আমি আল বদর বলছি। পর্ব-১
লিখেছেন লিখেছেন স্বপন২ ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৬:৫২:২০ সন্ধ্যা
ভূমিকা: আমি আল বদর ছিলাম
আমি আল বদর ছিলাম। একাত্তরের সিদ্ধান্ত আমার নিজস্ব। আমার বিবেকের সাথে পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছিলাম। কোন দল কোন গোষ্ঠী অথবা কোন ব্যক্তি এ সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দেয়নি। আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে অথবা কোন কিছুতে প্রলুব্ধ হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একথা সত্য নয়। বন্দুকের নলের মুখে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি তাও নয়।
২শ’ বছরের গোলামীর ইতিহাস, সমসাময়িক হিন্দু চক্রান্ত, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অতীত কার্যকলাপ, তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের দুরভিসন্ধি সব মিলে ২৫শে মার্চের পর আমার বিবেকে একটা ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে। আমার তারুণ্যকে পরিস্থিতির সুলভ শিকারে পরিণত হতে মন সায় দেয়নি। বার বার মনকে প্রশ্ন করেছি: এদেশে ইট কাঠ দালানগুলো ও অন্যান্য জড় পদার্থের মত আমি নীরব দর্শক হয়ে বোবার মত দাঁড়িয়ে থাকব? এই আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রের শেষ কোথায়? যে হিন্দুস্তান তার নিজের দেশে হাজার হাজার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে মুসলমানদের নিধন করছে, সেই ভারত কী স্বার্থে পূর্ব-পাকিস্তানের আট কোটি মুসলমানদের জন্য দরদে উচ্ছসিত হয়ে উঠল?
আওয়ামী লীগের তৎকালীন ধ্বংসাত্মক তৎপরতা ৫৪ হাজার বর্গমাইল একটি ভূখণ্ডকে সেই দেশের মানুষকে দিয়ে পদানত করার ভারতীয় প্রয়াস বলে আমার ধারণা হল। মনে হল এদেশের ৮ কোটি মুসলমানকে দিল্লীর আজ্ঞাবহ সেবাদাসে পরিণত করতে চায় আওয়ামী লীগ। ইসলামী জজবাতের ঘুমন্ত সত্তা আমার মধ্যে জেগে উঠল। আমি সবকিছু জেনে শুনে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার পিতা অথবা পিতামহদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছেচল্লিশের গণরায়ের সপক্ষে হাতিয়ার তুলে নিলাম। সক্রিয় অংশ নিলাম প্রতিরোধ লড়াই-এ। তারপর রুশ-ভারত অক্ষশক্তির সব ষড়যন্ত্রের শেষ পরিণতি হল ১৬ই ডিসেম্বর। চূড়ান্ত বিপর্যয় হল। বিচ্ছিন্ন হল দেশ। এক ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তির গণজোয়ারকে বালির বাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি, পারিনি। দেশের প্রত্যেকটি জনপদ রাজপথ গ্রাম আর গঞ্জে দেশপ্রেমিক মানুষগুলো লাঞ্ছিত রক্তাক্ত হল। মীরমদনরা নিক্ষিপ্ত হল মীরজাফরের কারাগারে। আমিও কারা প্রকোষ্ঠে অন্তরীণ হলাম। আমার ৪০ বছর কারাদণ্ড হল। আমি দেখেছি বিচারক নিজেই ছিলেন আমার চেয়ে অসহায়।
এরপর পদ্মা মেঘনা যমুনায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। মুজিবের প্রতিশ্রুত ৩ বছরও পেরিয়ে গেল। ভয়ঙ্কর হতাশা, নৈরাজ্য, অর্থনৈতিক সংকট ঘিরে বসল গোটা জাতিকে। গলাবাজি আর সন্ত্রাস দিয়ে বিবেকবান প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা অব্যাহত থাকল। কিন্তু তবু মুজিব ধুমায়িত গণ-অসন্তোষকে ঢাকতে ব্যর্থ হল। পনের আগস্ট সূর্য ওঠার আগেই সুপ্তোত্থিত মোহমুক্ত দেশপ্রেমিক সৈনিকদের গুলীতে মুজিবের বুক বিদীর্ণ হল। তার খুন আর লাশের ওপর পা দিয়েই সম্ভবত সেদিন এদেশে সূর্যোদয় হয়েছিল। বুক ভরা নিঃশ্বাস নিয়েছিল এদেশের কোটি কোটি মানুষ। সেদিন তার ঠ্যাঙারে বাহিনী লাল নীল বিচিত্র বাহিনী তার সমর্থক জালেম লুটেরার দল ভীরু শৃগালের মত লুকিয়ে ছিল অন্ধকার গহ্বরে। সেদিন বাঙালীর চোখে অশ্রু নয় উল্লাসের হাসি দেখেছিল পৃথিবী।
আমরা কারাগার থেকে জাতীয় জীবনের এই নাটকগুলো নীরব দর্শকের মত দেখলাম। বোবা শ্রোতার মত শুনে গেলাম অনেক কিছু। আমাদের কি করণীয় আছে? একাত্তরে আমাদের বিবেক আমাদের সত্তা সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের হাত আছে হাতিয়ার নেই তূন আছে, তীর নেই।
কারাগার ছিল একটি নাট্যমঞ্চ। দৃশ্যপট বদলের সাথে সাথে এই মঞ্চে আসতে শুরু করল নতুন নতুন মুখ। প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, দলনেতা, কর্মী ও অনেকেই। যারা এইমাত্র ক্ষমতাসীন ছিলেন তাদেরও ঠিকানা হল এই কারাগার। কালের সাক্ষী হয়ে আমরা সবকিছু দেখেছি। এই কারাগারে ডান, বাম, মধ্য সবপন্থী নেতা ও উপনেতাদের পেয়েছি তাদের অনেকের সাথে অন্তরঙ্গ আলাপ হয়েছে। স্মৃতি থেকে যতটুকু পেরেছি, আমার এই সাজান স্বরলিপিতে টেনে আনার চেষ্টা করেছি। এর বাইরেও রয়েছে অনেক কিছু। পরবর্তীতে তুলে ধরার আশা রাখি।
অনেক দেরী হয়ে গেছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে আমার সামনে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ছাড়া অবশিষ্ট কিছু ছিল না। জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। স্মৃতি রোমন্থনের সময় কোথায়? কারাগারের শেষ দিনগুলোতে মোহাম্মদ ফারুক, আব্দুল মালেক ও এ কে. এম শফিউল্লাহ ভাই ডায়েরী সরবরাহ করে স্মৃতিগুলো লিখে রাখার জন্য। নৈরাশ্য অথবা আলস্য, যে কারণেই হোক না কেন সেগুলো ঠিকমত লিখে রাখা হয়নি। তবে স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে এখনও অনেক কিছু। এর কিছুটা এই বইটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে।
অনেক দেরী হলেও বইটা প্রকাশ করতে পেরে আনন্দিত। অবিশ্য এর জন্য বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশও অপরিহার্য ছিল। বইটিতে আমার মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। আমি লুকোচুরি রাখঢাক অথবা ডিপ্লোম্যাসির আশ্রয় নিইনি। কাউকে ক্ষুণ্ণ করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। কেবল আমার বিশ্বাসকে তুলে ধরেছি। আমার বিশ্বাস অহিপ্রাপ্ত অথবা সমালোচনার উর্ধে এমনটি নয়। নিয়মতান্ত্রিক সমালোচনাকে আমি স্বাগত জানাব।
আমার অতীত জেনে শুনে যে মহিলা আমাকে বিয়ে করেছেন সেই আনোয়ারা খন্দকার বেবীর প্রেরণায় বইটা প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। পত্র-পত্রিকার পাতায় পাতায় যেভাবে আল বদরকে বর্বরতার প্রতীক হিসেবে দাঁড় করান হয়েছে, এতে ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রী নেয়া একজন মহিলার আমার প্রতি বিরূপ ছাড়া অনুরক্ত হওয়ার কোন সঙ্গত কারণ নেই। এমন কোন প্রাচুর্যের জৌলুসও আমার ছিল না। আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের একতরফা বিশ্রী প্রচারণায় প্লাবিত সমাজের একজন হয়েও বেবী আমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে। শুরু থেকে চাপ দিয়ে আসছে আমার অভিজ্ঞতায় নিরপেক্ষ কিছু লেখার জন্য।
তার ভাষায়- "‘ইতিহাস তার নিজস্ব গতিধারায় এগিয়ে চলে। একদিন নিরপেক্ষ নির্ভেজাল ইতিহাস লেখা হবে। সেই আগামী দিনের ঐতিহাসিকদের জন্য কিছু তথ্য রেখে যেতে পার।" বেবীর সাধ কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি জানি না। তবে আমার বিক্ষিপ্ত কলমের আঁচড় আলোর মুখ দেখতে পেয়েছে তারই প্রেরণায়- একথা বলতে দ্বিধা নেই।
বিভিন্ন জনের সাথে আমার বিভিন্ন সংলাপ আমি সঠিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমার এই লেখা কতখানি সুখপাঠ্য ও সমাদিত হবে সেটা আমার জানার কথা নয়। বিজ্ঞ পাঠকদের ওপর আমার বইটির সঠিক মূল্যায়নের ভার দিচ্ছি। বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে অনেক তাগিদ পেয়েছি। যারা আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ও বিরল সহযোগিতা করেছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক মাহাতাব উদ্দিন কিশোরগঞ্জ, মীর কাসেম আলী মিন্টু ভাই, বিশিষ্ট ব্যাংকার সুসাহিত্যিক কলামিষ্ট গবেষক আব্দুল মান্নান ভাই, মাসিক নতুন সফর সম্পাদক সাবেক ছাত্র নেতা মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন ভাই কারাগারে থাকা অবস্থায় আমাকে কিছু লেখার জন্য বলতেন তাদের সেই প্রেরণাও বইটি লেখার ব্যাপারে শক্তি যুগিয়েছে। বিশেষজ্ঞ ডাঃ আফসার সিদ্দিকী, সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ হাবিবুর রহমান, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মুস্তাক আহম্মদ, মোঃ কামরুল ইসলাম, মোঃ গিয়াস উদ্দিন তালুকদার, মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, ডক্টর মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ, মোঃ আব্দুল কাহ্হার, এস ডাব্লিউ ভি ফরিদা ইয়াসমীন, সাবেক ছাত্র নেতা ইমতিয়াজ আহম্মদ খান, সাবেক কেন্দ্রিয় ছাত্র নেতা জাকির হোসেন (মুকুল), আক্তার উজ্জামান, মোঃ এনামুল হক, মুহাম্মদ সামসুদ্দিন, এস এম দুররুল হুদা, ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলাম, প্রিন্সিপাল আব্দুস সামাদ সাহেব প্রমুখের নিকট আমি চির কৃতজ্ঞ।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুদ্রণ জনিত কিছু ভুল-ত্রুটি রয়ে গেল। আশা করি পাঠকগণ সেটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। তবু সবরকম ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
- কে এম আমিনুল হক
...চলবে..ধারাবাহিক।
বিষয়: বিবিধ
১০২৫ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন