বিএনপির আন্দোলনে ‘পানি’, না বিএনপির ‘আন্দোলনে পানি’!
লিখেছেন লিখেছেন জিনিয়াস ২৩ এপ্রিল, ২০১৪, ০৯:০৩:৩৩ রাত
৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অনেকটাই ইস্যুহীন হয়ে পড়ে। ফলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও উদ্যমহীনতা কাজ করতে থাকে। এ কারণে দলটি কিছু কিছু উপযুক্ত ইস্যু থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু দলকে টিকিয়ে রাখতে হলে কর্মীদেরকের কাজে ব্যস্ত রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। সম্ভবত, বিএনপির প্রথম সারির নেতৃত্ব এই বিষয়গুলোকেই মাথায় রেখে অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে জনমুখী ইস্যুতে সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আর এর ফল হচ্ছে তিস্তা ইস্যুতে লংমার্চের ঘোষণা। এ ইস্যুতে বিএনপির পক্ষে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সাড়া পড়ার সম্ভাবনাটাও ছিল অনেক বেশি। কেননা এই ইস্যুটি বাংলাদেশের একিিট বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, কৃষক সমাজের বড় ধরনের চাওয়া পাওয়ার বিষয়। তাদের পক্ষে অহিংস আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারলে বিএনপি হয়তো তাদের হারানো ইমেজ কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে, যাকে পুঁজি করে পরবর্তীতে তারা আরো তীব্র আন্দোলনের সূচনা ঘটাতে পারে। তাই ব্যাপক প্রস্তুতি, প্রচার-প্রচারণা সৃষ্টি করে দলটি মঙ্গলবার ঢাকা থেকে তিস্তা অভিমুখে তাদের লংমার্চ কর্মসূচির যাত্রা শুরু করে। লংমার্চটি ঐদিন সকালে উত্তরার আজমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করে। লংমার্চের শুরুতে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রায় শতাধিক গাড়ির বহর লংমার্চে অংশ নিয়ে রাজধানী ছাড়ে। যাত্রাপথে কালিয়াকৈর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ কড্ডার মোড়, বগুড়া, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ এবং পলাশবাড়িতে সংক্ষিপ্ত পথসভা করে। রাতে রংপুর পৌঁছে রাত্রিযাপন করেন লংমার্চে অংশ নেয়া নেতাকর্মীরা। সমাবেশ উপলক্ষ্যে তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরো এলাকা ঢাকা ছিল নিরাপত্তার চাদরে।
কিন্তু হঠাৎ করেই লংমার্চের দিনে দেখা গেল তিস্তার শুকনো বালি ডুবিয়ে দিয়ে উজান থেকে নেমে আসলো পানির প্রবাহ। এতে তিস্তা শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ভুক্তভোগী কৃষকদের মাঝে নেমে আসে প্রশান্তি। তাদের চোখ-মুখে জন্ম নেয় আশার বিচ্ছুরণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো; যে ভারত শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করে পানি আটকে রেখে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে আসছিলো, বাংলাদেশের এ প্রান্তের তিস্তা শুকিয়ে মরা নদীর রূপ নিলো, পানি না পেয়ে কৃষকের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এ অন্যায় কাজ নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছিলো, সেই ভারত এতদিন এসব কিছুর প্রতি কর্ণপাত না করে হঠাৎ কেন পানির বাঁধ ছেড়ে দিল? এটা কি ভারতের উদারতা, নাকি হঠাৎ তাদের নীতি-নৈতিকতা জেগে উঠা? বাংলাদেশের ন্যায্য দাবির অনুযায়ী এত দিন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশেকে পানি দেওয়ার ব্যাপারে পশ্চিম বঙ্গের ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর অনড় অবস্থানকে দায়ী করে আসছিল, মমতাও নির্মমতার সাথে বাংলাদেশেকে পানি না দেওয়ার ব্যাপারে বলে আসছিলেন ‘যেখানে নিজেদের প্রয়োজন মিটছে না সেখানে আমরা বাংলাদেশকে পানি দেই কি করে?’।
বিএনপি অবশ্য তিস্তায় পানি ফিরে পাওয়ায় তাদের কৃতিত্বই দাবি করেছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এটা বিএনপির আন্দোলনের প্রাথমিক ফল।’ আবার অবশ্য তিনি এটাকে ভারতে ‘আইওয়াশ’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির সফলতার এ দাবি নিয়ে ভিন্নমতেরও সৃষ্টি হয়েছে। সরকার পক্ষ দাবি করছে এটা তাদের অব্যাহত কূটনৈতিক সফলতা। পানি মন্ত্রী রমেশ সেন অন্তত তাই বলেছেন। কিন্তু এটা সরকারের কূটনৈতিক সফলতা না হওয়ার সম্ভাবনা এই জন্য কম যে, ভারত তার দেশের স্বাভাবিক সময়ে যখন তিস্তা ইস্যুতে কিছু করতে পারেনি তখন নির্বাচনকালীন অস্থিতিশীল পরিবেশে এ ব্যাপারে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তাহলে ভারতের হঠাৎ নমনীয়তার প্রকৃত কারণটি কি?
এর একটি কারণ হতে পারে যে, তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ উচ্চ-বাচ্য সৃষ্টি করলে তা আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার সৃষ্টি করতে পারে এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতের সম্মুখীন হলে ভারতের অন্যায় আচরণের বিপক্ষে রায় আসতে পারে। কিন্তু উদীয়মান আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের দ্বারা এমন ভীত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা, ভারত এখন আন্তর্জাতিক মহলকে সামান্যই কেয়ার করে। দেবযানী ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বেঁধে যাওয়া কূূটনৈতিক লড়াই থেকেই সেটা অনেকটা প্রমাণ হয়ে গেছে। আরো একটা কারণ হতে পারে যে, আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি পড়ার আগেই বাংলাদেশকে চুপ করিয়ে দেওয়া, কেননা কিছুদিন পরেই তো বর্ষা এসে যাচ্ছে! তখন নিজেদের জনগণকে বন্যার পানি থেকে বাঁচাতে এমনিতেই তো বাঁধ খুলে দিতে হবে!
তবে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাটি কিন্তু ভিন্ন। আমরা জানি, বিগত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে নবম জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পাশে থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছে ভারত সরকার। প্রধান বিরোধী শক্তির নির্বাচন বর্জন এবং স্বল্প ভোটার উপস্থিতি কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এ নির্বাচনকে আন্তর্জাতিকভাবে সবার আগে বৈধতা প্রদান করেছে তারা। দেখা গেছে, বরাবরই আওয়ামী লীগের সাথে ভারত সরকারের সু-সম্পর্ক ছিল। বিপরীত দিকে বিএনপির সাথে ভারত সরকারের সম্পর্ক অতটা উঞ্চ নয়। বরং ভারত এবং বিএনপির সাথে একটা প্রকট ঠাণ্ডা যুদ্ধও চলমান। এ অবস্থার জন্ম বহু আগে থেকে হলেও বিগত বছরের চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় হরতালের অজুহাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সাথে সাক্ষাতকে খালেদা জিয়া কর্তৃক উপেক্ষিত হলে সম্পর্কের নাজুকতা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এমতবস্থায় পিছিয়ে পড়া বিএনপি যখন তিস্তা ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, তখন তা যেন ভেস্তে যায় সে জন্য ভারত তিস্তায় পানি ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারে- এমনটাই ধারণা করছেন বিজ্ঞমহল। সুতরাং তিস্তায় পানি পাওয়া নিয়ে এমন প্রশ্নের উদয় হতেই পারে যে, এটা কী বিএনপির আন্দোলনে পানি পাওয়া, নাকি বিএনপির আন্দোলনে ভারতের পানি ঢেলে দেওয়া?
বিষয়: বিবিধ
৯৩৭ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন