শহীদ জেহাদ –গনতন্ত্রের জন্য আত্মাহুতি দেয়া এক বীরের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী
লিখেছেন লিখেছেন উচিত কথা ১০ অক্টোবর, ২০১৪, ০৬:১৬:২০ সন্ধ্যা
আমি এসেছিলাম সামরিক স্বৈর সরকার উতখাতের জন্য। আজ আমি মৃত্যু পথযাত্রী। আমি তার পতন দেখে যেতে পারলাম না। আমার মৃত্যু তখনই স্বার্থক হবে ও আমার আত্মা শান্তি পাবে, যখন আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈর সরকারের পতন হবে –গনতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের উদ্দেশ্যে সম্ভবত এটিই ছিল মৃত্যুপথযাত্রী একজন গনতন্ত্রের বীর সেনানী শহীদ নাজিরউদ্দিন জেহাদের শেষ আকুতি।
রাজধানী ঢাকা থেকে ১৪২ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে মজলুম জন নেতা মাওলানা ভাসানীর জন্মস্থান সিরাজগঞ্জ জেলা। উত্তাল যমুনা আর নীরিহ পদ্মা নদী আর এদের উপনদী দ্বারা বাহিত পলল দ্বারা সৃষ্ট উল্লাপাড়া। আর এ উল্লাপাড়ার বর্ষায় বন্যা প্লাবিত একটি গ্রাম নাম নবগ্রাম। এ নবগ্রামেই অচেনা এক কে এম মাহমুদ এবং বছিরুনেচ্ছা দম্পতির বাস। মোটামুটি সচ্ছল এ দম্পতি ঘরে আসে একে একে মোট দশ সন্তান। ভাই বোনদের মধ্যে নবম সন্তানটির নাম নাজির উদ্দিন জেহাদ ১৯৬৯ সনের ৬ সেপ্টেম্বর যার জন্ম।
‘৬৯ ইতিহাসের অন্যতাম একটি অগ্নিঝরা নাম। এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় (রচনা ১ ফে্ব্রুয়ারী ৬৯) যেন মাযের গর্ভে থাকতেই গনতন্ত্রের এক লড়াকু সৈনিক জেহাদের প্রাতি এক সংগ্রামী আহবান। তারপর ৭১। তখনও জেহাদ মায়ের দুগ্ধপোষী শিশু। শৈশব পেরিয়ে যখন কৈশর, তখন জেহাদের আফসোস মিছিলে বুঝি আর যাওয়া হলোনা! স্বাধীন দেশ এখানে কি জন্য যুদ্ধ হবে আর কেনইবা মিছিলে যেতে হবে। কিন্তু না জেহাদ যখন কৈশর পেরিযে যৌবনে পদার্পন করলো তখন যুদ্ধ ক্ষেত্র তৈরী হয়ে গেল।
সামরিক উর্দিপরা হোমো এরশাদ নামে কোন এক ব্যাক্তি রাতের অন্ধকারে বন্দুক ঠেকিয়ে গনতন্ত্রের বুকে গুলি করে দিলো। রক্ত শূন্যতায় কাতরাতে কাতরাতে দূর্বল হয়ে অবশেষে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লো বাংলাদেশের গনতন্ত্র। আমাকে বাঁচাও বাঁচাও উদ্ধার করো এই সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের বন্দিশালা থেকে, মুক্তি প্রত্যাশায় গনতন্ত্রের এ গগন বিদারী চিতকারে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল যুদ্ধের। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। স্বৈরতন্ত্রকে হটিয়ে গনতন্ত্রকে পূনঃপ্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।
স্বাধীন বাংলাদেশের গনতন্ত্র স্বৈরাচার কবলিত হয়েছে এক মুক্ত করতে হবে। তাই শুরু হলো যুদ্ধ, শুরু হয়ে গেল মিছিল।মিছিলে মিছিলে আহবান করা হলো গনতন্ত্রপ্রেমী যোদ্ধাদের। একের পর এক যোদ্ধারা সমবেত হতে লাগলো। মিছিল বড় থেকে আরো বড় হতে লাগলো। মিছিল যত বড় হতে লাগলো স্বৈরাচারের বুলেটও ততো তপ্ত এবং ক্ষিপ্ত হতে লাগলো। তাই এই তপ্ত বুলেটে একের পর এক ঝরে পড়লো সেলিম-দেলোয়ার,জয়নাল-জাফর,তাজুল, ময়েজ উদ্দিন, তিতাস, কাঞ্চন, বউফুন সুনিয়া, মোজাম্মেল, দীপালি সাহা,শাহজাহান সিরাজ, আবু রায়হান জগলু ,নূর হোসেন, আবুল ফাত্তাহ , কাজী সোয়েব, ক্ষেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, হোটেল কর্মচারী জিকে চৌধুরী, ছাত্র মহিউদ্দিন শামিম, বদরুল, শেখ মোহাম্মদ, সাজ্জাদ হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন ও আলবার্ট গোমেজ, আবদুল মান্নান, কাশেম, ডিকে দাস, কুদ্দুস, পঙ্কজ বৈদ্য, চান মিঞা, হাসান, সমর দত্ত, পলাশ, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, শাহাদাত হোসেন , ডাঃ মিলনসহ আরো জানা অজানা নাম।
নিহতের এ তালিকায় যুক্ত ছিল আরেকজন গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তত্ব স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্রে নিহত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সর্বকালের সেরা সংগঠক মাহবুবুল হক বাবলু। শহীদ নাজির উদ্দিন জেহাদ ছিল তারই উত্তরসূরী। ১৯৯০ সাল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন জেহাদ স্থানীয় সরকারি আকবর আলী কলেজে বিএ শেষ বর্ষের ছাত্র এবং রাজনৈতিকভাবে ছাত্রদলের কলেজ শাখার সভাপতি ও উপজেলা শাখার সহসভাপতি। শুরু থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হওয়া অকুতোভয় জেহাদ নব্বইয়ের ১০ অক্টোবর বিএনপিসহ সাত দলীয় জোটের আহবানে রাজধানীতে অবরোধসহ মহাসমাবেশের ডাক দেয়া কর্মসূচীতে হাজির হয় নিজ এলাকা থেকে ৬০ জন ছাত্র নিয়ে। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় মিছিলে আসার আহবান বাস্তবায়িত করতে মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত করে তোলে ঢাকার রাজপথ। শুরু হয় পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জ । অনেকে আত্মরক্ষার্থে মিছিল থেকে পিছু হটে। কিন্তু জেহাদ এগিয়ে যায় বীরদর্পে সচিবালয় অভিমুখে। একপর্যায়ে নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। গুলিবিদ্ধ হন জেহাদ।মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জেহাদ। চলে যান তার পূর্বসূরী শহীদ মাহবুবুল হক বাবলুর কাছে। আর মৃত্যুর আগে বলে ব্যক্ত করেন তার শেষ ইচ্ছা।
তারপর জেহাদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে স্বৈরাচারের শকুন চোখকে ফাকিঁ দিয়ে জেহাদের লাশ নিয়ে আসা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, রাখা হয় মুজিব হলে, বিকেলে ছুটে আসেন সাতদলীয় ঐক্যজোট নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তারপর কিছু দিক নির্দেশনা। সন্ধায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নিয়ে যাওয়া হয় জেহাদের লাশ। মৃত অথচ প্রেরনায় জীবিত একজন বীরকে সামনে রেখে গঠন করা সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য পরিষদ। ছাত্রনেতারা একে অপরের হাতে হাত রেখে শপথ নেন স্বৈরাচার এরশাদের পতন ছাড়া আমরা ঘরে ফিরে যাবোনা।
এইতো সেদিন তারপরও বহুদিন, বহুক্ষন। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। জেহাদের লাশকে সামনে রেখে করা শপথ বাস্তবায়িত হলো। এরশাদ বন্দুক ফেলে গনতন্ত্রের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হলো। বিদায় হলো দীর্ঘ নয় বছরের এরশাদের দুঃশাসন। মুক্ত হলো গনতন্ত্র, মুক্তি পেলো স্বৈরাচার কবলিত বাংলাদেশের জনগন। দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারের ঘাত-প্রতিঘাতে আহত গনতন্ত্র আবার নতুন করে বেড়ে উঠার স্বপ্ন দেখলো, শাখা প্রশাখা মেলতে শুরু করলো।
বাংলাদেশের গনতন্ত্রকে নিয়ে ইতিহাসের যবনীকা এখানেই থামলে ভালো হতো। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সেদিন শত জেহাদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে শুধু একজন স্বৈরাচারের পতন ঘটেছিল আর পতিত সেই স্বৈরাচার নাজিম উদ্দিন রোডের লাল দেয়ালে আটাক ছিল কিছু সময়ের জন্য মাত্র কিন্তু তার সহচররা দোর্দন্ড প্রতাপে শাসিয়ে বেড়িয়েছে জেহাদেরে বেচে যাওয়া স্বজনদের কিংবা ক্ষমতার ভাগাভাগির রাজনীতিতে সেই পতিত স্বৈরাচার এখন বাংলাদেশের রাজনীতি তথা গনতন্ত্রের মূল নিয়ামক। পতিত সেই স্বৈরাচারই ঠিক করে দেয় বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার থাকবে নাকি গনতন্ত্রের আবরনে স্বৈরশাসনই দীর্ঘায়িত হবে।
যারা সেদিন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছিল তারা আজ সেই পতিত স্বৈরাচার আর নব্য স্বৈরাচারের কাঁদে ভর করে জেহাদ দিবসে জেহাদের রক্ত বৃথা যেতে দেবনা চিরকুট পাঠিয়ে মূলত দেশবাসীকে গনতন্ত্রের প্রতি তাদের চরম অবজ্ঞা, অবহেলা আর নিজেদের সুবিধাবাদী রাজনীতিরই জানান দেয়। জেহাদদের রক্তের উপর দিয়ে অবাধ স্বাধীনতাভোগী বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোও বেমালুম ভুলে গেছে জেহাদকে। পত্রিকার পাতায় আজ যেখানে ঠাই পাওয়ার কথা ছিল শহীদ জেহাদের সেখানে আজ ঠাই পেয়েছে পতিত সেই বিশ্ববেহায়া এরশাদের ছবি।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আজ জেহাদ দিবসে বানী না দিলে কিংবা দলের পক্ষ থেকে কোন কর্মসূচী না রাখলে এবং সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক না থাকলে হয়তো কারো বুঝারই উপায় ছিলনা আজ এক মহান বীরের আত্মাহুতির দিন।
জীবিকার তাড়নায় জেহাদের মিছিলে থাকা আমরা আজ অনেকে প্রবাসী। কিন্তু জেহাদের মিছিলে থেকে পরবর্তীতে সুবিধা নেয়া অনেকে আজ দেশে প্রতিষ্ঠিত এমনকি জানামতে অনেক প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার সাংবাদিক, কলামিষ্ট এমনকি সম্পাদক। তারা কি পারতোনা শহীদ জেহাদকে নিয়ে দু’কলম লিখেতে। সেদিন জেহাদ রক্ত দিয়ে কলমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিল। বুকর রক্ত না বরং নিজেদের দামী কলম থেকে একটু কালি খরচ করলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো? সত্যি বোধগম্য নয়।
জেহাদের শেষ ইচ্ছা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈর সরকারের পতন হয়েছে কি না, না এক স্বৈরাচার থেকে কুশিক্ষা নিয়ে আরেক স্বৈরাচার মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে তা বিচারের দায়ভার বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর গনতন্ত্রপ্রেমী বৃহদাংশের। তবে জেহাদের আত্মা শান্তিতে থাকুক –মহান রাব্বুল আল-আমিনের কাছে এ প্রার্থনা।
দুঃখ দিয়ে দুঃখকে ঢেকে রাখার একটি প্রয়াস মাত্র
-----------------মম, দাম্মাম, শহীদ জেহাদ দিবস ২০১৪
বিষয়: বিবিধ
১৯৯৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন