ত্বকী হত্যা ও নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ
লিখেছেন লিখেছেন ফয়েজ রহমান ২৫ মার্চ, ২০১৩, ০১:৫৫:২৬ রাত
ত্বকী হত্যাকাণ্ডে ওলটপালট হয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি। বদলে গেছে সব হিসাব-নিকাশ। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে দলীয় নেতাদের পরিকল্পনায় মাঝপথে ছেদ পড়েছে। তৈরি হচ্ছে নয়া ছক। আর তাই জেলা নেতারা একে অন্যকে ঘায়েল করতে মাঠে নেমেছেন। পক্ষে-বিপক্ষে চলছে পাল্টাপাল্টি যুক্তি। এক পক্ষ আরেক পক্ষের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। অভিযোগ খণ্ডাচ্ছেন। এ নিয়ে বিভক্ত-দ্বিধাগ্রস্ত নেতাকর্মীরা। বিভক্তি আগেই ছিল। তা এখন প্রকট। নতুন মাত্রায়। এ বিভক্তি আসন্ন নির্বাচনী ফলাফলে বড় প্রভাব ফেলবে এমনটিও আলোচনা হচ্ছে জোরেশোরে। জেলার প্রভাবশালী দুই নেতা গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমান ফের মুখোমুখি রাজনীতির ময়দানে। প্রকাশ্য রাজপথে একজন কথা বলছেন আরেকজনের বিরুদ্ধে। একজন জিডি করছেন অন্যজনের বিরুদ্ধে। আইভী খুন, সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলছেন শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে। শামীম ওসমানের অভিযোগ আইভী ক্ষতি করছেন আওয়ামী লীগের। নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ গঠিত হয়েছে। ওই মঞ্চের প্রতিটি বক্তার বক্তব্যই শামীম ওসমানসহ তার পরিবারকে ঘিরে। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরা বলছেন, ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দলের নেতার নাম উচ্চারিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ।
সরকারের শেষ মুহূর্তে এমন একটি পরিস্থিতিতে অস্বস্তিতে পড়েছেন সাধারণ নেতাকর্মীরাও। আবার সিটি নির্বাচনে পরাজিত হয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো শামীম ওসমানও আরেক ধাপ পিছিয়ে পড়েছেন এ ঘটনায়। হত্যাকাণ্ডের জন্য তার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ডা. আইভীও নাছোড়বান্দা। তিনি এই হত্যার রহস্য উন্মোচন না হওয়া পর্যন্ত থামবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। আবার শামীম ওসমানও বলছেন, তিনি প্রমাণ করে ছাড়বেন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তবে তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ড নতুন করে আওয়ামী লীগকে আবারও দ্বিখণ্ডিত করেছে। বিভক্ত আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত এক হতে না পারলেও ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচার ও দোষীরা গ্রেপ্তার না হলে এর প্রভাব পড়বে আগামী নির্বচানে। ইতিমধ্যেই নারায়ণগঞ্জে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন গুঞ্জন শুরু হয়েছে। শোনা যাচ্ছে নাগরিক সমাজের ব্যানারে নারায়ণগঞ্জ সদর আসনে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন আওয়ামী লীগের পদত্যাগী নেতা এসএম আকরাম। তিনি প্রার্থী হলে তাকে সমর্থন করবেন সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। নারায়ণগঞ্জ থেকে সন্ত্রাস নির্মূলের স্লোগান সামনে নিয়ে এসএম আকরাম প্রার্থী হলে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীকে- এমনটাই মনে করছেন এলাকার সাধারণ মানুষ।
এক সময় নারায়ণগঞ্জবাসীর ঘুম ভাঙতো বোমা ও গুলির শব্দে। আদমজী বন্ধ হলেও শহরে সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করলেও এসএম আকরামকে ত্বকী মঞ্চের কমিটিতে রাখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদে। ত্বকী হত্যাকাণ্ডসহ নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসের জন্য আওয়ামী লীগের একাংশসহ ত্বকী মঞ্চ থেকে আঙুল তোলা হচ্ছে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে। খান সাহেব ওসমান আলী থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত টানা ৭০ বছর ধরে প্রায় নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ঘুরে ফিরে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে ওসমান পরিবার। ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে এত অভিযোগের পেছনে সন্ত্রাসের পাশাপাশি তাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রভাবও একটি কারণ বলে অনেকে মনে করেন।
ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত। দলের একাংশ মনে করে ত্বকীর বাবা ও আইভীর বক্তব্য সত্য। আরেক অংশ মনে করে শামীম ওসমান ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নন। কেবলমাত্র রাজনৈতিক কারণে ঘায়েল করতে তাকে জড়ানো হচ্ছে। ইতিমধ্যেই জেলা আওয়ামী লীগের একাংশ বৈঠক করে শামীম ওসমানসহ জেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের নামে দায়ের করা অভিযোগ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের পদত্যাগী সভাপতি সাবেক এমপি এসএম আকরাম, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা যুবলীগ সভাপতি আবদুল কাদির, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনউদ্দিন, রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন এবং সিটি মেয়র নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী আছেন একসঙ্গে ওসমান পরিবারের বিরোধী ধারায়। অন্যদিকে শামীম ওসমানের সঙ্গে আছেন বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম সাগর। সিদ্ধিরগঞ্জ সভাপতি মজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়া। ফতুল্লার সভাপতি সাইফুল্লাহ বাদল, সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী। সদর উপজেলা সভাপতি সাহাবুদ্দিন মণ্ডল, সাধারণ সম্পাদক আল মামুন। জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত বাদল, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাফায়েত হোসেন সানি, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন। শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা। সোনারগাঁ উপজেলা সভাপতি এডভোকেট সামসুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাই। নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কোন কমিটি নেই।
দলের নিবেদিত কর্মীরা সন্ত্রাসীদের পছন্দ করে না- কবরী: নারায়ণগঞ্জ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি সারাহ বেগম কবরী ত্বকী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন ও দোষীদের শাস্তি দাবি করে বলেন, দুঃখজনক এই হত্যাকাণ্ডটি মেনে নেয়া যায় না। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি সম্পর্কে কবরী বলেন, ত্বকী হত্যাকাণ্ডটি এখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। কারণ সন্দেহের তীর শামীম ওসমানের দিকে। শামীম ওসমান তো আওয়ামী লীগই করেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি, যারা হত্যার রাজনীতি করে সাধারণ মানুষ তাদের চেনে। তাদের রাজত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক একটি বড় দল। সন্ত্রাসীদের দলের নিবেদিত কর্মীরা পছন্দ করে না। কবরী বলেন, নারায়ণগঞ্জের সর্বক্ষেত্রে বিশেষ বাহিনী, বিশেষ পরিবার সংশ্লিষ্ট। ফলে রাজনীতিতে ভাল মানুষ না হলে যা হয় তা-ই হচ্ছে। বিগত দিনে যে সব হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল সেগুলোর বিচার না হওয়ায় আজ ত্বকীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসী সোচ্চার হয়েছে বলে আজ ঘাতকদের মনে ভয় ঢুকেছে। তাদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। এক প্রশ্নের জবাবে কবরী বলেন, এখানে রাজনীতি করতে এসে আমাকে নিজ দলের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে- আইভী: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, যে সময়ে সরকারের ভাবমূর্তি জনগণের কাছে উজ্জ্বল হচ্ছিল- ঠিক সেই সময়ে নারায়ণগঞ্জে ত্বকীর মতো একটি মেধাবী শিশু হত্যাকাণ্ড নারায়ণগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি উলটপালট করে দিয়েছে। নিহতের পিতা তার ছেলেকে হত্যার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান ও তার পরিবারকে দায়ী করেছেন। এতে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। তাই শামীম ওসমানকেই এখন প্রমাণ করতে হবে তিনি বা তার পরিবার ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। এক প্রশ্নের জবাবে আইভী বলেন, ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকাণ্ডে কোন প্রভাব পড়েনি। কারণ, আওয়ামী লীগ মেধাবী ছাত্র ত্বকী হত্যার রহস্য উন্মোচন এবং এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে চায়। তিনি বলেন, শামীম ওসমানের সঙ্গে কোন বিরোধে যাইনি, যাবোও না। তিনি দলের যেই কমিটিতে থাকবেন সেই কমিটিতে আমি থাকবো না। কারণ, যারা দলের সাধারণ কর্মীদের পুঁজি করে নিজেদের আখের গোছায়, আবার দলের দুঃসময়ে কর্মীদের ফেলে রেখে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায় ওই ধরনের বিতর্কিত নেতাদের সঙ্গে রাজনীতি না করাই ভাল।
ত্বকী হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো হয়েছে- শামীম ওসমান: সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ত্বকী হত্যাকাণ্ড ও জেলার সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যখন আমাদের পুরো আওয়ামী লীগকে একতাবদ্ধ হয়ে এক সঙ্গে স্বাধীনতাবিেরাধী শক্তির বিরুদ্ধে মাঠে থেকে লড়াই সংগ্রাম করার কথা ঠিক সেই সময় আমরা ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলছি। এছাড়া সামনে নির্বাচন আমাদের নির্বাচনী প্রস্তুতির দরকার সে সময়ে এখানে দলকে আরও বিভক্ত করছি। এটা করার একটাই উদ্দেশ্য নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, কারা পেছন থেকে ইন্ধন দিচ্ছে আমরা তাদের চিনি, তারা কেউ কোন দিন আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল না, তারাই আজ ত্বকী হত্যাকাণ্ডকে রাজনীতির হাতিয়ার করেছে আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করতে। তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি আমি চাই ত্বকী হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হোক আসল খুনিরা বেরিয়ে আসুক, প্রশাসনের কাজ প্রশাসন করুক। সকলের কাছে অনুরোধ, ত্বকী হত্যা নিয়ে কোন রাজনীতি করবেন না। শামীম ওসমান বলেন, আমি প্রমাণ করবো আমি ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নই, আমার পরিবারের কেউ জড়িত নয়।
বিষয়: বিবিধ
২০৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন