সামনে কি শুধুই অন্ধকার !
লিখেছেন লিখেছেন আহমেদ রিজভী ১৭ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:৪১:১৭ রাত
সাত সকালে একই নাম্বার থেকে একের পর এক ফোন কল সিয়ামের আরামের ঘুমটাকে হারাম করেই ছাড়ল । একেত গেরেজ বন্ধ করে ঘুমাতে ঘুমাতে কাল রাত প্রায় দুইটা বেজেছে তার উপর রাতের একরাশ জড়ো বৃষ্টি ও ভোরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট ঠান্ডা পরিবেশ যেখানে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরামছে সুখ নিদ্রার সমস্থ আয়োজন করেছে সেখানে অপরিচিত একটি নাম্বারের বিরামহীন কলিং সব কিছুতে পানি ঢেলে দিয়েছে । প্রথমে কল রিসিভ না করে ফোনটা সাইলেন্ট করে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ার চিন্তা মাথায় আসলেও আবার পরক্ষণে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে মনে মনে কল দাতার চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার পূর্বক একরাশ বিরক্তি নিয়ে সিয়াম কলটা রিসিভ করল । এ প্রান্ত থেকে সিয়াম কিছু বলার পূর্বেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসল কেমন আছিস সিয়াম !
সিয়াম বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে উত্তর দিল ভাল । আপনি কে বলছেন ?
আমি রাশেদ ! চিনতে পারছস ?
চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে সিয়ামের মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসল আরে রাশেদ, তুই ! এতদিন পর কি মনে করে দোস্ত !
আরে না তেমন কিছু না আবার অনেক কিছু , তাছাড়া তুইওত আমাকে এতদিনে একটিবারও স্মরণ করিসনি ?
আরে না মানে ইয়ে.............।
যাই হোক বাদ দে , শুন মোজাহিদ আর শামছ এর সাথে তোর কোন যোগাযোগ আছে ?
কেন ? ওরাত এখন অনেক বড় বড় নেতা ! এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকে তোদের কারো সাথে আমার দেখা সাক্ষাৎ নেই । তবে শামস এর সাথে একবার দেখা হয়েছিল তাও বছরখানেক আগে । ও তখন অনেক বড় ছাত্র নেতা আর আমি একজন গেরেজ মেকানিক মাত্র তাই পরে আর যোগাযোগ হয়নি বা করিনি অবশ্য সেও করেনি ।
আচ্ছা শুন শামছের কোন কন্টাক নাম্বার আছে তোর কাছে ?
হ্যাঁ একটা আছে বছরখানেক আগের এখন ব্যবহার করে কিনা বলতে পারবনা ।
চলবে, ঐটা দে দেখি !
লেখ, ০১৭ . . . . . . . . ।
তোকে ধন্যবাদ । পারলে ওদের সাথে যোগাযোগ করে আমাকে একটু জানাইস তবে ওদেরকে আমার কথা বলিস না । তোকে আবার ফোন দিব ভাল থাকিস ।
আচ্ছা ঠিক আছে ।
ওকে বলে রাশেদ লাইনটা কেটে দিল ।
দীর্ঘ সাত বছর পর রাশেদের কল সিয়ামকে নিয়ে গেল এক সুন্দর ও মধুময় অতীতের কাছে যেখানে সিয়াম, মোজাহিদ, শামছ ও রাশেদ এই চার জন ছিল সহপাঠি ও খুবি অন্তরঙ্গ বন্ধু । সেই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে তাদের বন্ধুত্ব ও গলাগলি । রাশেদ ছেলেটা ছিল প্রখর বুদ্ধী সম্পন্ন ও প্রচন্ড ডানপিঠে প্রকৃতির, যার অভিধানে ডর-ভয় বলে কিছু ছিলনা । ওর গেরস্ত বাবা পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের হেড স্যারের কথায় তাকে শহরের স্কুলে ভর্তি করে দেন । শহরে রাশেদের থাকার ব্যবস্থা হয় ওর চাচার বাসায় । অন্যদিকে মোজাহিদ ছেলেটা ছিল ধীরস্থির ও চিন্তাশীল, স্বিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে সঠিক স্বিদ্ধান্ত গ্রহনকারী । তার বাবা ছিলেন স্থানীয় পৌরসভার সচিব । ব্যবসায়ী পিতার সন্তান শামছ ছিল মেধাবী তবে ভীষণভাবে একরোখা আর রাশেদের মত ডরাই না প্রকৃতির । শহর থেকে কিছুটা দূরে ছিল তাদের বাড়ি যেখান থেকে শামস টেম্পুযোগে নিয়মিত স্কুলে আসা যাওয়া করত । আর শ্রমিক বাবার সন্তান সিয়াম সবার মাঝে ছিল নীরিহ, মেধাবী ও উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন ।
ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে এইচএসসি পরীক্ষার পূর্ব পর্যন্ত চার বন্ধু সিয়াম, মোজাহীদ, শামছ ও রাশেদ একসাথে গলাগলি করে হাসি আর আনন্দের মাঝে কাটিয়েছে ছাত্র জীবনের ছয়টি বছর । এর মাঝে একের সাথে অপরের কখনো কোন প্রকার মান-অভিমান যে হয়নি তা কিন্তু নয় । তবে এমনটা কালে ভদ্রেই দেখা যেত আবার দিনশেষে বা পরের দিন একসাথে ক্লাসের একই বেঞ্চে চারজন সারি বেঁধেই বসত । স্কুল বা ক্লাসের ফুটবল টিমের হোক আর ক্রিকেট টিমের যেকোন খেলায় অথবা যে কোন অনুষ্টানে চারজনের মধ্য থেকে কোন একজনের অনুপস্থিতি সৃষ্টি করত এক বিশাল শুণ্যতার, সর্বত্র তাদের উপস্থিতি ছিল একসাথে একযোগে । স্কুলের হেড স্যার তাদের একতা,অন্তরঙ্গ ও দুরন্তপনা দেখে সেই সপ্তম শ্রেণী থেকে চার জনের এই ছোট্ট দলটার নাম দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছায়াছবি “ওরা এগার জন”এর আদলে “ওরা চতুষ্ঠয়’’ ।
ছেলেকে দেখার জন্য রাশেদের বাবা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার শহরে আসতেন । প্রতিবারই রাশেদের জন্য বাড়ি থেকে কিছুনা কিছু সাথে করে নিয়ে আসতেন । গরমের কালে বাড়ির গাছের আম-কাঠালসহ হরেক রকম ফল-মূল, আর শীতের সময় থাকত রাশেদের মায়ের হাতে বানানো নানান রকমের সুস্বাধু পিঠা । যখনি রাশেদের বাবা বাড়ি থেকে আসতেন তখনি রাশেদ হয় সিয়াম, মুজাহীদ ও শামছকে তার চাচার বাসায় নিয়ে যেত অথবা পরের দিন বাবা বাড়ি থেকে খাওয়ার মত যাই নিয়ে আসতেন তার কিছুটা হলেও বন্ধুদের জন্য স্কুলে নিয়ে আসত । সিয়ামরা সবাই এসএসসি পরিক্ষার পর প্রায় সপ্তাহখানিকের জন্য রাশেদদের বাড়িতে বেড়াতে পর্যন্ত গিয়েছিল সেবার সবাই মিলে অনেক মজা করেছে যা সিয়ামের চোখে এখনো লেগে আছে । বিশেষ করে রাশেদের মায়ের আদর যত্নের কথা ভূলার মত নয় ।
সপ্তাহের ছুটির দিনের বিকালটা নির্ধারিত ছিল শামসদের বাড়িতে বেড়ানোর জন্য । হইহুল্লোর আর ছুটাছুটি করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে আসত টেরই পাওয়া যেতনা ।
মোজাহিদদের বাসাটি ছিল একেবারে স্কুল লাগুয়া । টিফিনের সময় কত যে ওদের বাসায় সবাই মিলে দুপুরের খাবার সেরেছে তার কোন হিসেব নাই । মুজাহিদের মা পরম মমতা নিয়ে ওদেরকে খাওয়াতেন ।
মুজাহিদ, শামছ ও রাশেদ সিয়ামকে নিয়ে তার বাবা যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন তার ভিতরটা ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্রায় দিনই সেখানে হাযির হত । ফ্যাক্টরির অভ্যন্তরের দৃশ্যটা ছিল ঊপভোগ করার মতই মনোরম ।
ওরা চতুষ্টয়ের রঙ্গীন দিনগুলো খুব দ্রুত কেটে গেল । এইচএসসি পরিক্ষা শেষে মোজাহিদ, শামছ ও রাশেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়ে কেউ চলে গেল রাজধানী শহরে কেউবা আবার দেশের অন্য কোথাও । রেজাল্ট পরবর্তী বিদায় অনুষ্ঠানের আবেগঘণ বেদনা-বিধুর মুহূর্তেটির কথা সিয়ামেকে এখনো আবেগাপ্লুত করে তুলে ।
সবাই নতুন স্বপ্ন নিয়ে যার যার পথে পা বাড়ালো, সিয়াম সংসারের চাপে পড়ালেখার পাঠচুকিয়ে কিছুদিন বাবার সাথে ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ নেয় তার দিনকয়েকপর শিক্ষাণবিশ হিসেবে একটি গেরেজে ঢুকে পরে । দীর্ঘ চেষ্টা, সাধণা ও পরিশ্রমের পর কিছু দিন হয় ধার-দেনা করে নিজেই একটি গেরেজ দিয়েছে । কিন্তু দেশের যা অবস্থা ! সরকারী দলের সন্ত্রাসীদের চাঁদার দাবি আর না দিলে গেরেজ জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি, অপরদিকে সরকারের অন্যায় অনাচার ও অপকর্মের প্রতিবাদে বিরুধী দলের যখন তখন কারনে অকারনে হরতাল, ধর্মঘট, অবরুধ আহ্বানের ফলে গেরেজ একদিন খুলা থাকলে দুইদিন বন্ধ রাখতে হচ্ছে এদিকে পাওনাদারদের চাপও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । এক কথায় সিয়ামের এখন দিশেহারা অবস্থা । সব ভাবনাকে পেছনে ফেলে জীবনের প্রয়োজনে নতুন দিনটিকে নতুন করে শুরু করার প্রত্যাশা নিয়ে সিয়াম বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ।
রাশেদের সাথে কথা বলার পর বেশ কিছুদিন চলে গেছে কম করে হলেও পনের-ষোল দিনত হবে ! সংসারের ভার সামালানোর ব্যস্ততা সিয়ামকে রাশেদ, মুজাহিদ ও শামছদের কথা আবারো ভূলিয়ে দিয়েছে । আজ হরতাল থাকায় গেরেজ ছিল বন্ধ সূতরাং কাজের চাপও নেই তাই একটু ফুরসত পেয়ে রাতের খাবার খাওয়ার পর সিয়াম দেশের হালচাল সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার আশায় টিভি অন করে সামনের চেয়ারটিতে বসে পান চিবুচ্ছিল এমন সময় খবরের প্রধান শিরোনামেগুলুর একটি শিরোনাম সিয়ামের হৃতপিন্ডে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে , সিয়ামের মনে হল মুখে থাকা পান যেণ দলা আকারে গলাতেই আটকে গেছে।
খবরে প্রকাশ, “নোমান মোজাহিদ নামে সরকার বিরুধী এক ছা্ত্র নেতাকে গুমের অভিযোগ করেছে তার পরিবার ও দল । এজন্য তারা সরকারকে দায়ী করেছেন । অন্যদিকে সরকার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং তদন্ত করে সত্য উদঘাটনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছে’’ । দিনের পর মাস এরপর বছর চলে যায় সরকারের তদন্তও শেষ হয়না মুজাহিদও আর ফিরে আসেনা । উল্টো এসময়ের মাঝে আরও অনেককেই মোজাহিদের পরিণতি বরণ করতে হয় । পূর্বের ন্যায় কিছুদিন চিল্লাচিল্লি হয় আবার সব আগেরমতই চলতে থাকে কিন্তু মুজাহিদদের গুম হওয়া আর বন্ধ হয়না।
এরিমাঝে একদিন গেরেজে বসে প্রতিদিনের মত দিনের দৈনিক পত্রিকাটিতে চোখ বুলাচ্ছিল সিয়াম । নীচের দিকে সিঙ্গেল কলামে ছাপা হওয়া একটি খবর সিয়ামকে ভীষণভাবে আকর্ষন করে । কালো হরফে লিখা খবরের শিরোনামটি হল “ছাত্র নেতা শামছুল আজীম শামছকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ” । ভিতরে লেখা হয় তার বিরুদ্ধে জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগসহ আনুমানিক দশটি অভিযোগ আনা হয়েছে । আদালতে তার পক্ষে জামীনের আবেদন করা হলেও আদালত তা নামঞ্জুর করে তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ।
এখন মাসখানেক হয় ছাত্রনেতা শামছুল আজীম শামছ জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী । এক মামলায় তার জামীন হলে আরো তিন মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে । তার পরিবার ও দল রিমান্ডে তার উপর ভয়াবহ নির্যাতনের অভিযোগ করেছে ।
দিনতিনেক ধরে পত্রিকা ও টেলিভিশন মারফত সিয়াম শুটার রাশু নামে রাজধানীতে সরকারী দলের এক ক্যাডারের নানান অপকর্মের কথা শুনে আসছে । সবার কাছে নাকি সে “রাশু ভাই” নামে পরিচিত । তার দূরন্ত সাহস ও বুদ্ধি নাকি তাকে সরকারী দলের কাছে অপরিহার্য্য করে তুলেছে । রাজধানীর নামকরা বিশ্ববিদ্যলয় ও এর আশ পাশের এলাকায় তার কথাই নাকি আইন । তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজী, দখল ও ভর্তি বাণিজ্যসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সরকারী দলের ক্যডার হওয়ায় কেউ তার বিরুদ্ধে টুশব্দটি করার সাহস পর্যন্ত করেনা ।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল সিয়ামের । সংসারের চাপের ফলে সৃষ্ট জীবন সংগ্রাম তাকে অন্যসব কিছু থেকে দিনদিন ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিল । দেখতে দেখতে জাতীয় নির্বাচন এসে জনগণকে আবার তাদের রায় জানানোর জন্য দুয়ারে কড়া নাড়ল । এইবার জনগণের রায়ে বিরুধীদল বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করল । সরকারের প্রথম কাজই হল নির্বাচণী অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করা । এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকার দেশব্যাপী টাস্কফোর্স গঠন করে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করল । প্রথম দিনের অভিযানে টিভি পর্দায় ব্রেকিং আকারে খবর এল “ঢাকার ত্রাস খুন ও ধর্ষণ সহ একাধিক মামলার পলাতক আসামী শীর্ষ সন্ত্রাসী রাশেদুজ্জামান খান ওরফে শুটার রাশু পুলিশের সাথে ক্রস ফায়ারে নিহত” । সারা রাত টিভি পর্দায় খবরে ও টকশোতে শুটার রাশু হত্যা নিয়ে চলল আদ্যোপান্থ বিচার বিশ্লেণ । অভিযানে নেতৃত্বদানকারি অফিসার গর্বভরে টিভি পর্দায় তার নেতৃত্ব ও কৃতিত্বের বর্ণণা দিলেন । সরকার দাবি করলেন বাহ বাহ ।
এদিকে টিভি পর্দায় গুলিতে ঝাঝরা শুটার রাশুর বিকৃত ছবি ও ফাইল ছবি দেখে সিয়ামের আর রাশুকে চিনার বাকি থাকল না । একরাশ হতাশা, বুকভরা দুঃখ আর হাহাকার নিয়ে সে তার কক্ষের দিকে পা বাড়াল । লাইট অফ করে ঘুটঘুটে অন্ধকারে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে নির্ভাক দৃষ্টিতে উপরের দিকে চেয়ে থাকল ।
বিষয়: বিবিধ
১৭০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন