৫ পাগল ও ১৩ নাস্তিকের পিঠে স্বদেশ
লিখেছেন লিখেছেন ফয়েজ রহমান ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:০৯:৫৩ রাত
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। যেখানে হাজারো প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে। হাজির করা হচ্ছে উদ্ভট সব তত্ত্ব। চলছে রাষ্ট্রীয় রসিকতা। সাভারের রানা প্লাজায় ভবন ধসে লোক উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী টকশোতে কথা না বলে উদ্ধার কাজে যোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বাইরের ময়লা পরিষ্কারের আগে প্রয়োজন ঘরের ময়লা পরিষ্কার। এটা কে প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাবে। বাড়তি কথার ফুলঝুরি নিয়ে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শীতল কক্ষে বসে ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছেন। নাড়াচাড়া তত্ত্ব হাজির করছেন। শুনেছি তিনি উচ্চশিক্ষিত। নামের আগে ডক্টরেট যুক্ত করেছেন। কিন্তু যাদের শ্রমে ঘামে এই দেশ, এই পতাকা। মন্ত্রী হয়ে নিশান পেট্রোল গাড়িতে চড়ছেন, মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার যে শপথ করেছেন, তার কি হবে? লাখো মানুষের কান্নার কি কোন দাম নেই?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর বিবিসিকে বলেছেন, দুর্ঘটনার আগে কিছু মৌলবাদী ও বিএনপির ভাড়াটে লোক সাভারের ভবনটির গেট ও বিভিন্ন স্তম্ভ ধরে ‘নাড়াচাড়া’ করছিল। তিনি আরও বলেছেন, ওনাকে জানানো হয়েছে হরতাল সমর্থক কতিপয় ভাড়াটে লোক সেখানে গিয়ে এ ধরনের কাজ করেছে। বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, যারা পুলিশের নিষেধ সত্ত্বেও ভবন বন্ধ না রেখে; শ্রমিকদের জবরদস্তি করে, বেতন দেয়া হবে না বলে কাজে বাধ্য করলো; বাড়ি বাড়ি ঘোষণা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবনে লাশ হতে শামিল করালো সেই তত্ত্ব কি ওনাকে জানানো হয়নি। না হলে পত্রপত্রিকাতেই আছে, ওনার দলের এমপি তৌহিদ মুরাদ জং ভবন মালিককে উদ্ধার করে গাঢাকা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। বলাবলি আছে, মূল হোতা যুবলীগ নেতা রানাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রানাকে বাঁচাতে এমপি দরদের পরিচয় দিয়েছেন। তাকে লাপাত্তা করার জন্য যে কৌশলের পরিচয় দিয়েছেন এটা কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না। মিডিয়ায় অতিকথনের সময় যথারীতি তিনি নিশ্চয়ই তা ভুলে গেছেন। সারা দেশ যখন উদ্বিগ্ন, সেই সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য গরিব শ্রমিকদের লাশের সঙ্গে পরিহাস ছাড়া কি হতে পারে? অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ার হয়তো ভূতের। না হলে কোনও পাগলেও কি এ ধরনের কথা বলতে পারে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে যখন দেশজুড়ে নিন্দা আর প্রতিবাদ চলছে ঠিক তার পরদিনই সচিবালয়ে তিনি একই কথা পুনর্ব্যক্ত করলেন। নিজ বক্তব্যে অটল থাকার কথা সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দিলেন। বিবিসিতে এই কথাগুলো আমি বলেছি। কারণ, ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর সেখান থেকেই আমাকে বলা হয়েছে, সকাল বেলা যখন এই ফ্যাক্টরিগুলোতে কাজ হচ্ছিল, তখন সরকারবিরোধী হরতাল সমর্থকরা সেখানে গিয়ে এগুলো বন্ধ করার অপপ্রয়াস করেছিল। সেখানে প্রায় ধসে যাওয়া একটি স্তম্ভ এবং তার সঙ্গে সংলগ্ন একটি কলাপসিবল গেট নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করা হয়েছিল। এই ধাক্কাধাক্কির ফলে ধস নামতে পারে। আমরা মখার মুল্লুকের বাসিন্দা। কোন সভ্য দেশের বাসিন্দা হলে হয়তো এর তাৎক্ষণিক জবাব পেতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যাদের স্বপ্নগুলো চাপা পড়ে আছে ধসে যাওয়া ভবনের নিচে, স্বজনহারাদের পরিবারগুলোর যে আহাজারি তা কি একবারও ভাবলেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। শুধু এ ঘটনাই নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর নানা ধরনের বিতর্কিত কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন। কেরানীগঞ্জের পরাগ অপহরণের ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, অপহরণকারীদের কোনো মুক্তিপণ দেয়া হয়নি। কিন্তু র্যাবের মিডিয়া উইং থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছিল, মুক্তিপণের টাকা দিয়েই পরাগকে উদ্ধার করা হয়। সমপ্রতি এ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকরা গ্রেপ্তার তিন ব্লগারের নাম জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নাম বলা যাবে না।’ অথচ ডিবি ওই ব্লগারদের গ্রেপ্তারের পর একই দিন সকালে মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিং করে তিন ব্লগারের নাম প্রকাশ করে। পরে বিষয়টি জেনে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকেও হাসতে দেখা যায়। পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে মন্ত্রীর বক্তব্যে ও পুলিশের বক্তব্যের মিল ছিল না। যে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
কয়েক দিন আগে নাশকতাকারীদের দমনে দেখামাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলির নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিষয়টি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই নির্দেশের সত্যতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রচলিত আইনের মধ্যেই প্রয়োজনে গুলি করার বিধানটি রয়েছে।’
এছাড়া গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচারের বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক নেতারা কথা বলতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। একপর্যায়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সাগর-রুনির চলাফেরার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমরা এগুলো প্রকাশ করতে চাই না।’ একথা বলার পর সাংবাদিক নেতারা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হন।
