ব্রিটিশ নাগরিক হামিদীকে জামায়াত বানিয়ে শাহবাগীদের হাতে তুলে দেয় পুলিশ
লিখেছেন লিখেছেন ফয়েজ রহমান ২৩ মার্চ, ২০১৩, ১০:১৪:২৭ রাত
মাওলানা শেখ নূরে আলম হামিদী একজন ব্রিটিশ নাগরিক। বাংলাদেশে এসেছিলেন বেড়াতে। নিউ মার্কেট যাচ্ছিলেন কেনাকাটা করতে। পথে কাঁটাবন মসজিদে যান জুমার নামাজ আদায় করতে। সেদিন ছিল ২২ ফেব্রুয়ারি। আল্লামা শাহ আহমদ শফী সেদিন সারা দেশের মসজিদ থেকে জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন ধর্ম অবমাননার প্রতিবাদে। কাঁটাবন মসজিদ থেকে মিছিল যাতে বের হতে না পারে সেজন্য নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ গুলি ও টিয়ার শেল মারতে থাকে মসজিদের ভেতরে থাকা মুসল্লিদের লক্ষ্য করে। এ সময় শেখ নূরে আলম হামিদী ও তার সাথে থাকা আরো চারজনকে আটক করে পুলিশ। তাদের জামায়াত-শিবির আখ্যায়িত করে শাহবাগ মঞ্চে নিয়ে শাহবাগীদের হাতে তুলে দেয় গণধোলাইয়ের জন্য। পরে তাদের পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গি আখ্যায়িত করে পুলিশ। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালায়। ২৫ দিন কারাভোগের পর অবশেষে ব্রিটিশ সরকারসহ বিভিন্ন মহলের হস্তক্ষেপে মুক্তি পান তিনি।
গ্রেফতারের পর নির্যাতন ও কারাভোগের নির্মম অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে। পাঠকের জন্য এখানে তা তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আপনার পরিচয় বলুন।
শেখ নূরে আলম হামিদী : আমাদের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল। আমার আব্বা মাওলানা শেখ খলিলুর রহমান হামিদী বরুনার পীর। আমি ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স করেছি। বরুনা মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছি। এরপর আমি ১৯৯৯ সালে লন্ডন যাই। সেখানে আনজুমানে হেফাজতে ইসলাম সেন্টারে প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এটি পূর্ব লন্ডনের প্লাস্টোতে অবস্থিত। আমি লন্ডনে একটি মাদরাসায় পড়াই এবং মসজিদে জুমার নামাজে ইমামতি করি। আনজুমানে হেফাজতে ইসলাম সেন্টারের অধীনে মসজিদ, মাদরাসা, বয়স্ক শিক্ষা, মাদকাসক্ত পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে কবে আসলেন?
শেখ নূরে আলম হামিদী : জানুয়ারিতে। আমার আব্বা যেহেতু পীর, তাই ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছিল বরুনায়। সম্মেলন উপলক্ষে আমি বাড়িতে আসি।
প্রশ্ন : ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কি করছিলেন এবং কাঁটাবন মসজিদেই বা গেলেন কিভাবে?
শেখ নূরে আলম হামিদী : আব্বার সম্মেলনে বিদেশ থেকেও অনেক মেহমান ও ভক্ত এসেছিলেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ থেকে মেহমান এসেছিলেন। তাদের পৌঁছে দিতে ঢাকাই আসি। ২১ তারিখ তাদের ফাইট ছিল। আমি, আমার ভাগনেসহ চারজন ঢাকায় আসি তাদের পৌঁছে দিতে। উত্তরার একটি হোটেলে রাতে ছিলাম আমরা। ২২ ফেব্রুয়ারি নিউ মার্কেটে যাচ্ছিলাম কিছু কেনাকাটার জন্য। যাওয়ার পথে আমরা কাঁটাবন মসজিদে যাই জুমার নামাজ আদায় করতে। নামাজ শুরুর সামান্য আগে আমরা চারজন মসজিদে প্রবেশ করি।
প্রশ্ন : এরপর কী হলো?
শেখ নূরে আলম হামিদী : নামাজ শেষ হতে না হতেই পুলিশ টিয়ার শেল ও গুলিবর্ষণ শুরু করল মসজিদের ভেতর। আমাদের চোখ জ্বলছিল। অজুখানায় গিয়ে পানি দিলাম। চোখে ঠিকমতো কিছু দেখছিলাম না তখন। নিচে নেমে আসছিলাম। হঠাৎ একজন লোক আমার পাঞ্জাবি খামছে ধরে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল। পাগড়িও টেনে ছিঁড়ল। টুপি পরে গেল। তখন আমিও ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ঘুসি মারলাম। এরপর পুলিশ আমাদের ওপর হামলে পড়ল। পিটিয়ে আহত করে আমাদের টেনে হিঁচড়ে বাইরে বের করে আনল। হ্যান্ডকাফ পরাল। হাঁটিয়ে শাহবাগের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমি তাদের বারবার বললাম আমি ব্রিটিশ নাগরিক। আমি মেহমান। আমি দেশে বেড়াতে এসেছি। কিন্তু তারা শুনল না। শাহবাগের মঞ্চের কাছে নিয়ে আমাদের জামায়াত-শিবির আখ্যায়িত করে সেখানকার লোকদের হাতে তুলে দিলো গণধোলাই দেয়ার জন্য। আমাদের আক্রমণের জন্য তাদের লেলিয়ে দিলো পুলিশ। তারা আমাদের দিকে তেড়ে আসল। কিন্তু মারতে সাহস পেল না। আমাদের গালিগালাজ এবং ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করল। আমাদের গাড়িটিও পুলিশ শাহবাগে নিয়ে আসল। পুলিশের সামনে মঞ্চের লোকেরা সেটি ভেঙে ফেলল।
প্রশ্ন : এরপর কী হলো?
শেখ নূরে আলম হামিদী : তারপর আমাদের শাহবাগ থানায় নিয়ে গেল পুলিশ। এশা পর্যন্ত সেখানে রাখল। আমার পায়ের গুলির স্থান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এ সময় আমাদের খাবার পানিও দেয়া হলো না। আসর, মাগরিব ও এশার জন্য অজুর পানিও দিলো না। পুলিশ বলল, জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে কিছু দেয়া হবে না। রাতে ডিবি অফিসে নিয়ে গেল। আমার ভাগনের চোখ বেঁধে প্রথমে তাকে একটি রুমে ঢুকাল। তার জন্ম মক্কায় হয়েছে। সে কুরআনের হাফেজ এবং একজন নামকরা ক্বারি। পরে আমাকেও চোখ বেঁধে একটি রুমে ঢুকাল। ডিবি পুলিশ মশিউর ও আরো দুই-তিনজন ছিল তারা। আমাকে লাঠি দিয়ে পেটাল। রাতে ডিবি গারদে রাখল। আমার কাছে থাকা অনুমান ২৯ হাজার টাকা, মোবাইল, ক্রেডিট কার্ড, সব কিছু ডিবি এসআই নাসের জমা নিলো। সে ক্রেডিট কার্ড থেকে কয়েক বার শপিং করেছে জানতে পেরেছি স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করে। ডিবি গারদে থাকা অবস্থায় আমি সকালের দিকে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলো। পরে শাহবাগে আনা হলো সেখান থেকে। কিন্তু প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ দিলো না। জামায়াত-শিবির, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ প্রভৃতি অভিযোগে মামলা দিলো। এরপর সেখান থেকে আদালতে চালান দিলো। দুই দিন রিমান্ড মঞ্জুর করলেন আদালত। ওসি সিরাজুল ইসলাম থানায় নিয়ে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীরের কোনো জায়গা বাকি রাখেনি পেটাতে। পেটানোর সময় ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, গোপালগঞ্জের টাইগার। শেখ হাসিনার খুব কাছের লোক।
তারপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চালান দেয়া হলো। কারাগারে আমদানি সেলে রাখার পর কারা হাসপাতাল-৪ এ নেয়া হলো। হাসপাতাল-৪ এর দায়িত্বে ছিল কয়েদি সুলতান। যেদিকে নামাজি লোকেরা থাকে সেদিকে না দিয়ে মদ, গাঁজা খাওয়া লোকেরা যে দিকে থাকে সেদিকে আমাকে সিট দিলো। মদ-গাঁজার দুর্গন্ধে আমি সেখানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে ডাক্তার কুণ্ডুর কাছে নেয়া হলো। সে বললেন সিগারেট, মদ, গাঁজামুক্ত কোনো সিট নেই। পরে জানলাম টাকা-পয়সা দিলে সুলতান ভালো জায়গায় সিটের ব্যবস্থা করে। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ডাক্তার কুণ্ডু আমার সাথে দুর্ব্যবহার করেন। আমি ডায়াবেটিসের রোগী। কিন্তু আমার নিজের ওষুধও তিনি ১১ দিন পর্যন্ত আটকে রেখেছিলেন। আমি জুমার নামাজ পড়িয়েছিলাম কারাগারে। ফার্মাসিস্ট প্রাণকৃষ্ণ আমার প্রেসার মাপতে এসে হুমকি দিয়ে বলেন, সেলের মধ্যে থাকা অন্যান্য জামায়াত-শিবিরের বন্দীদের সাথে দল পাকানো বন্ধ না করলে আমাকে ইনজেকশন পুশ করে চিরদিনের জন্য ঘুম পরিয়ে দেবেন। জেলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আদালত নির্দেশ দেন আমাকে নিজ খরচে কারাগারের বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু কারাগারের ডাক্তার কুণ্ডু বলেন, তার চাকরি চলে গেলেও তিনি আমাকে বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠাবেন না। আমি অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও সেদিন আমাকে কারা হাসপাতালে রাখেননি সে। মেঘনা-৮ এর ফোরে রাখলেন সারারাত। সকালে আমদানিতে কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে আবার সেখান থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে পাঞ্জাবি পরারও সুযোগ দেয়া হয়নি। শুধু বাসি গেঞ্জি পরা অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন আমার বিরুদ্ধে কোর্টে অভিযোগ আনা হয়, আমি আফগানিস্তান ফেরত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তালেবান যোদ্ধা। এসআই জলিল নামে একজন আমার বিরুদ্ধে লিখলেন, আমি পাকিস্তানের লস্করই তৈয়্যবার কিলিং স্কোয়াডের সদস্য। এই বলে কোর্টের কাছে রিমান্ড চান তিনি। কোর্ট রিমান্ড মঞ্জুর না করে সেদিন জেলগেটে এক দিনের জন্য জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেননি।
প্রশ্ন : কত দিন জেলে ছিলেন?
শেখ নূরে আলম হামিদী : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং কাশিমপুর মিলিয়ে ২৫ দিন। ১৯ মার্চ মুক্তি পাই জামিনে। দুঃখের বিষয় হলো সংসদের চিফ হুইপ উপাধ্যাক্ষ আব্দুস শহিদ ১৫ ফেব্রুয়ারি আমার আব্বার বরুনা সম্মেলনে গিয়েছিলেন প্রধান অতিথি হিসেবে। তার কাছে আমার পরিবার এবং এলাকার অনেক গণ্যমান্য লোকজন গিয়ে অনুরোধ করেছিলেন আমার বিষয়ে একটি প্রত্যয়নপত্র দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি দেননি। আমার সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে জানা সত্ত্বেও উল্টো অভিযোগ করেছেন আমার সাথে জঙ্গি কানেকশন আছে। সংসদেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ করলেন পাকিস্তানি নাগরিক ধরা পড়েছে।
প্রশ্ন : আপনাকে জামায়াত-শিবির আখ্যায়িত করে পুলিশ গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছে। মামলাও করেছে এ অভিযোগে। জামায়াত-শিবিরের সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক আছে?
শেখ নূরে আলম হামিদী : জামায়াত-শিবির কেন আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে যে মামলা দেয়া হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব দলের প্রধানদেরও আসামি করা হয়েছে। আমাকে করা হয়েছে এক নম্বর আসামি।
রিমান্ডের আগে ও পরে পুলিশি নির্যাতন এবং কারাগারে থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন শেখ নূরে আলম হামিদী। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি চিকিৎসা নিতে একটি হাসপাতালে ভর্তি হন।
শেখ নূরে আলম হামিদী জানান, বর্তমানে লন্ডনে তার স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। তিন ছেলেই আবাসিক মাদরাসায় ভর্তি রয়েছেন। বাংলাদেশের এ ঘটনার কারণে লন্ডনে তার চাকরি চলে গেছে। ৫ মার্চ লন্ডনে যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু মামলার কারণে যেতে পারছেন না। লন্ডনে তার পরিবার অসহনীয় অবস্থায় নিপতিত হয়েছেন। এখানে কত দিনে তার ঝামেলা মিটবে তাও জানেন না তিনি।
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন