অচিনপুর
লিখেছেন লিখেছেন থার্ড্আই ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৪:৫০:৪৮ বিকাল
নদীর তীর ধরে হাঁটছি, খুব সুন্দর পরিবেশ। মৃদু বাতাস বইছে চারিদেকে। সূর্যের লাল আভা পড়ে নদীর পানি ঝিক ঝিক করছিল। সে এক অদ্ভুদ সুন্দর পরিবেশ। নদীর তীর ধরে কিছু মানুষ খুব দ্রত পা ফেলছে। দেখে মনে হয় তাঁদের খুব তাড়া আছে। মনে হয় তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরার তাড়া। নদীর উপর একটি বাঁশের সাকু, গ্রামের মানুষ ফিরছে গঞ্জ থেকে বাজার করে। কারো হাতে ছোট ব্যাগ, আবার কারো হাতে বড় ব্যাগ, যার যা সামর্থ্য তা নিয়েই বাজার সেরে আসছে। এজন্য এ...ই ছোট বড় ব্যাগের কারণ। খুব সুন্দর একটি বিকেল। নদীর দুই ধারে ধানের ক্ষেত। নতুন ধানের চারা, সবে মাত্র জওবনে পা রাখছে। সবুজ, মন কাড়ানো সবুজ ধানক্ষেত। দেখতে ভালই লাগে। বিস্তর একটি মাট পার করে যেতে হয় মরজিনাদের গ্রামে।
গ্রামের নাম অচিন পুর। খুব অদ্ভুদ একটি নাম, অচিন পুর! ওই বড় মাটটি পার হলেই ওদের গ্রাম। সূর্যের আভা লাল বর্ণ ধারন করা শুরু করছে। তার মানি সন্দা হতে আর বেস বাকি নেই। আমাকে আর তাড়া তাড়ী পা চালাতে হবে। কারণ, এখানে সন্ধ্যা নামের সাথে সাথে ঘুট ঘুটে আন্ধকার নেমে আসে চারি দিকে। মনে হয় আর বেশি দূরে নয় মরজিনাদের বাড়ি। ওদের বাড়িটি গ্রামের শেষ প্রান্তে। কখনো কখনো ওদের বাড়ি আবার ধান খেতের মাজের আইল দিয়ে যাওয়া যায়। মরজিনাদের বাড়ির বেড়া দেখা যাচ্ছে আবছা ভাবে। তার মানি আমি চলে এসেছি কাছাকাছি।
মরজিনার স্বামী রহিম পাশের গ্রামের একটি খামার বাড়িতে কাজ করে। বিকেলে ওর কাজ শেষ হলে গঞ্জ থেকে বাজার করে তারপর বাড়ি ফিরে। ওদের গ্রামের গঞ্জটি ছুট। তবে এখানে প্রয়োজনীয় সব তরি-তরকারী ফ্রেস পাওয়া যায়। মনে হল কে যেন আমাকে পিছন দিক থেকে ডাকছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে দূর থেকে কে যেন হাত নেড়ে আমাকে ডাকছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার কারনে আমি তাকে ভাল ভাবে চিন্তে পারিনি। কাছে আসলে দেখতে পেলাম সে মরজিনার স্বামী রহিম মিয়া। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমাকে কি ভাবে চিনতে পারলা? সে বলল, সেথ সুজা কথা। আপনার কাধের ব্যাগ দেখেই আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। কারণ, আমাদের গ্রামের আর কোন লোক এরকম ব্যাগ নেয়ে আসেনা। তাই আপনাকে চিনতে আমার একটুও অসুবিদা হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ রহিম মিয়া। ও বলল, গরিবের আর ভাল থাকা! ভাল আছি। থ ছাব, অনেক দিন পর এবার আপনি আসলেন। হা, এবার একটু দেরি হয়ে গেল। রহিমের সাথে কথা বলে বলে ফিরছিলাম ওদের বাড়ির দিকে।
রহিম মিয়ার কাঁধে একটি চটির ব্যাগ এবং হাতে একটি পলিতিনের ব্যাগ। কালো পলিতিনের ব্যাগ, তাই ভিতরে কি আছে বোজা যাচ্ছেনা। তবে কাঁধে রাখা চটির ব্যাগের মধ্যে মনে হয় চাল। কারণ, ব্যাগের চতুর দিক গোলাকার। কি ব্যাপার রহিম মিয়া, এত দেরি কেন আজ? নাকি এরকম প্রতিদিন হয়? না ছাব, এরকম দেরি হয় না প্রতিদিন, বাজার করতে গেলে সন্ধ্যা হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। আর, আজ কিনতে গিয়েছিলাম মাছ। মাছের যা দাম ছাব! গরিবের পক্কে মাছ কিনা আর মাংস কিনা সমান হয়ে গেছে। আমারা এখন মাছ মাংসের ধার কাছে যেতে পারিনা, এসব এখন ধনির খাবার, আমাদের মতো গরিবের নয়! রহিম মিয়ার কথা আমি শুনতেছি আর ভাবতেচি, দেশের যা অবস্তা, ধনিরা খাচ্ছে হিমসিম, আর গরিবের অবস্তা থ ভাবা যায় না। আযানের ধনি ভেসে আসছে বাতাসে, তার মানি গ্রামের মসজিদে মাইক লাগানো হয়েছে। কি ব্যাপার রহিম, আযান শুনা যায়, মসজিদে মাইক লাগানো হয়েছে নাকি? জী ছাব, আমাদের হান্নান সাহেবের ছেলে মসজিদে মাইক লাগিয়ে দিছে। ওর নাম খালেদ, সে এখন লন্ডন থাকে। সে লন্ডন থেকে টাকা দিছে ওর বাপের কাছে মসজিদে মাইক লাগিয়ে দেয়ার জন্য। তারপর ওর বাবা হান্নান সাহেব গত কয়েকদিন আগে মসজিদে মাইক লাগিয়ে দিছেন। এখন ছাব আমরা বাড়ি থেকে আযান শুনতে পাই। চলুন ছাব, আজ আমরা নামায পড়েই বাড়ি ফিরি। হা চল, নামাযটা পড়ে আসি। গ্রামের মধ্য খানে মসজিদ। ওজু করার জন্য পুকুরে নামতে হয়, অনেক দিনের পোরানো সিঁড়ি, তাই মাজে মধ্যে অনেক জায়গায় ভাঙ্গা, সাবধানে পা ফেলতে হয়। মাগরিবের নামায শেষ করে ইমাম সাহেবের সাথে দেখা হল। এই এলাকারই ছেলে, পাশের গ্রামের একটি কওমি মাদ্রাসায় পড়া লেখা। তিনি ইমামতি করতেছেন এখন। ঠিক আছে ইমাম সাহেব, আমি এখন যাই, পরে আবার দেখা হবে। দোয়া করবেন আমার জন্য। ঠিক আছে, আল্লাহ্ হাফিয ছাব। মসজিদ থেকে আর পাঁচ সাত মিনিট হাঁটলেই রহিম মিয়ার বাড়ি। বেস অন্ধকার হয়ে গেছে। রহিম মিয়া পাশের একটি দোকান থেকে ওর লাইট টি নীয়ে আসলো। দুই ব্যাটারির লাইট, অল্প আলো দিচ্ছে, পায়ের সামনের অংশ দেখা যায়। মনে হয় ব্যাটারি অনেকদিনের পুরাতন। চারি দিকে ঝি ঝি পোকা ডাকতেছে। অনেক দিন পর, ঝি ঝি পোকার ডাক কানে আসলো। আসলে, অনেক দিন পর গ্রামে গেলে, দেখতে, শুনতে আর ঘোরতে ভালই লাগে। যেমন, ভাল লাগতেছে আমার কাছে আজকের এই সন্ধ্যা।
বাড়ির সামনা সামনি চলে এসেছি। ঘরের ভিতরে হারিকেন এর আলো। হারিকেনের চিকন আলো বেড়া গলিয়ে বাইরে এসে পড়তেছে। তার মানি মরজিনা স্বামীর অপেক্কায় বসে আছে। স্বামী ঘরে গেলেই সে রান্না শুরু করবে বলে আমার মনে হয়। উঠোনে ঢোকার আগে একটি বড় কাঁঠাল গাছ, তারই নীচ দিয়ে যেতে হয় মরজিনার ঘরে। মরজিনা জানে না যে আমি আজ আসতেছি তাঁদের ঘরে। বাড়ির উঠোনে পা রাখার সাথে সাথে রহিম মিয়ার চিৎকার, কই গেলা তুমি? দেখো কাকে নীয়ে এসেছি সঙ্গে করে! ছাব, আমাদের ছাব! মরজিনা চোখের পলোকে ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ মরজিনা? কোন কথা বলতেছে না। ব্যাপার কি? আমার কথা কি আপনার মনে আছে ছাব?আরে আছে, মনে না থাকলে কি আর আমি আসি? ঘরের বেড়ার ফাক গলিয়ে হারিকেনের চিকণ একটি আলো ওর মুখে এসে পড়েছে। বাঁশের বেত দিয়ে ঘরের বেড়া তাঁর উপর কাদা মাটি দিয়ে লেপা। বেড়ার কোথাও কোথাও মাটি খসে পড়ে ফাক তৈরি হইছে। আর সেই ফাক দিয়েই আলো আসছে। ভারি সুন্দর এক পরিবেশ। আসলে ও অবাক হয়ে গেছে ওই সময় আমাকে দেখে। কারণ আমি তাঁদের কে আগে জানিয়ে আসি নাই বলেই মরজিনার এই অবাক হওয়া। জী ছাব, আমি ভালো আছি। কেমন আছেন আপনি? তাঁর মধ্যেই রহিম মিয়া মায়াবী এক ধমক দিল মরজিনাকে। কি? বসার কিছু দিবা নাকি এরকম বাইরে দাড় করিয়ে রাখবা? মরজিনার যেন এতক্ষণ পর হুশ আসলো। সে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে একটি মোড়া নিয়ে আমায় বসতে দিল। বেতের মোড়া, অনেক দিনের পুরাতন। দুচালা ঘর। সামনে বারিন্দা, বারিন্দায় একটি পাটি বিছানো। আমি সেই মুড়াতে না বসে পাটিতেই বসলাম। অনেক দিন পর এ রকম একটি পরিবেশে বসা। রান্না ঘর আলাদা। মরজিনা কিছু রান্নার জন্য মনে হয় বেস্ত হয়ে পড়েছে। স্বামীর আনা বাজারের ব্যাগ সে হাতে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছে। বেশ সুন্দর বাড়ী। খুব পরিস্কার এই অন্ধকারেও মনে হয়।
চলবে।
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন