কালো টাকা সাদাকরণ সুযোগ রহিত, কিন্তু মানসিকতা?
লিখেছেন লিখেছেন জিনিয়াস ০৮ জুন, ২০১৪, ০১:১১:৪০ রাত
কর প্রদানের সময় যে সব সম্পদ আড়াল করে রাখা হয় বা যে টাকার কর দেওয়া হয় না সে সকল টাকাই কালো টাকা বলে বিবেচিত হয়। প্রচলিত আইন অনুযায়ী এসব অর্থ অবৈধ অর্থ। কিন্তু আমরা বরাবরই দেখতে পাচ্ছি যে, নিকট অতীতে প্রায় প্রতিটি বাজেটেই এ অর্থকে সাদা করার কিছু কিছু সুযোগ রাখা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের এই মানসিকতা প্রতিবারই সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে রাষ্ট্রের দক্ষতার উপরও। রাষ্ট্রের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সম্পদ অপ্রদর্শিত রাখতে পারা রাষ্ট্রের দুর্বলতারই প্রমাণ। অন্যদিকে সম্পদের মালিকগণ রাষ্ট্রকে ঠকিয়ে কেন সম্পদ আড়াল করেন এর পেছনে যে অন্তর্নিহিত জটিলতা রয়েছে তা দূর করতেও রাষ্ট্র ব্যর্থ। কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ বলতেই বোঝায় কালো টাকার মালিকদের কাছে সরকারের নতি স্বীকার। বার বার এই বিষয়টিকে বৈধতা দেওয়া হলেও এবারের মূল বাজেট ঘোষণার পর দিন অর্থাৎ বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এই সুযোগকে নাকচ করে দিয়েছেন। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘কালো টাকা থেকে গত বছর ৩৪ কোটি টাকা আয় হয়েছে। এই হিসাব দেখলে মনে হয় দেশে কালো টাকাই নেই। ভুল করে বাজেট বক্তৃতায় এটি ছিল না। এখন বলছি এটি বাতিল। গত বছর শর্তসাপেক্ষে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে তেমন সাড়া না পাওয়ায় এ বছর সে সুযোগ রাখা হয়নি।’ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, বরং কাক্সিক্ষত সাড়া না পাওয়ায়ই এই সুযোগকে বাতিল করা হয়েছে। বিষয়টি অনেকটা শেয়ালের দ্রাক্ষা ফলের নাগাল না পেয়ে ব্যর্থ প্রবোধ ‘দ্রাক্ষা ফল অতি টক’ এর মত নয় কি?
সুতরাং বাজেটে কালো টাকাকে সাদা করার প্রসঙ্গে যারা নীতি-নৈতিকতা নিয়ে সমালোচনা করেন, এবারের বাজেটে সে সুযোগ না থাকায় তারা খুশি হবেন কি? না, খুশি হওয়ার কিছু নেই। বরং দুঃখিত হওয়ার বিষয় এই যে, এই প্রক্রিয়াটা নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে একটি প্রহসনও বটে। ব্যাপারটা এই রকম যে, কোন লোক সুযোগ পায়নি বলে চুরি করলো না এবং এই না পারার কারণে সে সমাজের ভাল মানুষের কাতারে স্থান পেয়ে গেল, ভাল মানুষের সাথে বুক ফুলিয়ে মেলা-মেশা ও সমমর্যাদার অধিকারী হয়ে গেল। এ যেন গুড়ের দাম আর সন্দেশের দাম এক করে ফেলা। এটা সমাজের ভাল মানুষের জন্য খুবই উদ্বেগজনক ব্যাপার। কারণ, এর মাধ্যমে আমাদেরকে নীতি শিক্ষার গল্প মনে করিয়ে দেওয়া হয়। গল্পটি সংক্ষেপে এই রকম যে, কোন এক সিদ্ধ পুরুষ তার শিষ্যদেরকে নিয়ে কোন একটা এলাকায় আস্তানা গাঁড়লেন। গুছিয়ে বসেই গুরু শিষ্যদেরকে পাঠালেন নিকটস্থ বাজারে। বাজার থেকে ঘুরে এসে কয়েক শিষ্য বললো, ‘গুরু! চলেন আমরা এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাই।’ ‘কেন?’ গুরুর এই প্রশ্নে তারা জানালো, ‘গুরু! এখানে গুড় আর সন্দেশ, তেল আর ঘি, মাছ আর গোস্ত, দুধ আর মাখন সব কিছুর একই দাম। আমরা যদি এখানে থেকে যাই তাহলে থেকে গুড়ের দামে সন্দেশ, তেলের দামে ঘি, মাছের দামে গোস্ত এবং দুধের দামে মাখন খেয়ে স্বাস্থ্য ফিরে পেতে পারি।’ গুরু এই কথা শুনে সাথে আদেশ করলেন, ‘এখনি গাটরি গোছাও, আর এক মুহূর্তও এখানে নয়।’ শিষ্যরা ‘কারণ কি’ জানতে চাইলে গুরু জানালেন, ‘যে দেশে গুড় আর সন্দেশ, তেল আর ঘি, মাছ আর গোস্ত, দুধ আর মাখন একই দাম, সে দেশে ভাল আর মন্দ, জ্ঞানী ও মূর্খের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এখান থেকে তাড়াতাড়ি চলো।’ সব শিষ্যই গুরুর কথা মেনে নিয়ে তার সাথে পাততাড়ি গুটিয়ে রওয়ানা দিলো। কিন্তু একজন শিষ্য বললো, ‘না, গুরু! আমি একটু দেখে যেতে চাই। আর কম দামে খাবার খেয়ে স্বাস্থ্য ফেরাতে চাই।’ তখন গুরু বললেন, ‘ঠিক আছে, সে তোর ইচ্ছে। কিন্তু তুই এই ভুলের জন্য মারা যাবি।’
গুরু চলে যাওয়ার পর শিষ্য কম দামে ঐ সব পুষ্টিকর খাবার খেয়ে স্বাস্থ্যবান হয়ে গেলো। ইতোমধ্যে ঐ এলাকায় ঘটে গেলো একটি ভয়ানক ঘটনা। এক চোর রাতের বেলা চুরি করতে গিয়ে দেয়াল ধসে মারা গেল। চোরের বউ ঐ বাড়ির মালিকের নামে সালিশ আহ্বান করলো এই অভিযোগে যে, বাড়িওয়ালা দেয়াল তৈরির সময় মাটিতে বেশি পানি মিশিয়েছে। তাই দেয়াল দুর্বল হয়েছে এবং তার স্বামী চুরি করতে গিয়ে সেই দেওয়াল ধসে মারা গেছে। সুতরাং মালিককে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে! মালিককে জিজ্ঞাসা করতেই জানালো যে, ‘কাজতো আমি করিনি, করেছে মিস্ত্রি।’ মিস্ত্রিকে ডেকে আনা হলে হলে মিস্ত্রি বললো, ‘আমার কি দোষ? আমি যখন মাটি মণ্ড করছিলাম তখন পাশ দিয়ে এক সুন্দরী যুবতী যাচ্ছিলো। সে ছিলো মনোহর সাজে সজ্জিত। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকায় মাটির মণ্ডতে বেশি পানি দিয়ে ফেলেছি।’ তখন ডেকে আনা হলো ঐ সুন্দরী নারীকে। সুন্দরী নারীকে দোষী সাব্যস্ত করায় ঐ সুন্দরী নারী জানালো তার সৌন্দর্যের জন্য সে দায়ী নয়। যে বিক্রেতা তার কাছে সৌন্দর্য্য সামগ্রী বিক্রি করেছে প্রকৃতপক্ষে সে-ই দায়ী। সে যদি ঐ সৌন্দর্য্য সামগ্রী বিক্রি না করতো তাহলে সে কিছুতেই এত সুন্দরী হতে পারতো না। সুতরাং দোষ ঐ বিক্রেতার।
কিন্তু যখন ঐ বিক্রেতাকে ধরে নিয়ে আসা হলো তখন দেখা গেলো ঐ লোকটি খুবই কৃশকায়। তার গলা এতই চিকন যে ফাঁসির দড়ি তার গলায় পরিয়ে দিলে তা গলে বের হয়ে যাবে। তাছাড়া এত রোগা এবং কৃশকায় লোকটিকে ফাঁসিতে ঝুলানোটাও অমানবিক ঠেকছিলো বিচারকের কাছে। তাই তিনি হুকুম দিলেন ঐ এলাকা থেকে কোন মোটা-সোটা লোক ধরে আনতে, যার গলা দিয়ে রশি গলে বেরিয়ে না যাবে। অনেক খুঁজে পেয়াদারা সন্ধান পেলো গুরুর ঐ শিষ্যকে যে কম দামে সন্দেশ, ঘি, মাখন ও গোস্ত খেয়ে অনেক মোটা-তাজা হয়েছে। এবার তাকে ধরে এনে তার গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো হলো। এ সময় গুরুর কথা মনে পড়ে গেল সে শিষ্যের। একই সাথে সে আফসোসে ভুগতে লাগলো। সে ভাবলো, ‘আহ! যদি গুরুর কথা শুনে তখন তার সাথে চলে যেতাম তাহলে আজ এই পৈত্রিক প্রাণটুকু বেঘোরে হারাতে হতো না।’ কিন্তু তখন আফসোস করে আর লাভ নেই। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ তা মানতেই হবে, শাস্তি ভোগ না করে উপায় নেই।আজকে আমাদের দেশে করদাতা এবং কালো টাকার মালিক সমান মর্যাদা পাচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে কালো টাকার মালিকরাই প্রবল। কালো টাকার বিনিময়ে তারা প্রভাব-প্রতিপত্তি কিনে নিচ্ছে। রাষ্ট্রও তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করে চলে। আলোচ্য অবিচারের দেশের মত আমাদের রাষ্ট্র যদি সে অবিচারের দিকে পা বাড়াতে না চায় তাহলে উচিত সেই সব কালো টাকার মালিকদেরকে ছেড়ে না দিয়ে তাদেরকে চিহ্নিত করে যথাযথ বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। নয়তো আমরা হয়তো কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ রহিত করতে পেরেছি, কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নে উর্ধ্বে উঠতে পারি নি। আমাদের অবস্থান অবিচারের দেশ থেকে দূরে নয়।
বিষয়: বিবিধ
১১৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন