ছাত্র শিবির: ৮২ সালের একটি কালো অধ্যায় WRITTEN BY ইমন সরওয়ার
লিখেছেন লিখেছেন স্বপন২ ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১১:৩৮:৩১ রাত
বিগত ৩৫ বছরের পুঞ্জিভূত কাহিনী লিপিবদ্ধ করলেন ফরীদ আহমদ রেজা (দেখুন; শিবিরের ক্রান্তিকালঃ১৯৮২ সালের কথকতা)। ১৯৮২-তে ঘটে যাওয়া শিবিরের দায়িত্বশীল নিয়োগের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি সংগঠনের কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। একই সঙ্গে অসংখ্য প্রাণের স্বপ্ন-মিনার ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল। সে সময় জামাতকর্তৃক শিবির নিয়ন্ত্রণের অন্তরালে কোন স্বৈরাচারি কিংবা একনায়কতন্ত্র কাজ করেছিল সেসব বিষয় আজও অনেকের অজানা। বিশেষ করে যারা সংগঠনকে কেবল আত্মবিশ্বাস দিয়ে চোখবুজে নেতৃত্বের আনুগত্য স্বীকার করে গেছেন, কোনো ধরনের চতুরতা বোঝার চেষ্টা করেননি, তারা ছিলেন অনেকটা নিষ্পাপ ভূমিকায়। আশা রাখি মহান প্রভু তাদের অক্ষমতাকে ক্ষমা-সুন্দরভাবে দেখবেন। আরেক পক্ষ ছিলেন ভীতু প্রকৃতির। তারা এস্টাবলিস্টম্যান্ট নিয়ন্ত্রিত কোনো ধারাকে চ্যালেঞ্জ করতে ভয় পেতেন। তাদের ব্যাপারে ইতিহাসে কোন ধরণের শাস্তি সংরক্ষিত রয়েছে সেটা সময়ই ভালো বলতে পারবে।
১৯৮২ থেকে ২০১৫ সাল। এই ৩৫ বছর পর কী এমন বিষয় নিয়ে একজন ফরীদ আহমদ রেজা প্রত্যক্ষ রাজসাক্ষী বা হুইসেল-ব্লোওয়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন? এই দীর্ঘ বয়ান তিনি আগেও তো দিতে পারতেন? কিংবা কেউ যদি প্রশ্ন করে, জামাতের দুর্দিনে তিনিও নিরীহ ধরনের প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উঠেছেন, তাহলে কী জবাব দেবেন তিনি? কিন্তু আমরা যদি সময় এবং জামাত সংগঠনের কান্ডারীদের মানসজগত পর্যালোচনা করি, দেখা যাবে জামাতের আভ্যন্তরীন রাজনীতির ‘হেকমতী’ নেতৃবৃন্দ কোনো কালেই এসব শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাহলে একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে ফরীদ আহমদ রেজা কোন সময়টাকে বেছে নেবেন, মৃত্যুর পরে? নিশ্চয় তিনি এখন ষাটোর্ধ্ব। বরং বলা যায় পুঞ্জিভূত কথাগুলো ফরীদ আহমদ রেজা এতো দিন না বললেও জামাত নিজেকে সেই অবস্থান থেকে আজও শুধরে নিতে পারেনি। তাহলে সত্যটাতো কাউকে না কাউকে বলতেই হবে। অবশ্য যারা মনে করেন, শিবিরের সাংগঠনিক পদ্ধতি আর অনুশীলনে ভিন্নতা থাকা কোনো দোষের নয় তাদের কথা আলাদা।
৮২-তে শিবিরে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, আজকের পর্যালোচনায় আমরা বুঝতে পারছি সেটা ছিল জামাতকর্তৃক আরোপিত সংকট। ছাত্রশিবিরের প্রাক্তন নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের আলোকে আমরা সেটা বুঝতে পারি। এর জন্য এই আলোচনায় জামাতনেতৃবৃন্দের প্রসঙ্গটাই প্রাধান্য পেয়েছে।
এবার দেখা যাক ফরীদ আহমদ রেজার প্রত্যক্ষ-রাজসাক্ষীর বাচনিতে মৌলিক বিষয় কোনটি এবং এসব ইসলাম সমর্থন করে কি না। পর্যালোচনার পূর্বে বলে রাখা ভালো, জামাতের যে কোনো চতুরতাকে স্বয়ং সংগঠন কর্তৃক হেকমত বলে চালিয়ে দেয়ার রেওয়াজ খুবই চর্চিত। এসবকে আমরা ধূর্তামী বলেই গণ্য করবো। এই নিবন্ধ ফরীদ আহমদ রেজা কর্তৃক ‘বিরাশি সালের অকথিত কথকতা’ – এই আত্মকাহিনীমূলক রচনার আলোকে লিপিবদ্ধ করা হলেও এটি কোনো সম্পূরক নিবন্ধ নয় বরং ফরীদ আহমদ রেজার লেখা থেকে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে লেখকের নিজস্ব পর্যালোচনা।
জামাতের রাজনৈতিক বিশ্বাস: ইসলাম ও গণতন্ত্র দুটোই উপেক্ষিত
সময়ের প্রেক্ষাপটে সাধারণের কাছে জামাতের ‘সাংগঠনিক’ বিষয় নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একাত্তর। ৭১-এর সময়টাকে জামাত পাশকাটাতে অনেকটা মরিয়া, জানবাজের মতো একাত্তরকে তারা দূরবর্তী এক কাহিনী হিসেবে দেখে। মুক্তিযুদ্ধকে তারা না গ্রহণ করতে পারেন, আর না উগলে দিতে পারেন। এমতাবস্থায় জামাতের নিজের অদূরদর্শিতার সংকট কাটাতে স্পর্ধিত তারুণ্যের প্রয়োজন পড়ে। তাদের দূর্বল ও বয়োবৃদ্ধ নেতৃত্ব নিয়ে একাত্তুরের গ্লানি টানা কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার এজেন্ডা হিসেবে ১৯৮২ সালে ছাত্রশিবিরকে গ্রাস করতে উদ্যোগী হয় জামাত। বিশেষ করে সেই নেতৃবৃন্দ যারা ৭১ সালে জামাতের ভূমিকা নিয়ে গর্বিত ও সন্তুষ্ট। এটা সত্য যে, জামাতের ভেতরে এখনও অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন যারা মনে করেন জামাতের সেই সময়কার ভূমিকা ইসলাম-সম্মত ছিল না। বরং একটি জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না পারাকে তারা সংগঠনের চরম ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য করেন। যেহেতু তরুণ নেতৃত্ব জামাতের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ ও দ্বন্দ্ব তৈরি করেছেন তাই জামাতের নেতৃবৃন্দ ৮২ সালে শিবিরের ভেতরে কৃত্রিম দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টি করেন।
শিবির যেহেতু ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে জামাতের অঙ্গসংঠন ছিলো না, বরং শিবির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ছাত্রদের কাছে উপস্থিত হতো এই বলে যে ‘ছাত্রশিবির কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন নয়’। ধর্মপ্রাণ সাধারণ ছাত্রদের কাছে এই আহবান ছিলো অনেক নিষ্পাপ ও আকর্ষণীয়। সেই সময়কার শিবিরের এই গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের যেকোনো সময়-কাল থেকে ঈর্ষনীয় সময় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অন্তত সেই সময়ে শিবিরকে কেউ ‘রগকাটা-গলাকাটা’ বলে আখ্যায়িত করতে পারেনি। আমরা বরং দেখেছি, সংগঠনের বিশেষ আয়োজনে ভিন্নমতাবলম্বী অন্যছাত্র সংঠনের নেতৃবৃন্দও শিবিরের মঞ্চে এসে বক্তব্য রাখতেন।
কেউ বলতে পারেন, শিবির আকাশ থেকে নাজিল হয়নি, এর পেছনে ছিল জামাতের সাহায্য ও আশীর্বাদ। কিন্তু ৭৭ সালে তো জামাত ময়দানেই ছিল না। জামাতে ইসলামী বাংলাদেশে ৭৮ সাল থেকে স্বনামে কাজ শুরু করে। আরো ছিল ইসলামী ঘরানার আইডিএল, মাওলানা আব্দুর রহিম’র নেতৃত্বে। আইডিএল’র সাথে জামাত যা করেছে সেটা আরেক কলঙ্কজনক ও রক্তাক্ত ইতিহাস। দল হিসেবে জামাত নিবন্ধিত হবার পরও শিবির সব সময় তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলেছে। শিবিরের প্রোগামে, এমন কি ৮১ সালে রমনাগ্রিনে সাড়া জাগানো সম্মেলনে জামাত নেতৃবৃন্দকে দেখা যায়নি। জামাত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার আন্দোলনেও শিবির জড়িত হয়নি।
শিবিরের গ্রহণযোগ্যতার উপর সওয়ার হয়ে বাংলাদেশের মানুষের সামনে জামাত তার অপরিশোধিত রাজনীতি নিয়ে হাজির হবার মওকা খোঁজে এবং ১৯৮২ সালে সেটা চরমভাবে গ্রহণ করে। এখন ৩৫ বছরে অনেকের কাছে মনে হতে পারে, জামাত তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে, আর যারা শিবিরকে জামাতের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রাণপন লড়াই করেছিলেন তারা ব্যর্থ। নৈতিকতার বিচারে জামাতের এই বিজয় আপেক্ষিক।
৮২ সালে এসে শিবিরকে জামাতের অঙ্গ-সংগঠন বলার অর্থ কি এ নয়, যারা এতোদিন শিবিরকে স্বাধীন সংগঠন হিসেবে বলেছেন তারা ছাত্র-জনতাকে ধোকা দিয়েছেন? তারা কি জানেন না, ব্যক্তিগত ধোকাবাজীর চেয়ে জনগণের সাথে ধোকাবাজী অনেক বড় অপরাধ?
ফরীদ আহমদ রেজা যেসব আলোকে জামাতকে বিচার করেছিলেন সেসব বিষয়ের মধ্যে অন্যতম ইস্যু ছিল ৭১-এ জামাতের ভূমিকা। শিবির যদি জামাতের করতলগত হয় তাহলে মাঠে-ময়দানে শিবিরকেই জামাতের অপরিনামদর্শী রাজনৈতিক ভূমিকার জবাবদিহি করতে হবে। এটা ফরীদ আহমদ রেজারা ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। সম্ভবত কোনো জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ও জনস্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীতে এমন কোনো ইসলামী সমাজ বা সংগঠন খোঁজে পাওয়া যাবে না একমাত্র জামাত ব্যতিত। বাংলাদেশের ইতিহাসের এই ক্রান্তিকাল মাথায় রেখেই জামাতকে বিবেচনা করতেন ৮২ সালের ছাত্রশিবিরের তরুণ ইসলামী নেতৃবৃন্দ। জামাতও সেটা বুঝতে পেরেছিল বলেই আমরা মনে করি। না হলে ইসলামী শক্তির ভেতরেই তার শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করতো না দলটি। ইতিহাসের এই ট্র্যাজেডি বড়ই মর্মান্তিক, নিদারুণ বেদনা বিধুর। আজকের তরুণ সমাজকে জামাত স্বেচ্ছায় এই ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে নিজেদের অপকৌশল ঢেকে রাখার জন্য। সত্যি কি তা পেরেছে? ৮২’র ঘটনার কি পুনরাবৃত্তি ঘটছে না?
কোরানিক বিধানকে পাশ কাটিয়ে জামাত বার বার একরৈখিক নেতৃত্বের পাশাখেলায় মত্ত। নেতৃত্বের গুণাবলিকে পাশ কাটিয়ে, কার্যকরী পরিষদের সদস্যদের মতামতকে উপেক্ষা করে, পূর্বনির্ধারিত সিলেক্টেড ব্যাক্তির হাতে সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দেয়ার যে কৌশল তা কি আওয়ামী-বিএনপি থেকে ভালো কোনো উদাহরণ বলা যাবে? বলা হচ্ছে নির্বাচন, নির্বাচনী প্রহসনও হচ্ছে, কিন্তু নেতৃত্ব যাচ্ছে জামাত মনোনীত ব্যক্তির হাতে, এটা কি কর্মীদের সাথে ধোকাবাজী নয়? আওয়ামী-বিএনপিকে এক্ষেত্রে সাধুবাদ দেয়া যায়। কারণ, তারা ইসলামের নামে মিথ্যা গিলাচ্ছে না। তারা বরং তাদের জাহেলিয়াতী নীতির সঙ্গে তাদের সাংগঠনিক দাস নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেকটাই মানানসই। ইসলামী সংগঠনের কার্যক্রম সেক্যুলার সংগঠনের নিয়মকেও আজ হার মানিয়েছে।
তাদের সিদ্ধান্তমূলক বৈঠকে যা পাস করা হয় তা কি শরিয়তসম্মত? এই ধরনের অনুশীলনের মাধ্যমে কোনো ইসলামী নেতৃত্ব নয় বরং হিটলার-স্ট্যালিনের প্রতিভু তৈরি করবে। কিংবা এটাকে হিটলার-স্ট্যালিনের ইসলামীকরণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এসব বিবেচনায় জামাতের রাজনৈতিক বিশ্বাসে ইসলাম ও গণতন্ত্র দুটোই উপেক্ষিত।
বাচ্চু-রেজার ৮২ সালে জামাতের এই অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করা কি অপরাধ ছিল? চ্যালেঞ্জ করার কারণে কি জামাত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল? লক্ষ্য করুণ, ফরীদ আহমদ রেজা যে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন জামাত নেতৃবৃন্দ আজও সে বিষয়ে আলোচনা করতে ভয় পায়। তিনি সে সময়কার অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষতা তুলে ধরতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘ছাত্রশিবিরের সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হবার পর কার্যকরী পরিষদের সাথে পরামর্শ করে সেক্রেটারি জেনারেল নিয়োগ করেন। এখানে ‘পরমর্শ করে’ কথাটার ভাষাগত অর্থ হচ্ছে পরামর্শ অনুযায়ী। এর ব্যবহারিক প্রচলিত অর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সভাপতি পরামর্শ করবেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশের পরামর্শ গ্রহণ করা তাঁর জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। এই প্রচলিত ব্যাখ্যা সেই শুরু থেকে আমরা শুনে আসছি এবং কেউ এটাকে চ্যালেঞ্জ করেননি বা এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়নি।
কিন্তু আমাদের অনেকের পর্যবেক্ষণ ছিল, যেভাবে সাংবিধানিক এ সুযোগকে ব্যবহার করা হচ্ছে তা নানা কারণে সঠিক হচ্ছে না।” এর উদাহারণ দিতে গিয়ে ফরীদ আহমদ রেজা একই লেখায় উল্লেখ করেন, ‘এনামুল হক মনজু কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হবার পর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তিনি পরিষদের সদস্যদের সাথে পরামর্শ করেন এবং সাইফুল আলম মিলনকে সেক্রেটারি জেনারেল নিয়োগ দেন। এটা আমাদের অনেকের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। ইতোপূর্বে যারা সেক্রেটারি জেনারেল হয়েছেন তারা এক, দুই বা তিন নম্বর চয়েসের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার বিচারে সাইফুল আলম মিলনের অবস্থান ছিল অনেক পেছনে। প্রশ্ন জেগেছে, কেন তাকে সেক্রেটারি জেনারেল করা হলো? কয়েক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, যিনি সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত হন পরবর্তীতে তিনিই কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। তাহলে কি পর্দার অন্তরালে থেকে কেউ নিজেদের পছন্দমত কেন্দ্রীয় সভাপতি বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করছে?’
ফরীদ আহমদ রেজার এই উক্তি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, প্রথম সারির নেতৃবৃন্দকে ডিঙ্গিয়ে পছন্দের নেতৃত্ব সংগঠনের উপর চাপিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে একটি অনৈতিক হেকমত অনুসরণ করা হয়েছে। আজকের তরুণ সমাজ সেদিনের অমানবিক ঘায়ের রক্তকরণ বোঝার কথা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ছাত্রশিবির জামাতের সেই দখলদারিত্ব ও একরৈখিক সংকট নিয়ে এখনও বিপর্যস্ত। শিবিরের তরুণরা স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্ম হয়েও জামাতের একাত্তরের দায় বহন করছে। শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা দিবস পালন করলেই যে একাত্তর ধারণ করা যায় না, সে বোধ তাদের নেই।
সংগঠনের পদ্ধতিগত বিষয়ে ফরীদ আহমদ রেজার উল্লেখযোগ্য ও সবচে আকর্ষণীয় একটি দার্শনিক মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। প্রসঙ্গক্রমে তিনি ‘বিরাশি সালের অকথিত কথকতা’ লেখার পাদটিকায় উল্লেখ করেন, ‘উদ্দেশ্য মহৎ হলেই সকল কাজ সঠিক হয়ে যায় না। ইসলামের দৃষ্টিতে কাজের পদ্ধতিও সঠিক হতে হবে।’ যেদিকে তিনি আলোকপাত করছেন, আজকের নেতৃবৃন্দের জন্য এখনও সময় আছে সেই আলোকে অর্থাৎ ইসলামের আলোকে যে কোনো বিষয়কে বিবেচনা করা।
জামাত স্বাধীনতা বিশ্বাস করে আবার করেও না:
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের আত্মপরিচয়। এই সময়টাকে জামাতে ইসলাম যেভাবে উপস্থাপন করে সেও এক ধোকাবাজীরই নামান্তর। নিজেদের মধ্যে ৭১-এর বিরোধিতাকে তারা গৌরবের সাথে দেখে। রাজনৈতিকভাবে মাঠে-ময়দানে একাত্তরকে সম্মান করার চেষ্টা করে, কিন্তু মানুষ সেটা বিশ্বাস করে না। জামাত মনে করে তাদের কথা মানুষ বিশ্বাস করে। এই দ্বৈত আচরণ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে কতোটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ? এই বিষয়টি নিয়ে যারা ভাবেন না প্রকৃত পক্ষে ইসলাম নিয়ে তদের কোনো দায়বোধ আছে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ছাত্রশিবির শুরু থেকেই স্বাধীনতার প্রতি সম্মান ও বিশ্বাস নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ফরীদ আহমদ রেজা তার লেখায় তুলে ধরেন, ‘ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বলিষ্ঠভাবে কথা বলেছি। আমরা বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন করি। কিন্তু ৭১ সালে জামাতের ভূমিকা নিয়ে ময়দানে আমরা কিছু বলতে পারি না। জামাতের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে লিখিত বা অলিখিত কোনো সুস্পষ্ঠ বক্তব্য নেই।’ এ থেকে আমরা কী বুঝবো?
একটি অনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাত্রশিবিরের উপর জামাত চাপিয়ে দিয়ে সেই পাকিস্তানী ধ্যানধারণাই কায়েম করতে চায়? জামাত এখানে ইসলামের সম্পর্কটা কোথায় পেলো, আমরা বুঝতে পারি না। ভুলকে ভুল বলার শিক্ষা তো ইসলামই দিয়েছে, তাহলে জামাত সেটা অনুশীলন করতে অপারগ কেন? ১৯৮২ সালের ছাত্রশিবিরের নেতৃবৃন্দ চেয়েছিল বিষয়টির একটি স্থায়ী মীমাংসা টানতে, আর জামাত সেটাকে আজও বিভ্রান্তিমূলক অবস্থানে জিইয়ে রেখেছে। সময়ের প্রেক্ষাপটে তারা চাপের মধ্যে পড়ে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে। সেই উদযাপনের নামকরণে স্বাধীনতা দিবস থাকলে প্রকৃত অর্থে আজ মনে হচ্ছে, তারা স্বাধীনতা দিবসের নামে দোয়াপাঠ করে আর সেই দোয়ার মধ্যে পরম আল্লাহ তায়লার কাছে কী প্রার্থনা রাখে, তাদের সেই অন্তরের কথা সৃষ্টি কর্তাই ভালো জানেন। তবে স্বাধীনতার এতোকাল পরেও জামাতকর্তৃক আজ পর্যন্ত স্বাধীনতার পর্যালোচনাধর্মী এমন কোনো রচনা পাওয়া যাবে না, যেখানে ৭১ সালে জামাতের ভূমিকা নিয়ে কোনো কিছু তারা লিপিবদ্ধ করেছেন। এর জন্যই ফরীদ আহমদ রেজা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন, জামাতে ইসলাম ৭১ সালে তাদের ভূমিকা নিয়ে এখনো অহঙ্কার করে এবং সেটা ছাত্রশিবিরের নতুন প্রজন্মের কাছে জিইয়ে রাখতে চায়। জামাতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের উদ্ধৃতিও তিনি দিয়েছেন।
শিবিরের সাথে জামাত যা করেছে তা থেকে মানুষের ধারণা আরো পোক্ত হয়েছে। আগে বলা হয়েছে, শিবির স্বাধীন সংগঠন। একটু শক্তি অর্জনের পর শিবিরকে কুক্ষিগত করে নিয়েছে। একইভাবে, জামাত এখন স্বাধীনতা দিবস পালন করলেও যখন শক্তি অর্জন করবে তখন মক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করবে। জনগণের এ আশঙ্কাকে জামাত কি উড়িয়ে দিতে পারে?
এখনও নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া সিস্টেমে শিবির আবর্তিত:
১৯৮২ সালের ছাত্রশিবির: একটি কালো অধ্যায়ের পর্ব শেষ হলেও এখনও জামাতের চাপিয়ে দেয়া ঘূর্ণনের মধ্যে ছাত্রশিবির তার শক্তি ক্ষয় করছে। শুরায় কোনো পর্যালোচনা নয়, সেই ৮২ সালের মতো আজও জামাতের পছন্দের মানুষকে সিদ্ধান্তমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে দলের দায়িত্ব অর্পণ করা হচ্ছে। এই সত্যটি আজকের নেতৃত্বও জানেন। একই ঘটনা বার বার ঘটছে এবং তা লুকানো বিষয় নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তা আসছে। ২০১০ সালে শিবিরের নেতৃত্ব নির্বাচনে জামাতের খবরদারির কারণে ৪১ জন সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী পরিষদের ২৬ জনই প্রস্থান করেন। কিন্তু তারপরও তা একই ধারায় চলছে।
এই পুরানো আবর্তের ভেতর দিয়ে শিবির কেবল এক পরাধীন ছাত্র সংগঠন হয়ে যায়নি, ইসলামে নেতৃত্ব হস্তান্তরের যে রোলমডেল – সেটা প্রতিদিন ব্যাহত হচ্ছে। জামাত শাসিত সাংগঠনিক রাজতন্ত্রের চর্চায় ইসলাম ও মুসলমানকে প্রতিক্ষণে ক্ষুদ্রতার দিকে ধাবিত করছে। এর মধ্যে না আছে পরলৌকিকতা আর না আছে ইহলৌকিকতা।
ফরীদ আহমদ রেজার বয়ান থেকে আমরা দেখি, জামাত বার বার তাকে জামাতে যোগ দিতে বলেছে, সাথে চাকরির প্রলোভন দিয়েছে। কখনো ৮২’র ঘটনার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেনি। এর মানে, জামাত তার ৮২’ ভূমিকাকে এখনো সঠিক মনে করে। ফরীদ আহমদ রেজা আর্থিক প্রয়োজনে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জামাতে যোগ দেননি। এ জন্যে জামাতের কোনো প্রতিষ্ঠানে তার চাকরি হয়নি। এ থেকে কেনা-বেচার একটা চিত্র ভেসে উঠে। প্রশ্ন জাগে, অন্যান্য যারা সে সময় ভিকটিম হয়েছেন তাদেরকেও কি জামাত এ ভাবে ক্রয় করার চেষ্টা করেছে?
