জেনির কাছে যাওয়া

লিখেছেন লিখেছেন সুমন আখন্দ ২৮ জুন, ২০১৪, ০৭:৩১:০০ সকাল

হাই-ইশকুলে পড়ার সময় ইমনের কিছু বন্ধু জুটেছিল খৃষ্টান-ধর্মাবলম্বীর। ঢাকার মহাখালীতে একটা জায়গাই আছে, যার নাম খৃষ্টান-পাড়া। মনে আছে, বড়দিন আসলে ‘সান্তা’দের কাছ থেকে চকলেট-চুইংগাম নেয়া, বন্ধুদের মাঝে শুভেচ্ছা-কার্ড ও উপহার বিনিময় করা; সন্ধ্যার পরে সবাই একত্রিত হয়ে নাচ-গান-আনন্দ এবং অবশ্যই অনেক আইটেমের খাওয়া-দাওয়া করা। সব মিলিয়ে দারুন একটা দিন কাটত। ওর কেবলি মনে হত বড়দিনটা এত ছোট কেন? ইমন মুসলিম হলেও বন্ধুরা ওকে ছাড়ত না, বলত- ‘ধর্ম যার যার, আনন্দ সবার’। নটরডেম কলেজে পড়তেন সনেটদা; খুব ভাল গিটার বাজাতেন, আয়রন-মেইডেনের হেবি-মেটাল ইংলিশ গান গাইতেন, অর্থ না বুঝলেও সুরের চিৎকার ভাল লাগত। জয়া খুব ভাল নাচতে পারত এবং নাচাতেও পারত- ক্লাশ সেভেন-এইটে থাকতেই পাড়ার অনেক ছেলেই ওর পিছে ঘুরঘুর করত। জেনি দেখতে একটু কালো ছিল কিন্তু সে ছিল ভাল আর্টিস্ট, সবাই বড়দিনের কার্ড ওকে দিয়ে আঁকিয়ে নিত। এই গুনী মেয়েটি ইমনকে একটা সুন্দর কার্ড দিয়েছিল, ভেতরে গোলাপী-রঙের গোটা-গোটা অক্ষরে লিখেছিল একটি লাইন-

“তুমি কি আমার সারাজীবনের বন্ধু হতে পার না?”

কার্ডটি পাওয়ার পরে ইমন ৩/৪ দিন ইশকুলে যায় নি, ব্যাডমিন্টন খেলতে যেত না, ঘর থেকে বেরোত না পারতে সাধ্যে, কি জানি কি এক ভয়-লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ছিল! শেষে জেনি এসে ওকে মুক্তি দিল-

”আচ্ছা থাক, আপনাকে আর আমার বন্ধু হতে হবে না”

একটি কিশোরী মেয়ের মুখচ্ছবি যেন একজন পরিণত নারীর অব্যক্ত মর্মব্যথা হয়ে ইমনকে ব্যাঙ্গ করতে লাগল।

এর কিছুদিন পরেই ভাড়া-বাসা ছেড়ে দিয়ে ইমনরা চানখারপুলে হাসপাতালের কোয়ার্টারে উঠে যায়। এসএসসি পাশ করে এরপর কলেজে পড়া- বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করা। পড়াশোনা আর নানান ব্যস্ততায় অনেকদিন আর ওদিকে যাওয়া হয় নি। নয়-দশ বছর পরে আইসিডিডিআরবিতে একটা চাকরীর জন্য পরীক্ষা দিতে গিয়ে আবার মহাখালীতে গেল ইমন, পরীক্ষার পরে কিছু সময় হাতে ছিল, হাঁটতে হাঁটতে সে গেল খৃষ্টান-পাড়ায়। আরে বাপস! অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, রাস্তাগুলো দু’পাশের বাড়ির চাপে গলি হয়ে গেছে, চেনা যাচ্ছে না কিছু, ফাঁকা জায়গা বলে আর কিছু নেই। অনেক করে ঘুরে-ফিরে শেষে পৌছল ওখানে। খোঁজ নেয়ার পরে জানা গেল- সনেটদা কলেজ শেষ করে আর দেশে থাকে নি, আমেরিকা চলে গেছেন। জয়াও বিয়ে করে ইংল্যান্ডে সেটেল্ড, আর জেনি নাকি পড়াশোনা বাদ দিয়ে কোন এক চার্চে সিস্টার হিসেবে যোগ দিয়েছে, বছর-তিনেক হল। জেনির বাবা আগেই মারা গিয়েছিল, এরপর মাও মারা যাওয়াতে ওর আর পিছুটান থাকে নি। খৃষ্টান-পাড়ায় ওদের যে বাড়িটা ছিল, সেটাও বিক্রি করে দিয়েছে। ইমনের মনটা ভীষণ খারাপ হল, জেনির সাথে আর দেখা হল না। একটা চায়ের দোকানে আলাপ করতে করতে শুধু একটা ক্লু পাওয়া গেল, ও নাকি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে একটা ক্যাথোলিক চার্চে আছে।

এরপর আরও কয়েক বছর কর্পুরের মত উড়ে গেল, সরকারী চাকরির ব্যর্থ চেষ্টা করে ইমন শেষমেষ ওর পছন্দের পেশায় যোগ দিতে পারল। জনপ্রিয় একটি দৈনিকের সাব-এডিটর হিসেবে সে বেশ ভাল সুনাম করেছে অল্প সময়ে। মারকুটে ব্যাটসম্যানকে স্লগ-ওভারে ক্রিজে পাঠালে যেমন বলে বলে চার/ছয় হয়, তেমনি ইমনও জয়েন করার পর সবার দৃষ্টি কাড়ল। বিভিন্ন জেলায় পত্রিকাটির পাঠক-সংগঠন করা এবং প্রতি সপ্তায় একটি ফিচার পাতা বের করা- এই ছিল কাজ। টোটাল কাজের কথা এক লাইনে বলা গেলেও, এটির মধ্যে অনেক দায়িত্ব, ঝামেলা এবং ঝুঁকি ছিল। কাজ করতে নেমে ঢাকার কেন্দ্রিয় কমিটি হতে একটি সমমনা টিম পেয়ে যায় ইমন, যারা তাকে সার্বক্ষণিক সাহায্য করেছে এবং সাহস যুগিয়েছে। কাজ করতে গিয়ে রাত-দিন ওর ধ্যান-জ্ঞান শুধু পাঠক-সংগঠন ও ফিচারপাতাটিকে নিয়েই ছিল, রাতে ঘুমাতে গিয়েও সে প্ল্যান করতো কোন কোন জেলার সংগঠনগুলো দূর্বল রয়েছে, এগুলোকে কিভাবে চাঙ্গা করা যাবে; সামনের ফিচার পাতাটি কি দিয়ে সাজাবে- এসব নিয়ে। সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে ইমনকে প্রায়ই ঢাকার বাইরে যেতে হত। ওর ভালই লাগত, কাজ করতে করতে দেশের নানান প্রান্তে যাওয়া হচ্ছে, চেনা-জানা লোকের সংখ্যা বাড়ছে, পত্রিকার সার্কুলেশনও বাড়ছে। চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, রাজশাহী- সব বিভাগীয় শহরে পত্রিকার বিক্রি বেড়েছে বলে সম্পাদকসাহেব ইমনকে আরও উৎসাহ দেন, এবং অন্যান্য সাব-এডিটরদের থেকে ওকে বেশি এ্যাকসেস দেন। এমনকি ঢাকার বাইরে কোন প্রোগ্রামে গেলে সাথে করে ওকে নিয়ে যান। এমনি একটি মতবিনিময় সভা হল ময়মনসিংহে, সেখানে সুশীলসমাজ-পাঠক-হকারদের সাথে কাজ শেষ করে সম্পাদকসাহেব ঢাকায় রওনা দিলেন, সাংগঠনিক কিছু কাজ করার জন্য ইমন থেকে গেল। পরের দিন দুপুরের আগেই সব কাজ শেষ হওয়াতে হাতে কিছু সময় ছিল, হালুয়াঘাটে গারোদের গ্রামে ঘুরে আসার কথা প্রস্তাব করল একজন। ইমনও রাজি হয়ে গেল। যেতে যেতে জানা হল, গোবরাকুরা, বিড়ইডাকুনি, রাঙরাপাড়া, জুগলি এবং আরো কতগুলো পাশাপাশি গ্রাম নিয়ে হালুয়াঘাটে মাতৃপ্রধান গারোদের বসবাস। এদের আরেক নাম মান্দি। এরা আগে সনাতন ধর্মের অনুসারী হলেও এখন বেশির ভাগই ব্যাপটাইজড হয়েছে। লোকে বলে, বৃটিশ আমল হতে অনেকগুলো মিশনারী কাজ করছে এখানে। বলা হয়- ময়মনসিংহ শহরে যখন বেজলি-বাতি ছিল না, তখনও হালুয়াঘাটে জেনারেটরের মাধ্যমে বাতি জ্বলেছে, ইশকুল, কলেজ, হাসপাতাল, হেলিপ্যাড নির্মিত হয়েছে। আর এসবই হয়েছে এখানকার চার্চগুলোর কল্যানে। চার্চের কথা মনে হতেই ইমনের হঠাৎ মনে পড়ল জেনির কথা। বুকের মাঝে একটা ক্ষীণ আশা উঁকি দিল, ওর সাথে দেখা হতে পারে, কিন্তু যখনই শুনল ক্যাথোলিক ও প্রটেষ্ট্যান্ট মিলিয়ে এখানে প্রায় ১৮-২০টা চার্চ রয়েছে, তখন আশার বুদবুদ মিলিয়ে গেল। অষ্ফুটে বলল, “জেনি, আমি তোমার সারাজীবনের বন্ধু হতে চাই” এবং এর রেসপন্সেই মনে একটা অলৌকিক বিশ্বাস জন্মাল, প্রথম যে চার্চে ওরা যাবে সেখানেই জেনিকে পেয়ে যাবে। পৃথিবীর সব আশা সে মুহূর্তে ইমনের বুকে ভর করেছিল। মেইনরোডের কাছেই বিড়ইডাকুনী গ্রাম, এখানে একটি বড় চার্চ রয়েছে; চার্চের সাথেই একটি হাই-ইশকুল, সামনে বিশাল মাঠ, মাঠের পাশেই মাছভরা পুকুর, টলটলে পুকুরে লাল-শাপলা। পুরোটাই ফাঁকা ফাঁকা মনে হল, বাগানে কাজ করছিলেন একজন মালি তার কাছ থেকে জানা গেল, প্রার্থনার দিন রবিবার, তখন বেশ লোকসমাগম বাড়ে। ঘোরা হল, ছবি তোলা হল, সাংবাদিক পরিচয় দেয়াতে গির্জার ফাদারের কাছ থেকে কিছুটা এক্সট্রা খাতিরও পাওয়া গেল, কিন্তু জেনির কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল, রাতের মধ্যেই ঢাকায় ফিরতে হবে ইমনকে। আগামীকাল ফিচার পাতার পেষ্টিং, একদিকে কাজের টেনশন অন্যদিকে জেনিকে একবার দেখার জন্য মনের মাঝে আকুলিবিকুলি। ফাদার অবশ্য একটা আশার কথা শোনাল, সিস্টারেরা নাকি অনেকেই নাম পাল্টে কাজ করেন এখানে, তার মানে জেনি হয়তো এখানে অন্য নামে কাজ করছে। ফাদারের কাছে একটা ভিজিটিং কার্ড রেখে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসছিল ইমন। এমন সময় একজন সিস্টার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল, সে হরহরিয়ে যে কথাগুলো বলল, তার সবটা বুঝা না গেলেও মূল ঘটনাটা হল- টয়লেটে পড়ে গিয়ে হোস্টেলের একটা মেয়ের পা ভেঙ্গে গেছে, তাকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। ফাদার বিদায় বলে চলে যাচ্ছিলেন, সিস্টারও চলে যাচ্ছিল, ইমনও পিছুপিছু ছুটল- জেনি ওকে চিনতে পারে নি। সে ঠিকই চিনেছে। হায়-হায় করা হৃদয়ের আকুলিবিকুলি চলে গেছে, এখন আর চিন্তা নেই, সে জেনিকে পেয়ে গেছে। ঢাকায় আরেকটু পরে রওনা দিলেও সমস্যা নেই।

বিষয়: সাহিত্য

৯২৯ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

239528
২৮ জুন ২০১৪ সকাল ০৭:৫৭
নিউজ ওয়াচ লিখেছেন : Thinking Thinking Thinking
239531
২৮ জুন ২০১৪ সকাল ০৯:১১
দ্য স্লেভ লিখেছেন : যদি এটা গল্প হয়,তবে অসাধারণ হয়েছে। পুরো গল্পটি অত্যন্ত চমৎকারভাবে সাজিয়েছেন। ধন্যবাদ
239532
২৮ জুন ২০১৪ সকাল ০৯:১৭
হতভাগা লিখেছেন : জটিলস! আপনি কবিতাও লিখেন সিরাম , গল্পও লিখলেন অসাম !
239542
২৮ জুন ২০১৪ সকাল ১০:০৩
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : সাহিত্যের সকল শাখায় দেখি মাস্টার মশায় এর ভাল দখল আছে।
239559
২৮ জুন ২০১৪ সকাল ১০:৫৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File