জন সমর্থনকে উপেক্ষা- আওয়ামী লীগের ভুল নীতি

লিখেছেন লিখেছেন জিনিয়াস ১৪ মে, ২০১৪, ১০:৪৫:৫৮ রাত

যদি প্রশ্ন করা হয় পাঁচই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার কোন শক্তির উপর নির্ভর করে এখনও ক্ষমতায় টিকে আছে- তবে এর দুটি মাত্র উত্তর পাওয়া যাবে। এর একটি হচ্ছে বিগত আমলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসনগুলোতে অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ করে বিরোধী মতের উপর অব্যাহত দমন-পীড়ন চালানো এবং একই সাথে কতগুলো বায়বীয় বিষয় জাতির সামনে তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে বিভক্ত করে রাখা। আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি। অবশ্য বিরোধী দলের শক্তিহীনতার কারণ হিসেবে প্রথমোক্ত কারণটিকেই দায়ী করা যায়। তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়। কেননা, রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী দলটিও মৌলিকভাবে আওয়ামী লীগ থেকে ভিন্ন নয়। রসুনের কোয়ার মত এদের গোড়াও একই স্থানে। এরাও ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের মতই কাজ করে থাকে। অন্তত তাদের অতীত শাসনামল আমাদেরকে সে বার্তাই দিয়েছে। তারা নিজেদের নৈতিক দুর্বলতার কারণে সরকারকে চাপে রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। একই সাথে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের প্রশ্নে তারা ব্যস্ত আছে। নিজস্ব স্বার্থের উপর আঘাত এলেই তারা রাজপথে নেমে আসে। কিন্তু জন স্বার্থে তারা মোটেই কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকারে রাজী নয়।

স্বাধীনতার পর থেকে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বিশেষ করে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন পরবর্তী সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর যে সরকারগুলোই গণভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে তাদের প্রতিটিকেই ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাতে হয়েছে। যার ফলে তারা টানা দ্বিতীয়বার আর কখনোই গণভোটে সমর্থন পায়নি। তাই পুনরায় ক্ষমতার আসার জন্য তাদেরকে কুট-কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। অতীতে ‘৯৬ সালে বিএনপি একবার দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই এক তরফা নির্বাচনের আয়োজন করেছিলো। সে সময় নির্বাচিত সরকারের প্রথম সংসদ অধিবেশন শুরু হয়েছিলো ১৯শে মার্চ ১৯৯৬ এবং অধিবেশন স্থায়ী হতে পেরেছিলো মাত্র চার কার্যদিবস ২৫শে মার্চ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। ৩০শে মার্চ ১৯৯৬ সালে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সংসদ স্থায়ী ছিল মাত্র ১২ দিন " সূত্র: উইকিপিডিয়া । একইভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৫ই জানুয়ারি ২০১৪ সালে। এক্ষেত্রেও পূর্ববর্তী আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় অবস্থান করে নির্বাচনের আয়োজন করে এবং স্বাভাবিকভাবেই প্রধান বিরোধী শক্তিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এ নির্বাচন বর্জন করে। অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয় ক্ষমতাসীন দলটি। প্রথমত এ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকার টিকবে কি না এবং এ নির্বাচন বৈধতা পাবে কি না তা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু আওয়ামী সরকার ‘৯৬ এর বিএনপির মত ধরাশায়ী হয়নি। কারণ, সে সময় বিএনপির যে দুর্বলতাগুলো ছিলো আওয়ামী লীগ এবার সে দুর্বলতাগুলো রাখেনি। প্রশাসনকে অনুগত রাখতে কি করা প্রয়োজন আর বিরোধী দলকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে কলা-কৌশল আওয়ামী লীগের রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের নীতি হচ্ছে নাথিং ইজ আনফেয়ার...।

কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্য মারাত্মক ভুল এই যে তারা একমাত্র সেই কলা-কৌশলের উপর নির্ভর করেই টিকে থাকতে চাচ্ছে। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দল বা একটি সরকারের ভিত্তি বা টিকে থাকাটা নির্ভর করে তার সামরিক শক্তির উপর নয়, তার শক্ত পুলিশ বাহিনীর উপর নয়, অনুগত আমলাদের উপরও নয়- বরং দলটির প্রতি দেশের জনগণের আস্থা ও ভালোবাসার উপর। কিন্তু উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েও আওয়ামী লীগ সেই গণ-আস্থা ও ভালোবাসা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি জানি আমার এ অভিমতের সাথে আওয়ামীপন্থীরা জোরালোভাবে দ্বিমত প্রকাশ করবেন। তারা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান হাজির করবেন। তারা আমাকে প্রমাণ করে দেবেন যে আমার অভিমত মিথ্যা।কিন্তু আমিও দেখিয়ে দিতে পারবো যে, সেইসব কাগুজে পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্য নয়। বাস্তবক্ষেত্রে এসব কাগুজে হিসেবের কোন মূল্য নেই। এক্ষেত্রে আমি শুধু আওয়ামী লীগের আগের আমলের সিটি নির্বাচন এবং এই বারের উপজেলা নির্বাচনের কথা স্মরণ করিয়ে দেব। সব কথা বাদ দিলাম, শুধুমাত্র সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে গাজীপুর সিটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত এ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহর পরাজিত হওয়ার বিষয়টিকেই স্মরণ করতে পারেন। আজমত উল্লাহ যদি আওয়ামী লীগের সমর্থন ব্যতীত শুধুমাত্র নিজের যোগ্যতার উপর নির্ভর করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন, তাহলেও অনায়াসে তার বিজয়ী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় এই ব্যক্তিত্বকে যখন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কাছে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হতে হয় তখন বুঝতে হবে দোষটা তার নয়, বরং দোষটা আওয়ামী লীগেরই। তবে আমি এও জানি এরপরেও কতক অন্ধ আওয়ামী সমর্থক এসব যুক্তিকে অস্বীকার করতে চাইবেন। আর আওয়ামী লীগের হাল আমলে উপজেলা নির্বাচনে সফলতার পরিসংখ্যান তুলে ধরবেন। কিন্তু এটা শুধু আমি নই, প্রায় প্রতিটি সচেতন ব্যক্তিই নির্দ্বিধায় বলবেন যে, উপজেলা নির্বাচনের শেষ কয়টি ধাপ মোটেও সুষ্ঠু ও সহিংসতা মুক্ত ছিল না। শুরুর দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি যতই খারাপের দিকে যাচ্ছিল ততই ভাল ফল পেতে শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ এবং খারাপ ফল পেতে শুরু করছিলো বিএনপি। এমনকি শেষ ধাপগুলো এতটাই বিতর্কিত হয়েছে যে, জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন না করার পক্ষে যে কারণগুলো উল্লেখ করে বিরোধিতা করেছিল এর মাধ্যমে সেগুলোর সত্যায়ন ঘটেছে।

এই যে জনপ্রিয়তা পেতে দলটির ব্যর্থতা- এ সম্বন্ধে আওয়ামী লীগের উপর মহল যে একেবারেই অনবহিত তাও কিন্তু নয়। সিটি নির্বাচনের পরে পরে যখন আওয়ামী লীগের ভরাডুবির চিত্র ফুটে উঠেছে তখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হতাশা ব্যক্ত করে মুখ ফুটে বলেই ফেলেছেন যে, ‘এত উন্নয়ন করে কী হবে? ভোট তো পাই না। আমরা ক্ষমতায় এসে দেশের এত কাজ করি। অথচ জনগণ আমাদের উন্নয়ন দেখে না। আর ভোটই যদি না পাই, তাহলে কার জন্য উন্নয়ন করব?’ তিনি একবার নয়, একাধিকবার এ কথাটি উচ্চারণ করেছেন। আমি উদৃতি দিচ্ছি "কালের কণ্ঠের ২৪ জুলাই ২০১৩ সংখ্যার প্রথম পাতায় প্রকাশিত তিনটি সিটির উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত- প্রধানমন্ত্রী বললেন, অনুমোদন দিলে নির্বাচিতরা বসে বসে খাবে’ " শিরোনামের সংবাদ থেকে।

এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, জনগণের প্রতি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা আস্থাশীল নন। তাই দলটি পরবর্তীতে বিভিন্ন কলা-কৌশল খাটিয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আসার পরিবেশ বিনষ্ট করে এক তরফা নির্বাচনের আশ্রয় নিয়েছেন। দলটির এ কৌশলে যেন প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো উচ্চ-বাচ্য করে সুবিধা অর্জন করতে না পারে সে জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন সম্ভাব্য সব ধরনের প্রশাসনিক শক্তিগুলোকে।কিন্তু ‘রাজনৈতিক দলের ভিত্তি জন সমর্থনের উপর’ এই সূত্রকে উপেক্ষা করার ফল ভোগ করতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন এ দলটিকে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় অভিযুক্ত তিনি র‌্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেফতারে জটিলতা এর একটি উদাহরণ।দিন যত যাবে দলটির সামনে এই সমস্যাটি তত প্রস্ফুটিত হতে থাকবে। জন-সমর্থনহীন একটি সরকারের আরো কয়েকটি সমস্যা আছে যা রাষ্ট্রের ভিত্তিকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করে দেয়, এমকি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ারও উপক্রম হয়। কেননা এখানে শক্তির একটি ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। জন সমর্থিত একটি সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে। কিন্তু যখন জন সমর্থনহীন দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে তখন যাদের উপর নির্ভর করে সরকার টিকে থাকে তারা প্রত্যেকেই নিজেদের ভূমিকার কারণে কৃতিত্ব দাবি করে সুবিধা ভোগ করতে চায়। সরকার তাদের কাছে দায়গ্রস্ত হওয়ায় তাদের এই দাবিকে উপেক্ষা করতে পারে না। সে জন্য সরকার শক্ত হাতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে না। এমতবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মনে করে সরকার আমাদের কারণে টিকে আছে, সুতরাং তারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করাসহ বিভিন্নভাবে ক্ষমতা প্রদর্শন মাধ্যমে অপকর্ম করে বেড়ায়। অপরদিকে আমলারা মনে করে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করছি বলেই সরকার এখনও টিকে আছে, সুতরাং তারাও তাদের পরিধির আওতার মধ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। এভাবে প্রায় প্রতিটি সেক্টর থেকেই অনৈতিক চাওয়া-পাওয়া ও দাবি-দাওয়া, চাহিদাসমূহ বৃদ্ধি পায়। তাতে নিজেদের দুর্বলতার কারণে সরকারও খুব একটা শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না। সকলকে ম্যানেজ করে চলতে হয়। ফলশ্রুতিতে সর্বত্র দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা।

কিন্তু আমাদের অতীত ইতিহাস বলে এভাবে কোন কালেই কোন সরকার চিরদিন টিকে থাকতে পারে না। এক সময় তারা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু ক্ষমতা ত্যাগ করাটাই শেষ কথা নয়। ক্ষমতা ত্যাগ করার আগে রাষ্ট্র যে সকল উপাদানের উপর টিকে থাকে সে উপাদান বিশৃঙ্খল হয়ে ভেঙ্গে পড়ে, যা পুনরায় স্বাভাবিক করে তুলতে নতুন সরকারের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এসকল প্রতিষ্ঠানে সৃষ্ট সিন্ডিকেটের কারণে সু-শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়।

তাই জনপ্রিয়তা লাভের প্রতি মনোযোগী না হয়ে রাষ্ট্রশক্তির উপর নির্ভর করার এই মানসিকতা একদিকে যেমন দল হিসেবে ঐতিহ্যবাহী দলটির জন্য আত্মঘাতী নীতি, তেমনি রাষ্ট্রের জন্যও স্থায়ীভাবে অকল্যাণকর।

বিষয়: বিবিধ

১২৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File