মানুষের প্রকৃত এবাদত কী?
লিখেছেন লিখেছেন জিনিয়াস ১৩ জুন, ২০১৪, ০৮:১৭:৫৪ রাত
মহান স্রষ্টা এই মহাবিশ্বকে যেমন সৃষ্টি কোরেছেন তেমনি তিনি এই মহাবিশ্বে থাকা অন্যান্য সব বস্তু ও জীবসমূহকেও সৃষ্টি কোরেছেন। একমাত্র তাঁর ইচ্ছা ও দয়ার মধ্য দিয়েই সবাই বেঁচে আছে। তিনি কোন কিছুর জন্য তাঁর এই সৃষ্টির কাছে মুখাপেক্ষী নন। সারা পৃথিবীবাসীও যদি তাঁকে অস্বীকার করে, তাঁর কোন গুণ-গান, এবাদত-উপাসনা না করে তাহলে তাঁর কোন যায় আসে না। তিনি শুধু চান তাঁর এই প্রিয় সৃষ্টি যেন পৃথিবীর বুকে ফাসাদ (অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, জুলুম, নির্যাতন) ও সাফাকুদ্দিমা (মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত, যুদ্ধ) ত্যাগ কোরে শান্তিতে (এসলামে) বসবাস করে। এ ছাড়া বান্দার কাছে তাঁর কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। তিনি কোন কিছুর অভাব বোধ করেন না। তাঁর রোগ-শোক, জ্বরা-ব্যধি নেই। কোন কিছু তাকে ক্লান্ত করে না। তিনিই সবার অভাব পূরণ করতে সক্ষম। তাঁরই কাছে গচ্ছিত আছে পৃথিবীর সকল ধন-সম্পদের ভাণ্ডার। তিনি বিরাজ করেন তাঁর সকল সৃষ্টির ভেতরেই। বান্দার খুশিতে তিনি খুশি হোন, কেউ তাঁর বান্দার উপর জুলুম কোরলে কিংবা কষ্ট দিলে তাঁর আরশ কেঁপে উঠে, জালিমের উপর তিনি ক্রোধান্বিত হোন। তাঁর কাছে সাদা-কালো, উঁচু-নিচুর কোন ব্যবধান নেই। কিন্তু জাত-পাত, সাদা-কালো ও অন্যান্য ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছে মানুষ নিজেরই হাতে। তারা মনে করে আল্লাহ বুঝি শুধু তাদেরকেই ভালবাসেন। তাই তারা স্রষ্টাকে বন্দী করে রাখতে চায় নিজেদের এবাদতখানায়, মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায় কিংবা প্যাগোডায়। কিন্তু আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, স্রষ্টা উপাসনালয়ের চার দেওয়ালে আবদ্ধ থাকতে পারেন না। তিনি থাকেন সমস্ত সৃষ্টির অস্তিত্ব জুড়ে। তিনি থাকে উড়ন্ত পাখির সাথে, মেঘের মাঝে, ফুলের পাপড়িতে, মৌমাছির গুঞ্জনে। তিনি থাকেন মানুষের মধ্যে, আর্ত-পীড়িতের মাঝে, নির্যাতিতের মাঝে।
কিন্তু সকল ধর্মের কায়েমী স্বার্থবাদী মোল্লা ও পুরোহিত, রাব্বাই ও সাদ্দুসাইরাই ধর্মকে উপাসনা, পূজা প্রার্থনার বস্তুতে পরিণত কোরে স্রষ্টাকে চার দেওয়ালে আবদ্ধ করে তাঁকে মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। মানুষকে স্রষ্টা সম্বন্ধে অমূলক ভয় দেখিয়ে তাঁর সামনে সাজদায় অবনত করে, মোমবাতি জ্বালিয়ে, দুধ মাখন উপঢৌকন দিয়ে খুশি করার প্রচেষ্টাকে ধর্মীয় কর্ম অর্থাৎ এবাদত হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ কাজে যে তারা পুরোপুরি সফল সে সম্বন্ধে আজ আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সত্যিই কি এসব সেই সকল এবাদত যা স্রষ্টা তাঁর বান্দার নিকট আশা করেন?
না, মোটেও তা নয়। আল্লাহর ক্ষুধার্ত বান্দাদেরকে অভুক্ত রেখে, ধনী হয়ে দারিদ্রকে শোষণ করে, সবল হয়ে দুর্বলের উপর অত্যাচার চালিয়ে, সমাজকে অত্যাচারীর হাতে তুলে দিয়ে, সাদা-কালো, উঁচু বর্ণ-নিচু বর্ণ ইত্যাদির পার্থক্য করে পাঁচবেলা মসজিদে গিয়ে স্রষ্টার সামনে মাথা নত করে সাজদা করা- পৃথিবীতে সুদভিত্তিক অর্থনীতি চালু রাখার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করে, এক শতাংশ লোক বাকি নিরানব্বই শতাংশ লোকের সম্পদ কুক্ষিগত করে খ্রিস্টের সামনে মোম বাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করা- অন্যের জন্মভূমিকে অস্ত্রের জোরে দখল করে বসতি গড়ে তুলে আবার তাদেরকেই উচ্ছেদ করে, কুটিল চক্রান্তের মাধ্যমে পৃথিবীর অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে এসে পৃথিবীবাসীকে জিম্মি করে সিনাগগে গিয়ে এলীর প্রার্থনা করা- এসবের কোনটাই স্রষ্টার প্রকৃত এবাদত নয়। বরং স্রষ্টার এবাদত হচ্ছে মানবজাতির সমস্ত অঙ্গন থেকে অন্যায়, অবিচার, অশান্তি ও মারা-মারি, কাটা-কাটি, রক্তপাত যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজ করা।
এ ব্যাপারে আল কোর’আনে আল্লাহ বোলেন, “পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোন পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য আছে কেউ স্রষ্টার উপর, মহাপ্রলয়ের উপর, মালায়েকদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসুলগণের উপর ঈমান আনায়, আর স্রষ্টাকে ভালোবেসে স¤পদ ব্যয় করবে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও দাসমুক্তিতে (সুরা বাকারা ১৭৭)।” এ ব্যাপারে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” একইভাবে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোর মাধ্যমেও স্রষ্টা তাঁর বান্দান্দেরকে মানব সেবার মাধ্যমে তাঁকে খুশি করার আহ্বান জানিয়েছেন। একমাত্র মানব কল্যাণের মাধ্যমেই তাঁর সান্নিধ্য পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, পৃথিবীকে অশান্তির জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড পরিণত করে, দুঃখী মানুষের মুখের অন্ন কেড়ে নিয়ে, সমাজে চার বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষিত হতে দিয়ে উপাসনলায়ের চার দেয়ালে স্রষ্টাকে খুঁজে লাভ নেই। যে সকল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা মানব কল্যাণে উদ্বুদ্ধ হতে সহযোগিতা করে না, মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গীকৃত হতে শেখায় না সে সকল আনুষ্ঠানিকতা, এবাদতকে আল্লাহ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবেন। এ ব্যাপারে একটি হাদিসে কুদসীর মর্মার্থ এই রকম যে, আল্লাহ হাশরের ময়দানে কোন এক বান্দাকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, “আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম- তোমরা আমাকে খাবার দাওনি, আমি পিপাসার্ত ছিলাম- তোমরা আমাকে পানি পান করাওনি, আমি বস্ত্রহীন ছিলাম- তোমরা আমাকে বস্ত্র দাওনি, আমি অসুস্থ ছিলাম- তোমরা আমাকে সেবা করনি।” এ কথা শুনে বান্দা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করবে, “হে প্রভূ! তুমি অভাবমুক্ত। কেমন করে তুমি ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত এবং পীড়িত হতে পার? উত্তরে আল্লাহ বলবেন, “আমার অমুক বান্দা ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হয়ে তোমার দুয়ারে উপস্থিত হয়েছিল, তুমি তাকে খাদ্য ও পানীয় দাওনি। যদি দিতে সেখানে তুমি আমাকে পেতে। তোমার জানা উচিত ছিল, আমার বান্দার সেবা করলে আমারই সেবা করা হয় এবং আমি তাতেই সন্তুষ্ট হই (মুসলিম, ইমাম, আস-সহীহ, অধ্যায়: আল-বিররু ওয়াস-সিলাহ ওয়াল আদাব, অনুচ্ছেদ: ফাযলি ইয়াদাত আল-মারিদ)।” সুতরাং মানবজাতির শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করাই স্রষ্টার প্রকৃত এবাদত, এটা না করা হলে বাকি সবকিছুই আল্লাহ খড়-কুটোর ন্যায় ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।
বিষয়: বিবিধ
১৪২৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন