এই ‘বাহাস’ থেকে জাতি কি পাবে?

লিখেছেন লিখেছেন জিনিয়াস ০১ জুন, ২০১৪, ১০:৪৩:০৭ রাত

ইদানীং পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তা নিয়ে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকগণ প্রচণ্ড উদ্বেগাকুল হয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি যারা দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেন তারাও হতাশা ছাড়া দু’চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কেননা এই সংস্কৃতি আমাদেরকে আগামীতে একটি মেধাহীন, অধ্যবসায়হীন প্রজন্ম উপহার দিতে চলেছে। আর মেধাহীন, অধ্যবসায়হীন একটি জাতির পরিণতি কি তার লক্ষণ ইতোমধ্যেই আমরা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। প্রশ্নপত্র ফাঁসের পেছনে কারা জড়িত, কিংবা এর পেছনে রাজনীতি আছে কিনা তা আমার প্রামাণ্য বিষয় নয়। শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর জাফর ইকবাল এ বিষয়ে তার তিন তিনটি নিবন্ধের একটিতে এ ব্যাপারে দায়ী করেছেন রাষ্ট্রের পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকেই। তার ভাষায়, “এই ছাত্র-ছাত্রীরা প্রশ্ন ফাঁস করেনি। কোনো রিকশাওয়ালা প্রশ্ন ফাঁস করেনি। গার্মেন্টসের কোনো মেয়ে প্রশ্ন ফাঁস করেনি। কোনো শ্রমিক, কোনো চাষি, কোনো দিনমজুর প্রশ্ন ফাঁস করেনি। প্রশ্ন ফাঁস করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষাব্যবস্থার খুব উপরের দিকের মানুষ। যারা প্রশ্ন প্রণয়ন করেন, যারা প্রশ্ন ছাপান, যারা সেগুলো বিতরণ করেন, তারা।”



কিন্তু দোষ যারই হোক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে এ দায় বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী কিছুতেই এড়াতে পারেন না। বিশেষ করে যখন তিনি ধারাবাহিকভাবে দুই দুই বার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। পরীক্ষায় নকল প্রতিরোধে সৃজনশীল পাঠ্যব্যবস্থা চালু করায় তার অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু এখন নকল বন্ধ হয়েছে বটে, তবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে পরীক্ষার আগেই। এই অবস্থাটা আগের চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর। অনেকে এটাকে বর্তমানে চলমান গুম-খুনের সংস্কৃতির চেয়েও মারাত্মক বলে অভিহিত করছেন। এ ব্যাপারে দায়টা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেওয়ার কারণ হচ্ছে- বাজারে সয়লাব বা ফেসবুকের পেজের এ্যাডমিনদের হাতে পৌঁছাচ্ছে সেই অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমেই। সুতরাং একটি মন্ত্রণালয়, একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তার অধীনে কেমন লোক নিয়ে কাজ করছেন তার দায়-দায়িত্ব কি তার ঘাড়ে পতিত হয় না?

ঠিক এই কথাটিই যখন শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবাল সংবাদপত্রে তিন তিনটি নিবন্ধ প্রকাশ করে বলার চেষ্টা করেছেন। ঘটনার জন্য তিনি স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীকে দায়ী করার চেষ্টা করেছেন এবং মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণেরও অনুরোধ করেছেন। আবার তার পাল্টা জবাবও দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। তার দেওয়া জবাব পড়ে যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী তার নিজের ঘাড়ে ঘটনার দায় নিতে চাচ্ছেন না। এমনকি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাকে তিনি প্রকারান্তরে অস্বীকার করতেও চেয়েছেন। কিন্তু দোষ নিজের ঘাড়ে না নেওয়ার এই মানসিকতাকে সাধারণ মানুষ মোটেও ভালভাবে গ্রহণ করেনি। তার এই বক্তব্য বিডিনিউজ২৪.কম নামে একটি অনলাইন সংবাদপত্রের বরাতে প্রথমে আমি দেখতে পাই। সাধারণ মানুষ যে বিষয়টিকে ভালভাবে নেয়নি তা প্রমাণ হয়ে গেছে লেখাটির নিচে সাধারণ পাঠকের মন্তব্য থেকে। অনেকে সভ্যতা-ভব্যতার সীমা অতিক্রম করে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে অনেক কথাই বলেছেন। অধিকাংশের মতামত হচ্ছে যেখানে পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকগণ প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন সেখানে শিক্ষামন্ত্রীর গৎবাধা বক্তব্য, “পরীক্ষার শুরুর দিনের আগের দিনই প্রচার হয় প্রথম দিনের প্রশ্নপত্র (বাংলা ১ম পত্র) ফাঁস হয়েছে। আমি সাংবাদিকদের নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে ফাঁস হয়েছে এমন প্রশ্ন তাদের মেলাতে বলেছি। তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম পত্র সম্পর্কেও গুজব থাকলেও কোনোটাই প্রমাণ করা যায়নি” বলে অস্বীকার করার চেষ্টা কোনভাবেই গৃহিত হয়নি। তাছাড়া তার বক্তব্যে অতীতকে দোষারোপ করার সেই পুরনো রাজনৈতিক মানসিকতাও ফুটে উঠেছে।

যাই হোক, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এবং অধ্যাপক জাফর ইকবালের প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, তাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী জাফর ইকবাল সাহেবকে শিক্ষা পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায়, “অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল আমাদের শিক্ষা পরিবারের একজন তারকা সদস্য, অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মৌলিক কাজের সাথে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও খুবই সৌভাগ্যবান যে, তিনি আমার একজন আন্তরিক শুভানুধ্যায়ী। তার পরামর্শ ও সক্রিয় ভূমিকা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

কিন্তু জাফর ইকবাল সাহেবের প্রবন্ধ পড়ে মনে হয়েছে দু’জনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব বিরাজমান। তারা নিজেদের মধ্যে সাক্ষাৎ কিংবা ফোনে কথা বলার অবস্থায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে পত্রিকায় কলাম লেখা। স্বীকার করতে হয়, এই সুযোগে আমরা হতাশ আম-জনতা উপভোগ্য একটি বাহাস অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি। আর এই উপভোগের সবচেয়ে চার্মিং দৃশ্যটির অবতারণা হয়েছে গত শুক্রবারের সকাল এবং বিকেলে। এদিন সকালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদে জাতীয় শহীদ মিনারের বেদীতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল সাহেব। তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে কিছু পরিচিত মুখও হাজির হয়েছিলেন। বৃষ্টির মত প্রতিকূল পরিবেশেও সবাই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত প্লেকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে অনেকে হাজির হয়েছিলেন। এ অবস্থান গ্রহণ কার বিরুদ্ধে ছিলো? অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। কারণ জাফর ইকবাল সাহেব এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করা লেখাটিতেই শহীদ মিনারে অবস্থান গ্রহণের অগ্রীম ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই একই দিন বিকালে তিনি শাহবাগের বিসিএস ভবনে ‘চন্দ্রাবতী একাডেমি’ আয়োজিত শিশু সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি উপস্থিত শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এর পাশে বসে কথা বলেছেন। এমনকি তার হাত থেকে পুরষ্কার হিসেবে ক্রেস্টও গ্রহণ করেছেন। অনুষ্ঠানে শিশু সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ৩ জন শিশু সাহিত্যিককে সম্মাননা ক্রেস্ট ও ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হয়। অনুষ্ঠানের মঞ্চে শিক্ষামন্ত্রীর পাশে বসা ছিলেন জাফর ইকবাল এবং সারাক্ষণই তাদের কাছাকাছি মুখ নিয়ে একান্তে কথা বলতে দেখা গেছে।

আমরা শিক্ষামন্ত্রীর লেখা থেকে আগেই জেনেছি মন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সাথে অধ্যাপক জাফর সাহেব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত আছেন। তিনি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ণে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য তারই নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরি তৈরি করে স্কুলে স্কুলে প্রচারণা চালানো হয়েছে। শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি, পাঠ্যপুস্তক রচনা, সম্পাদনা প্রভৃতি বিভিন্ন কাজে তার অবদান মন্ত্রণালয়টির সাফল্যের পেছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তার লেখা বই-পুস্তক আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। শিক্ষামন্ত্রী লিখেছেন, ‘বিভিন্ন সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হলে তিনি সানন্দে তা সম্পাদন করেন। তাই তাকে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এবং শিক্ষায় সার্বিক সাফল্যের সাথে আলাদা করে দেখা যায় না।’

এখানে খেয়াল করার বিষয় এই যে, একজন মানুষ যখন শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রধান অর্থাৎ স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীর সাথে এতটাই সম্পর্কিত এবং এতটাই ঘনিষ্ঠ, তখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই উদ্বেগজনক বিষয়টি নিয়ে তিনি মন্ত্রীর সাথে সাথে সরাসরিই কথা বলতে পারতেন; এটা তিনি করতে পারতেন তার নিজস্ব অধিকার থেকেই। কিন্তু তিনি তা না করে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পত্রিকায় কলাম লেখার আশ্রয় নিয়েছেন। ভাবটা এমন- যেন তিনি কিছুতেই শিক্ষামন্ত্রীর নাগাল পাচ্ছেন না। কিন্তু আদতে তা যে সত্য নয় শিক্ষামন্ত্রীর লেখা এবং পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে ক্রেস্ট গ্রহণ থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তাহলে পত্রিকান্তরে উভয়ের এই লেখা-লেখির মানে কী? এ থেকে আমরা কি বার্তা পাই?

তাহলে কি শিক্ষামন্ত্রীকে দোষারোপ করা, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করাটা শুধুমাত্র লোক দেখানো? যদি তা না হয় তাহলে তিনি কি পারতেন না শিক্ষামন্ত্রীর হাত থেকে ক্রেস্ট গ্রহণকে বর্জন করতে? তার মানে এই নয় যে, আমি তাকে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে শত্র“তার সম্পর্ক সৃষ্টি করার কথা বলছি। ১৯২১ সালে জালিওয়ালাবাগে নিরীহ ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের হত্যার প্রতিবাদে আমাদের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের দেওয়া নাইটহুড উপাধি বর্জন করার মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছিলেন। মন্ত্রীর হাত থেকে পুরষ্কার গ্রহণকে বর্জন করাটা হতে পারতো তেমনি একটি শক্ত প্রতিবাদ। আশা করি অধ্যাপক জাফর ইকবালের একনিষ্ঠ ভক্তরাও একথাটি অস্বীকার করতে পারবেন না।

সকালে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করে বিকেলে সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর হাত থেকে ক্রেস্ট গ্রহণ করার ঘটনায় সত্যিই স্ববিরোধিতা ফুটে উঠেছে। আমরা সাধারণ মানুষ ধারণা করেছিলাম দেশবরেণ্য একজন শিক্ষকের এই প্রতিবাদে হয়তো মন্ত্রণালয়ের টনক নড়বে, তারা আরো সক্রিয় হবে। কিন্তু বিকেলেই সেই প্রতিবাদী শিক্ষকের আত্মসমর্পণ দৃশ্যে আমাদের সেই আশার বেলুন ফুটো হয়ে চুপসে গেছে। এরপরেও কি আমরা আশ্বাস লাভ করতে পারি যে- ভবিষ্যতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটবে না? মনে হয় না। কারণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও, শিক্ষামন্ত্রীকে দায়ী করা হলেও তাতে মন্ত্রীর কিছুই যায় আসে না। ‘প্রমাণ নেই’, ‘প্রমাণ পাইনি’, ‘কেউ প্রমাণ করতে পারেনি’ ইত্যাদি কৌশলী শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে ইনারা বার বার দায় এড়িয়ে যাবেন, সাধারণ মানুষের তুলে ধরা প্রমাণ আমলে না নিয়ে পার পেয়ে যাবেন। আর আমরা পাবো দুই নম্বরিতে সিদ্ধহস্ত একটি ভবিষ্যত প্রজন্ম, যাদের সূচনাটা হয়েছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষায় পাশ করে। এর ব্যত্যয় ঘটার আপাতত কোন সম্ভাবনা দেখছি না। ‘বাহাস’ অনুষ্ঠান পুরোপুরিই ব্যর্থ। তবে বাহাসটি আমাদেরকে নির্মল বিনোদন যুগিয়েছে- এর জন্য উভয়ের কাছেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চাই।

বিষয়: বিবিধ

১১৯৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File