এ কোন পরিণতির দিকে যাচ্ছি
লিখেছেন লিখেছেন ফয়েজ রহমান ২৫ মার্চ, ২০১৩, ০৯:৪৯:০৭ রাত
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তো স্বাধীন হলো। কিন্তু শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, গণতন্ত্র কি হবে? নাকি ভিন্ন কিছু হবে এখানে? সমাজতন্ত্রের ধারণা তখন বাংলাদেশে এক অচল সিকি। এটা নিয়ে কেউ ভাবেনি। বাকশাল গঠনের আগ পর্যন্ত শেখ মুজিবও বোধ করি কল্পনা করেননি যে, তিনি এ দেশে বাকশাল নামক এক স্বৈরতন্ত্রের জনক হবেন। কারণ তার গোটা রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের ইতিহাস। তার গোটা রাজনৈতিক জীবন তিনি নিজেই পদদলিত করেছেন।
তৎকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন তখনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে। সেই ঘোষণা দেয়া অতি জরুরি ছিল কি ছিল না, বিষয়টি আমাদের আলোচ্য নয়। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ সন্ধ্যায় ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় হাজির হয়েছিলেন। তিনি তাকে বারবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার অনুরোধ জানান। শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বলেন, পাকিস্তান সরকার যেন তাকে দেশদ্রোহী বলতে না পারে, সে কারণে তিনি এ ঘোষণা দিতে প্রস্তুত নন। এবং তিনি তা দেবেন না। তাজউদ্দীন আহমদ বিরক্ত হলে কিছুই যায়-আসে না। শেখ মুজিবুর রহমান তার মতো করে হিসাব করেছিলেন।
~~তৎকালের ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রবকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে কেউ একজন জহুরুল হক হলে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ফোন করে জানিয়েছিলেনÑ আজ রাতেই ক্র্যাকডাউন হবে, আপনারা যা পারেন করেন। আ স ম আবদুর রব দিগন্ত টেলিভিশনের ‘দিগন্ত সংলাপ’ টকশোতে আমাকে বলেছিলেন, যিনি তাকে খবরটি দিয়েছিলেন তার কথায় বিশ্বাস করা যায়। তিনি, শেখ ফজলুল হক মনি এবং আরো কয়েকজন রাত প্রায় ৮টার দিকে শেখ মুজিবের বাসভবনে ছুটে গিয়েছিলেন। তারা শেখ মুজিবকে এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, তার জন্য ছয়টি রুট ঠিক করা হয়েছে। পাক বাহিনী ওই রাতেই ক্র্যাকডাউন করবে। শেখ মুজিব কোন রুটে ভারতে যেতে চান।
~~আ স ম আবদুর রবের ভাষ্য অনুযায়ী শেখ মুজিব তাদেরকে বলেছিলেন, তোরা যে যার মতো আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে যা। আমাকে নিয়ে ভাবিস না। তখন আ স ম আবদুর রব জানতে চেয়েছিলেন, তাহলে বঙ্গবন্ধু আপনার কী হবে? শেখ মুজিবুর রহমান তাদের বলেছিলেন, আমার ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। তোরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যা। আ স ম আবদুর রব ও তার সতীর্থরা ফেরত এলেন। ওই দিন আমার একজন বন্ধু ও আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে রিকশা করে ধানমন্ডিতে কী ঘটছে দেখার জন্য সেখানে হাজির হলাম। রাত ৮টা-সাড়ে ৮টা হবে। সব কিছু সুমসাম। ৩২ নম্বরে কোনো কাকপক্ষীও নেই। তাহলে কি মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে? আমার বন্ধু পুরান ঢাকার বাসিন্দা। আমরা ছুটতে শুরু করলাম। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে মোটামুটি সহজেই আমরা আবারো বাংলা একাডেমী পর্যন্ত এসে গেলাম। তারপর ব্যারিকেড। দেখি রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। ঠিক বুঝতে পারলাম না, কী এমন হলো যে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে হবে?
~~আমি থাকি বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে চুনকুটিয়ায়। আমার বন্ধু বলধা গার্ডেন এলাকায়। আমরা রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে থাকলাম। তাকে বললাম, যদি বেঁচে থাকি ফের দেখা হবে। তারপর সে বাড়ির দিকে, আমি সদরঘাটের দিকে দৌড়াতে থাকলাম। পরে ১৯৭৩ সালে দৈনিক বাংলায় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এক সাক্ষাৎকার দেন। তাতে তিনি বলেন, ২৫ মার্চ রাতে সন্ধ্যার দিকেই শেখ মুজিবুর রহমান তার হোল্ডঅল গুছিয়ে ফেলেন। রাত ৮টা থেকে তিনি অবিরাম টেলিফোনের কাছে যেমন পায়চারি করতে শুরু করেন, তেমনি দোতলা থেকে বাইরে খেয়াল করার চেষ্টা করেন, কেউ আসছে কি না। রাত ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানের একটি সামরিক জিপ কয়েকজন সৈনিকসহ শেখ মুজিবের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় হাজির হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তাদের দোতলার কক্ষে নিয়ে যান। সেনাবাহিনীর একজন সিপাহির মাথায় তিনি হোল্ডঅলটি তুলে দেন। তিনি তার নিজের ধূমপানের পাইপটি রাসেলের হাত থেকে নিয়ে নেন। তারপর রাসেল ও ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে আদর করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়িতে উঠে চলে যান।
~~পাকিস্তানে যখন শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সামরিক আদালতে হচ্ছিল, তখন তার আইনজীবী ছিলেন এ কে ব্রোহি, পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী। জনাব ব্রোহি তার সব আর্গুমেন্টে এ কথাই বলার চেষ্টা করেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান কোনো অবস্থাতেই পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহের জন্য দায়ী নন। এবং পাকিস্তান সরকারও কোনোভাবেই সেটা প্রমাণ করতে পারেনি যে, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ওই বিচারিক প্রক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান কোনোরূপ দোষী সাব্যস্ত হননি।
~~এই ছিল ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের ইতিহাস। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি স্বেচ্ছায় কিংবা পাকিস্তানিদের আয়োজনে গিয়েছিলেন লন্ডন। তার সাথে ছিলেন পাকিস্তানের লোকেরা। কারাবন্দী থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান জানতেই পারেননি যে, বাংলাদেশে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এবং তার মাধ্যমে এ দেশের জনগণ বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমান বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে তার সাক্ষাতের আয়োজন করেছিলেন। তারা শেখ মুজিবকে ‘এক্সেলেন্সি’ বলে সম্বোধন করায় বিস্মিত শেখ মুজিব সিরাজুর রহমানের কাছে জানতে চান, এর কারণ কী। তখন সিরাজুর রহমান তাকে প্রথম অবহিত করেন, এর কারণ হলো তিনি একটি সদ্য-স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, তাই এই সম্বোধন। সেই প্রথম শেখ মুজিব জানতে পারলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আর তিনি সেই রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
~~১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে শুরু হয় শেখ মুজিবের শাসনকাল। সে শাসন জনগণের জন্য সুখকর ছিল না। অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, লুণ্ঠন, খুন-গুম, ডাকাতি, রাহাজানি নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ভিন্ন মত দলন ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। সংবাদপত্র দলনও ছিল প্রাত্যহিক বিষয়। রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের ঘটনা ছিল লোমহর্ষক। আর এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল দলীয় ক্যাডারদের নিয়ে। ফলে বিরোধী দল দমনে তাদের উৎসাহের কোনো কমতি ছিল না। রক্ষীবাহিনীর সে ভয়াবহ নির্যাতনের কিছু নজির আছে আহমেদ মুসার বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড : ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ বইয়ে। আর রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষ ইনু সাহেবদের গঠন করা গণবাহিনীকে গ্রামে আশ্রয় দিত। খাবার দিত।
~~শেখ মুজিবের শাসনকালে অপরিমেয় লুণ্ঠনের ফলে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে নেমে আসে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। যে দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মারা যায় প্রায় আট লাখ মানুষ। কিন্তু তখনো আওয়ামী দুর্বৃত্তরা খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য সম্পদ পাচার অব্যাহত রাখে। এদের সম্পর্কে শেখ মুজিব যে কিছুই অবহিত ছিলেন না, এমন নয়। কিন্তু তার সম্ভবত আর কিছুই করার ছিল না। ফলে তিনি সত্যকে মিথ্যা, হয়কে নয় বলে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। সে চেষ্টায় কেউ সফল হয় না, শেখ মুজিবও হননি। আর তারই পরিণতিতে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে অমন ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হয়।
~~প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ যাত্রা যখন ক্ষমতায় আসীন হন, তখনই লিখেছিলাম, এবার শেখ হাসিনার শাসনকার্য পরিচালনা দেখে মনে হচ্ছে, তাকে ১৯৭২-৭৫ শাসনকালের সিনড্রমে পেয়ে বসেছে। প্রথম থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি তেমনি একটি চণ্ডনীতি গ্রহণ করেন। আমরা অনেকেই তাকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছি। তাতে কোনো ফলোদয় হয়নি। বরং আরো অধিক মাত্রায় তার শাসন স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র এখন নির্বাসিত। তার সামান্যতম চর্চাও এখন আর বাংলাদেশে নেই। রাষ্ট্রের স্বার্থ এখন এক ব্যক্তির খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে স্বৈরতন্ত্র আরো জেঁকে বসেছে। নরহত্যা-গণহত্যা এখন যেন খেলার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক দিনে সরকার ১৭০ জন লোককে হত্যা করেছে। এক দিনেই করেছে ৬৬ জনকে হত্যা। এ রকম ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। আর রক্তাক্ত হাত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বলে বসেছেন, এ হত্যার জন্য দায়ী বিরোধীদলীয় নেত্রী। মসজিদে মসজিদে তালা লাগিয়ে দিয়ে মুসল্লিদের লাঠিপেটা করে তিনি বলেছেন, বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন মানুষ নামাজ পর্যন্ত পড়তে পারেনি। এটাকে প্রলাপ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বলতে তিনি কসুর করছেন না। এতে মানুষ আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
~~এর স্বাভাবিক পরিণতি যা হয়, মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে পরিণতি সুখকর হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।
বিষয়: বিবিধ
১২০৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন