজস্ব উপলব্ধিও এমন; হুবহু মনে নেই তাঁর কোন একটা লেখায় এ রকম একটি বক্তব্য পড়েছিলাম- ‘এ অঞ্চলে জন্মেছি বলে তোমরা ভেবো না আমি শুধু এ জনগোষ্ঠীর, বরং আমি সকল দেশের সকল মানুষের’। সাম্যের গান গেয়ে তিনি চেয়েছেন নারী আর পুরুষের সমতা আনতে, মানুষের মাঝে ভেদাভেদের দেয়াল ভাঙতে। মানবতাবোধের আধেয় হতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর রচনায় আদম, দাউদ, ঈশা, ইব্রাহীম, মোহাম্মদের পাশাপাশি পাওয়া যায় রাম-কৃষ্ণ-দূর্বাসা, বুদ্ধ, নানক কবীরকে। তাঁর চেতনায় পাওয়া যায় বিবেকানন্দ, আফগনী, মোহাম্মদ আলী, সান ইয়াৎসেনকে। তিনি কাব্যে প্রয়োগ করেছেন ভারতীয় পূরাণের শিব-দূর্গা-লক্ষ্মী, মধ্যপ্রাচ্যের ফেরাউন-নমরুদ, লাইলী-মজনু, এবং গ্রীক পূরাণের অর্ফিউস-এ্যাপোলো-কিউপিডকে। তাঁর জীবনমুখী কবিতাগুলোতে যেমন আছেন প্রত্যয়বাদী নবী ও অবতারবৃন্দ, তেমনি আছেন নিরিশ্বরবাদী বুদ্ধদেব, নাস্তিক চার্বাক, নীতিবাদী কনফুসিয়াস, সাধারণতন্ত্রবাদী কামাল পাশা এবং প্যান-ইসলামভাবাপন্ন আনোয়ার পাশা। হামদ-নাথ ও গজলের পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন অজস্র শ্যামা সঙ্গীত ও বৃন্দাবন গাঁথা। নজরুল মানসে হিন্দু-মুসলিম দ্বৈত ঐতিহ্যের অবস্থান দ্বন্দ্বমুখর না হয়ে বরং পরস্পর সম্পূরক হয়েছে- এ অবস্থাটা তাঁর পূর্ণাঙ্গ মনের বিশিষ্টতা; এবং আগের অনেকের চেয়ে আলাদা হয়ে গেছেন এই গুণের কারণে। তাঁর লেখায় খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিক-মজুরের কথা আছে, আবার মালিক-ধণিক-বণিকের কথাও এসেছে সমান্তরালে; নজরুলের চিন্তায় পথের ফকির এবং প্রাসাদের রাজা দুজনই স্থান পেয়েছে; তরুনের জয়গান গাওয়ার পাশাপাশি প্রবীণের সম্মান জানাতে ভোলেননি তিনি; নারী-পুরুষ উভয়েই যথাযথ মর্যাদায় অঙ্কিত হয়েছে তাঁর কাব্যে। এমনি ভাবে খুঁজলে দেখা যাবে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করতে পেরেছেন যা তাকে সমসাময়িক এবং পূর্বসুরীদের থেকে স্বতন্ত্র করেছে। বাংলাভাষাকে তিনি বিশ্বদরবারে গ্রহণক্ষম করে তুলে ধরেছেন, অবলীলায় ব্যবহার করেছেন আরবী, ফারসী, হিন্দী, উর্দু, ইংরেজী ও অন্যান্য ভাষা থেকে। আর এতে করে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে এ ভাষাটি।
কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে আনত শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং স্মরণ করছি অন্নদাশঙ্করের ছন্দে-
‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয় নিকো নজরুল,
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক
বাঙালী বলতে একজন আছে
দূর্গতি তার ঘুঁচে যাক!’
বিষয়: Contest_priyo
১৫৪৫ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লেখাটা স্টিকি হোক, এবং মনোনীত হোক।
শুভেচ্ছা সতত।
তবে শেষ কবিতাটা ভুল হয়েছে!!
নজরুল ও এখন ভাগ হয়ে গেছেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন