একজন সফল গোলাম আযম ও ব্যর্থ গোলাম আযশামীম by তারিকুর রহমান
লিখেছেন লিখেছেন স্বপন১ ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৬:৪৮:০৮ সকাল
অধ্যাপক গোলাম আযম কে? যাদের কাছে তিনি রাজাকার সম্রাট তাদের কাছে তিনি জামায়াত গুরু। যদিও রাজাকার গঠনের ক্রেডিটটা জেনারেল নিয়াজীর। তিনি নিজেই দাবী করেছিলেন যে রাজাকার তারই ব্রেইন চাইল্ড। তবে চেতনার “মহান” দলিল পত্রে গোলাম আযমই রাজাকার গঠনকারী হিসেবে আখ্যায়িত। জেনারেল নিয়াজীকে নিয়ে বাংলাদেশিদের অনেক কিছু আসলে গেলেও বাংলাদেশিদের নিয়ে জেনারেল নিয়াজির কিচ্ছু যায় আসে না। তাই জেনারেল নিয়াজিকে রাজাকারের প্রতিষ্ঠাতা বানালে বাংলার মাটিতে খেলা জমবে না। তো গোলাম আযমকে রাজাকার স্রষ্টা বানিয়ে দেয়ার মতো একটি ডাহা মিথ্যাবাদিতার আশ্রয় নিতে হয়েছে চেতনা বাদীদেরকে। এ ক্ষেত্রে গোলাম আযমকে ছাড়া তাদের চলছে না। বলা যেতে পারে এখানে সফল গোলাম আযম। কারণ সত্যের অপলাপটা তার বিপক্ষ শক্তি করেছে। রাজাকার বাহিনী গঠনের সাথে জড়িত থাকার কথা গোলাম আযম নিজেও অস্বীকার করেছেন। ১৯৭১ সালের ২রা সেপ্টেম্বর সরকারীভাবে দ্য ঢাকা গ্যাজেটে রাজাকার কমান্ডারদের নাম পরিচয় প্রকাশিত হয়। সেই তালিকায় গোলাম আজমের নাম নাই। তবে শান্তিবাহিনী গঠনের সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন। প্রিয়ভাই আহমাদ মুসাফফা তার একটি পোষ্টে রেফারেন্স সহ বিষয়টির বিষদ ব্যাখ্যা করেছেন।
এদিকে একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ গোলাম আযম সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, অনেকেই বলতে চান যে তার কৃতকর্মের জন্য তিনি ক্ষমা চাইলেই হত। কিন্তু তিনি একবারের জন্যেও ক্ষমা চান নি। শুধু অস্বীকার করে গেছেন কিন্তু তার বিপক্ষ শক্তির সীমাহীন অপপ্রচারের জবাবে একটা কথাও বলেন নি। তার এ কথা না বলাটাকে অনেকেই ভুল পদক্ষেপ হিসেবে দেখেন। কিন্তু আজ তিনি তার কৌশলে সফল হয়েছেন বলে কিছু যুক্তি দাড় করানো যায়। খুব সম্ভবত এই একই কারণে জামায়াতের অন্য নেতারাও কথার পিঠে কথা বলে বিতর্কে জড়িয়ে পানি ঘোলা করেন নি। আমার মনে হয়েছে গোলাম আযম বাংলাদেশের মানুষকে সুন্দর ভাবে শ্রেণীবিভক্ত করে তার কৌশল নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি জানতেন একটা পক্ষ কোনও যুক্তিই শুনবে না। তাদেরকে আমরা শাহবাগী বলে জানি। কারণ তারা তাকে রাজাকার স্রষ্টা বানিয়েছেই যুক্তি না শোনার জন্য। তাল গাছটা নিজের কোর্টে রাখার জন্য। গোলাম আযম তাই তাদের সাথে অযথা কথা চালাচালিতে যান নি।
তিনি জানতেন যে আরেকটা পক্ষ ইতোমধ্যেই তার প্রতি আস্থাশীল। তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে যারা তাঁর খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে অবগত। সুতরাং তাদের আস্থায় ফাটল ধরবে না সহজে। তাদেরকে আমরা জামায়াতে ইসলামি বলে জানি। এর পরে বাকি থাকে সাধারণ জনগণ। এর মধ্যে কিছু লোক চিন্তাশীল, কিছু লোক অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত আবার কিছু লোক জাস্ট মাঝামাঝি। এরা সবাই একসাথে দর্শক ও শ্রোতা। অন্ধ অনুকরণ যারা করেন তাদের বাদ দিলে বাকি থাকে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী।
যেটা বাদ বাকি সব দলের সমষ্টির চাইতে ঢের বড়। গোলাম আযম মূলত চুপ থেকেছেন তাদের জন্য। তারা শুধু দেখে যাবে কিভাবে সাক্ষীগোপাল সাজানো হচ্ছে, কিভাবে বায়াসড আইন বানানো হচ্ছে, কিভাবে আসামী পক্ষের সাক্ষী অপহরণ করা হচ্ছে, কিভাবে সাক্ষীদের জবানবন্দী ও জেরার সময় দেয়া সাক্ষ্যের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ হচ্ছে, কিভাবে বিচারকেরা কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাচ্ছেন, কিভাবে রায়ের আগেই সরকারের মন্ত্রীরা রায় বলে দিচ্ছে। এই যে “আমি খাড়ায়া যামু, আপনে আমারে বসাইয়া দিবেন” টাইপের নাটক জনগণ দেখেছে এটাই মূলত গোলাম আযমের জবাব। যার যেয়ে বড় মাইর আর নাই। বিতর্কিত আইন, বিতর্কিত সাক্ষী, বিতর্কিত বিচারক, বিতর্কিত বিচার প্রক্রিয়া ও বিতর্কিত রায়ের মধ্যেই গোলাম আযম তার সকল জবাব রেখে গিয়েছেন। এখানেও সফল গোলাম আযম। তিনি কিছু না বলেও বলে গেছেন অনেক কিছু। তার এ চুপ থাকার মধ্যে যত কথা নিহিত আছে তা তার বিপক্ষে এযাবৎ কাল ধরে বলে আসা কথার সমষ্টির চেয়ে অনেক বেশিই হবে।
এদেশে মানুষ থাকতে চায় না। আপনি বিদেশ থেকে পড়ে দেশে আসলেই বুঝতে পারবেন লোকে কপাল কুঁচকচ্ছে। কেন এদেশে মরতে এলেন। নিরান্নব্বইভাগ দেশ প্রেমী আমেরিকার গ্রীনকার্ড পেলে লাফ দিতে দিতে দেশ ছাড়বে। কিন্তু গোলাম আযম বিদেশে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশে এসে লড়াই করে নাগরিকত্ব নিয়েছেন। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক। তার দল সহ অনেকেই এই অবদানের স্বীকৃতি দাবী করলেও তিনি কখনও তা করেন নি। বরং তিনি এতে নিষেধই করতেন, বলতেন মানুষ ভাষা সৈনিক বলে ডাকবে সে জন্য তিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন নি। এটা তার অমায়িকতা, এর মধ্যে বিপক্ষের কাছে তার নত না হওয়ার বিষয়টাও জড়িত। বিপক্ষের স্বীকৃতির বালাই তিনি করতেন না। এরকম লোক যখন বলেন “আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট” তখন আর কোনও প্রশ্ন থাকে না।
শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি শুধু নিজে নন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান ভাঙ্গার বিপক্ষে অবস্থানকারী তার দলকেও দাঁড় করিয়েছেন। সে দল এখন এদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি। চরম পর্যায়ের নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও যে দল এখনও স্ব মহিমায় টিকে আছে। অথচ তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শক্তিশালী দল বিএনপির উপর অনেক কম নির্যাতনের পরেও কোমর সোজা করে দাঁড়াতেই পারছে না তারা।
অনেকেই মনে করেন স্বাধীনতার সময়ে দেশের বিপক্ষে যাওয়া তার ভুল ছিল। কিন্তু তিনি যে বিশ্বজনীন আদর্শে বিশ্বাস করতেন সে বিশ্বজনীন ইসলামি আদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা কিছুতেই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না। অবশ্য বাংলাদেশের একাত্তর পরবর্তী ঘটনা পরিক্রমার বিচারে এটাকে অনেকেই ভুল সিধ্যান্ত বলার প্রয়াস পেতেই পারেন। তবে যে আশংকার কথা ব্যক্ত করে তিনি এ সিধ্যান্ত নিয়েছিলেন তা আজ চল্লিশ বছর পরে এসে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে জাতি। ভারতীয় আগ্রাসনের ছোবলে ডুবন্ত এদেশের অর্থনীতি ও সমাজের চিত্র তার সব চেয়ে বড় প্রমাণ। একজন ব্যক্তি গোলাম আযম ও নেতা গোলাম আযম এক্ষেত্রে নিজ আদর্শিক নীতিতে অটল থেকে সফল হয়েছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। সুখ্যাত গোলাম আযম বনাম কুখ্যাত গোলাম আযমের তুলনা যখন আসে তখন একটা বাক্যই যথেষ্ট, সেটা হল “কুখ্যাত গোলাম আযমের সুখ্যাতিও আকাশচুম্বী”। বিশ্ব ব্যাপী তার নামাজে জানাজা কি তারই প্রমাণ বহন করে না?
এবার ব্যর্থ গোলাম আযমের কথা বলব
সুদীর্ঘ জীবনের অন্তত ষাট বছর এই লোকটি তার বিপক্ষ শিবিরের লোকদের গালি শুনেছেন অনবরত ভাবে। কোনও দিন একটি গালিও ফিরিয়ে দেন নি। শুধু তাই নয়, এদেশের অনেক মোল্লা-হুজুরও তার বিপক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি তার জীবনে কাউকেই হেনস্তা করে কোনও মন্তব্য করেন নি। অথচ তিনি তার দলের জনশক্তির মধ্যে এই গুনগুলির বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। জামায়াত ও শিবির সমর্থকরা অন্তত তার মৃত্যুর রেশ থাকা এ কয়দিনে যে পরিমাণ গালাগালি, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও ওজনহীন মন্তব্য করেছেন অনলাইন জুড়ে তা দেখে আমি নিশ্চিত বলতে পারি যে এখানে গোলাম আযম ব্যর্থ। মাওলানা আব্দুর রহীম (র) ও মাওলানা আব্দুস সুবাহান সাহেবের জামায়াত ত্যাগের পর তিনি তাদের সাথে যে আচরণ করেছিলেন সে আচরণ এখনকার জামায়াত নেতারা জামায়াত ত্যাগী জনশক্তির সাথে করেন না। কেউই করেন না। এখানেই ব্যর্থ গোলাম আযম। যে আন্দোলনের স্বপ্নে তিনি বহু লাঞ্ছনা সয়েও দেশ ছাড়েন নাই সেই একই আন্দোলনের স্বপ্নচারীরা বিদেশের সিটিজেনশীপের জন্য মুখিয়ে থাকে। এখানেই ব্যর্থ গোলাম আযম। যে কলম দিয়ে তিনি অত্যন্ত সহজ ভাষায় মান সম্মত ইসলামি সাহিত্য রচনা করে অসংখ্য মানুষের জন্য হিদায়াতের উপকরণ তৈরি করে গেছেন সেই কলম দিয়েই তার অনুসারীরাই মানুষের হৃদয় ভাঙ্গার উৎসবে মত্ত। নিরহংকারের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যাওয়া এই মানুষটির জনশক্তিই এখন অহংকার নিয়ে দম্ভোক্তি করে বেড়ান। অনাড়ম্বর জীবনের উদাহরণ এই মানুষটির অধীনস্থরাই এখন আলিশান জীবনের পেছনে ছুটে হয়রান। এটিই একজন ব্যর্থ সৈনিক গোলাম আযমের নাম।
বিষয়: বিবিধ
১৫২৭ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য যারা করছে তারা কি জামায়াত-শিবিরের নেতা বা র্কমি? ওজনহীন মন্তব্য যারা করেছেন অনলাইন জুড়ে তারা হয়ত আমার মতই সমর্থক কিন্তু তাদের দায় গোলাম আযমের উপর যাবে কেন?
যে অর্থে আপনি শেষ পারায় গোলাম আযমকে ব্যর্থ দেখলেন সেই অর্থে কোরআন-হাদীসকেও ব্যর্থ দেখতে রাজি হবেন? জানি রাজি হবেন না কারন কোরআন-হাদীসের ভাল ভাল কথাগুলো আমরা পড়ি,জানি,সম্মান করি কিন্তু নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে অবহেলা করি। সেটা আমাদের দোষ কোরআন-হাদীসের না।
গোলাম আযম দোষে-গুনে মানুষ,তার গুন এত বড় যে শত্রুরাও তা দেখে,আর দোষগুলি অনুবিক্ষন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাইনা । আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই সৎ লোকটাকে ভাল বাসি।
জাযাকাল্লাহ খায়ের
@ জেদ্দাবাসীঃ যথার্থ বলেছেন, সহমত
অনেক ধন্যবাদ, জাযাকুমুল্লাহ
স্বপন১ ভাই, আলবদর পড়েছি, রিসার্স পর্বের লিংক তাকলে দিতে পারেন পড়ে দেখব ইনশাআল্লাহ । ইসলামী শক্তিগুলিকে এক করার জন্য কিছু লিখলে ভাল লাগতো। ধন্যবাদ।
বাংলাদেশে কতটি রাজনৈতিক দল আদর্শের উপর ভিত্তি করে এতদিন ধরে টিকে থাকতে পেরেছে?
উনি সফল বা বিফল এটারই বা ধার ধারার কি দরকার
যাদের উদ্দেশ্য সুন্দর তারা তাদের পথ খুজে পাবেই। নিজের ব্যার্থতাকে অন্যের ওপর চাপিয়ে কি মজা পায় বুঝিনা
মন্তব্য করতে লগইন করুন