আজ ৩৫ বছর পর তিনি সে সময়ের কথা প্রকাশ করার কারণে ব্লগে এবং ফেইস-বুকে তাঁর বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্যের ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে জামাত-শিবিরের লোকেরা প্রমাণ দিচ্ছে, তারা ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণু এবং আচরণে সভ্য নয়। একটা ইসলামী সংগঠনের আচরণ এ রকম হলে তাদের নিকট থেকে দেশ ও জাতি কী আশা করতে পারে?
জামাত মানে ইসলাম নয়:
জামাত মানে একটি যান্ত্রিক সিস্টেম, ইসলাম নয়। যান্ত্রিক সিস্টেম ঈমান-আখলাকের খুব কমই তোয়াক্কা করে। তাদের জবাবদিহিতা আত্মজ নয়, বস্তুগত। জামাতের সমালোচনা অর্থ ইসলাম নয়, ঐ সিস্টেম বা তরিকার সমালোচনা করা। এই সমালোচনায় জামাত কতোটা ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী জীবনব্যবস্থায় আবর্ত সেটা নিয়েই আলোকপাত হতে পারে। আমাদের জন্য দূর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশের সেক্যুলার ঘরানার কিছু লোক এমনভাষায় জামাতকে আক্রমণ করেন তা পাঠ করলে মনে হয় তারা ইসলামের বিরোধিতা করছেন। এটা ঐ সেক্যুলারদের দীনতা। আর জামাতের জন্য সৌভাগ্য এ জন্য যে, সাধারণ পাঠক সেক্যুলারদের আলোচনা পাঠ করে জামাত বলতে ইসলাম মনে করে বসে। এদতসত্তেও জামাত ইসলামের এই সার্বজনীননতা কাজে লাগাতে পারেনি। বরং এটাকে জামাতি সিস্টেমের ভেতর বন্দি করে রেখেছে। আজকের প্রেক্ষাপটে জামাত তার নেতৃত্বের শূন্যতা পুরন করতে হিমশিম খাচ্ছে কেবল সিন্ডিকেইট গ্রুপ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ইসলামে বিশ্বাস করার কারণে। কোনো অথরিটি যদি সিন্ডিকেইট গ্রুপে পরিণত হয়, তাহলে সেটা ইসলাম সম্মত নয়, বরং ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটায়। এমন ব্যবস্থা ইসলাম ও ব্যক্তির দ্বন্দ্বকে প্রকট করে তুলে।
শেষ বয়ান:
‘বিরাশি সালের অকথিত কথকতা’য় ফরীদ আহমদ রেজা নিজ দায়িত্বজ্ঞানে সে সময়ের যে বর্ণনা তুলে ধরেছেন সেটা তিনি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন বলে আমরা মনে করি। তার এই লেখায় অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন প্রসঙ্গক্রমে। আমরা বুঝতে পারছি, তারা অনেক কিছু জানেন কিন্তু আজও মুখ খুলছেন না। এসব ঘটনাকে চাপা দিলে কারোর কোনো উপকারে আসবে না, বরং ইসলামের কথা বলতে গিয়ে ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক যে ভুলগুলো হয় তা থেকে অন্যরা শিক্ষা নিতে পারবেন। এই শিক্ষায় ইসলামের জন্য যারা কর্মতৎপর তারা সবচে বেশি উপকৃত হবেন। যারা এসব নিয়ে আলোচনা করতে আজ কুন্ঠাবোধ করেন তাদের যদি ব্যক্তিগত কোনো অসুবিধা না থাকে (অর্থাৎ হুমকি-ধমকি, শারীরিক নির্যাতন এতদবিষয়ে কোনো ক্ষতির সম্মুখিন হবার আশঙ্কা না থাকে) তাহলে তাদের এ বিষয়ে কলম ধরা আমরা জরুরি মনে করি। সত্যকে যদি চেপে যাওয়া হয়, তাহলে এটা এখানেই শেষ হবে না, বরং এই চেপে যাবার কারণে বার বার বিভিন্ন সংকট তৈরি করবে যার দায়ভার থেকে কেউ রক্ষা পাবেন না।
ইসলামের ইতিহাসে কি সাহাবায়ে কেরামের জীবন, তাদের কাজের বিভিন্ন পদ্ধতি, ত্রুটি বা ত্রুটিহীন অবস্থান, বা সময়ের প্রেক্ষাপটে তাদের অপারগতা নিয়ে আলোচনা হয় না? তাতে কী ইসলামের কোনো ক্ষতি হয়েছে? বরং মানুষ এই সব বিষয় থেকে নতুন দিকনির্দেশনা পেয়েছে। তৎকালিন সময়কে বর্তমান সময়ের সাথে মিলিয়ে নিজের জন্য নতুন কর্মপদ্ধতি তৈরি করেছে।
আরো যারা আছেন যাদের কথা ফরীদ আহমদ রেজা আজ বিস্মৃতপ্রায়, তারাও চাইলে এই বিষয়ে তাদের অবস্থান ও পর্যালোচনা করতে পারেন যাতে করে অলিখিত অধ্যায় থেকে লিখিত অধ্যায়ের ত্রুটিগুলো দূর করা যায়। যদি ফরীদ আহমদ রেজার লেখায় কোনো ত্রুটি থাকে তাদের ঈমানী দায়িত্ব হলো সেসব ত্রুটির মোকাবেলা করা এবং তা জনসম্মুখে তুলে ধরা। আমরা এখানে একটি কথা উল্লেখ করা জরুরি বলে মনে করছি। সে সময় ১৯৮২ সালে সামরিক শাসন জারি ছিল। এর কারণে অনেক কথা হয়তো পত্রপত্রিকায় আসেনি। রাজনীতি ছিল নিষিদ্ধ। তাই যা কিছু ঘটেছে আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থার ভেতর দিয়ে ঘটেছে। সেটাও বর্তমান প্রজন্মকে মনে রাখা দরকার।
এ নিবন্ধ একজন পাঠকের পর্যালোচনা মাত্র। সকলের জন্য সময় সহায় হোক
বিষয়: বিবিধ
১২৬৬ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রেজা সাহেবের কথা বলছেন? ওনিতো ভিতু ড়রপোকা কাপুরুষ। তার লেখা পড়ে বুঝেছি বিএনপি আওয়ামিলিগের গ্রাম্য নেতাদের মত তার মেধা ।
যত পারেন সমালোচনা করুন জামাত-শিবির অবিচল গতিতে এগিয়ে যাবে ইনশাল্লাহ!
ধন্যবাদ
http://www.storyofbangladesh.com/ebooks/amialbadrbolchhi.html
লিংকটা দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। বইটা তেরসালে পড়ে নিচের মন্তব্যটা করেছিলাম। আবার পড়বো ইনশাল্লাহ!
2013-03-22 15:38
লেখাটা পড়ে অনেক কেঁদেছি
অনেক কিছুই জানিনা, আমরা সত্য ইতিহাস জানতে চাই।
"তোমাদের সমস্ত গুনাহর কাফফারা মৃত্যুর দোর-গোড়ায় এসেও আমাদের দিতে হবে, সে আমরা জানি। তোমরা ধ্বংস করবে আমরা গড়ব। তোমরা বিদেশীদের দালালি করবে আর দালাল হিসেবে চিহ্নিত হব আমরা। যুগে যুগে ইসলামের সৈনিকরা সমগ্র জাতির ভুলের মাশুল দিয়েছে তাদের জীবন দিয়ে।'
যাযাকাল্লাহ খায়র
কোন সংগঠনই ১০০% সঠিক ভাবে চলে এটা বলা যাবে না। কারন যেটা আমার কাছে সঠিক, তা অন্যের কাছে সঠিক নয় বলে প্রমানিত হয়। উনারা তো আলাদা সংগঠন করলেন, তো কতটুকু সফল হলেন? নাকি নিজেদের বিফলতাটাকে চাপা দেবার জন্য এখন এসব লেখা হচ্ছে?
মন্তব্য করতে লগইন করুন