সাভার ট্র্যাজেডি নিয়ে একেকজন একেক কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে পুরনো কথাই বললেন। যে দলেরই হোক কোন ছাড় দেয়া হবে না। আবার বলেছেন, রানা যুবলীগের কেউ নন। অথচ সংবাদ বেরিয়েছে, যুবলীগ থেকে রানাকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনারা স্বজন হারিয়েছেন। স্বজন হারাবার ব্যথা নিয়ে আপনাদের উদ্দেশে কিছু লেখা অতিলেখন হয়ে যাবে। যুবলীগ হোক বা অন্য দলের হোক তাকে গ্রেপ্তার করে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। কথা রাখুন। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রিয়াজ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা স্থানীয় যুবলীগ নেতা বলে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘আমি সাভারের যুবলীগের কমিটির নাম নিয়ে এসেছি। সেখানে রানার নাম নাই’। স্থানীয় সংসদ সদস্য মুরাদ জং টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাতকারে তার সঙ্গে ‘তথাকথিত রানা’র যোগাযোগ নেই বলে দাবি করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত রানাকে গ্রেপ্তার করা হবে না। একটা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, যাতে এটা আবিষ্কার হতেও পারতো যে রানা বা অন্য কেউ দায়ী কিনা। কিন্ত সে কমিটিতে আছেন সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কবীর হোসেন সরদার, যিনি মঙ্গলবার দিন বলেছিলেন ‘ভবনটি ধসে পড়ার মতো কোনো কারণ এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না।’ এ কমিটি নিয়ে আপত্তি করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। বলা হচ্ছে কেন্দ্রীয় যুবলীগ সাভার পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানাকে বহিষ্কার করবে বলে জরুরি ভিত্তিতে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ডেকেছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির চেয়ে এখন উদ্ধার কাজে বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার। এই কথাগুলো পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে ফেলেছেন? এখনও তো সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তার সভাসদদের কথাগুলো বলা হয়নি। তার সঙ্গে আবার জুটেছে ‘গজবের’ গল্প। ক্লান্ত হবেন না। আবার পড়ুন গোড়া থেকে। বুঝতে পারলেন? একটা বৃত্তচক্র তৈরি করার কাজ সম্পাদন হয়েছে। আমরা মাত্র একজন অপরাধী প্রায় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন তাও যাই যাই। কিন্তু আসলে কিভাবে কি ঘটে তা নিয়ে ভাবার, খুঁজে বের করার চেষ্টা কই? কারণ, খুঁজে বের করবো কি আটকে পড়া মানুষদেরই বের করতে পারি না। অস্ত্র কিনতে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারি কিন্তু উদ্ধারের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে টর্চলাইট খুঁজতে হয়। কিন্তু আমরা বৃত্তচক্র তৈরি করে এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে পারি, বাংলাদেশের রাজনীতি-ব্যবসায়ীরা তাতে সিদ্ধহস্ত। আসুন, এখন আপনার-আমার যা করণীয় তাই করি, ‘কলুর বলদের মতো’ এই বৃত্তচক্রে ঘুরতে থাকি।
ঘটনা তদন্তে একাধিক কমিটি গঠিত হয়েছে। স্পেকট্রাম, ফনিক্স, স্মার্ট ফ্যাশন, তাজরীনসহ একাধিক দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছিল। একযুগে ছয় শতাধিক গরিব শ্রমিক একমুঠো ভাতের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। একটিরও মূল হোতারা চিহ্নিত হয়নি- বিচার তো বহুদূর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে মায়ের বুক খালি হয়েছে; যে পিতা তার সন্তানের জন্য পথ চেয়ে আছেন; যে স্ত্রী তার স্বামী; যে স্বামী তার স্ত্রীর খোঁজে থেকে থেকে ফিরছেন, তাদের বুকফাটা কান্না নিয়ে কোনও রসিকতা করবেন না প্লিজ। দেশজুড়ে যে আহাজারি চলছে তার সঙ্গে শামিল হোন। অবাধ মৃত্যুর ব্যবস্থা যারা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন।
সর্বত্র নিন্দার ঝড়
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘একটা শিশুও একথা বিশ্বাস করবে না যে সাভারের ভবনটি টেনে ভেঙে ফেলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উচ্চশিক্ষিত মানুষ। তিনি যেটা বলেছেন সেটা হাস্যকর ব্যাপার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের জের ধরে তাকে ্তুঅপ্রকৃতিস্থ্থ আখ্যায়িত করে নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক বিশিষ্ট কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার বলেছেন, অবিলম্বে অপ্রকৃতিস্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে। খুঁটি নাড়ালে যিনি মনে করেন একটি ভবন ধসে যায়, এ ধরনের ব্যক্তির মন্ত্রিত্বে থাকা জাতির জন্য লজ্জাজনক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে হাস্যকর উল্লেখ করে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী উল্টো প্রশ্ন করেছেন, ঝাঁকুনি দিয়ে কীভাবে ভবন ভেঙে ফেলা সম্ভব?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছুটা বিব্রত। এ অবস্থায় দলের অভ্যন্তর থেকেও সমালোচনা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সংযত হয়ে কথা বলার পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি উল্টাপাল্টা কথা না বলে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। গতকাল শ্রমিক লীগের এক যৌথসভায় তিনি এ আহ্বান জানান।
হরতাল সমর্থকদের জড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হতাহতের ঘটনায় সরকার ও বিজিএমইএ পুরোপুরি দায়ী।
বিষয়: বিবিধ
১৯৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন