গণতন্ত্রের কিম্ভুত দর্শন

লিখেছেন লিখেছেন জিনিয়াস ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৬:৫৯:৫৭ সন্ধ্যা

সমাজতন্ত্র মরি মরি করিয়া গুটিকয়েক দেশে তার অস্তিত্ব টিকাইয়া রাখিলেও তাহার যৌবন এখন প্রায় পড়ন্ত বেলায় আসিয়া ঠেকিয়াছে। অপরদিকে সমাজতন্ত্রকে যে জীবনব্যবস্থাটি ল্যাং মারিয়াছে তাহা গণতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের কোমর ভাঙ্গিয়া পড়ার পর গণতন্ত্রই হইয়া উঠিয়াছিল বর্তমান সভ্যতার একমাত্র কাক্সিক্ষত জীবনব্যবস্থা। কিন্তু তাহার দুরাবস্থা দেখিয়া মর্তবাসীকে আবারও হতাশ হইতে হইলো। গণতন্ত্রের জনক স্বয়ং আব্রাহাম লিঙ্কনও যদি এই অবস্থা দেখিতে পাইতেন তাহা হইলে তিনি নিশ্চিত ভিমরি খাইতেন। যাহা হোক, তিনি পরপারে পাড়ি জমাইয়া বাঁচিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তাহার একনিষ্ঠ কর্মীরা এই গণতন্ত্রকে ধারণ করিয়া নিজেরাই এখন ফ্রাঙ্কেস্টাইনের দানবের রূপ নিয়াছেন। গণতন্ত্রের মৌলিক কথা ছিলো ইহা হইবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিচালিত একটি জীবনব্যবস্থা। দুর্ভাগ্যবশত তিনি খেয়াল করেননাই যে, মানুষ নিজেদের তৈরি আইনে কখনোই পরিচালিত হইতে পারে না। যখন খুশি মানুষ আইন পরিবর্তন করার অধিকার লাভ করিয়া সে শুধু নিজস্ব স্বার্থকেই প্রাধান্য দিবে এবং শেষ পর্যন্ত নিজেরাই চরম স্বৈরাচার হইয়া যাইবে। বাস্তবতাও তাই দাঁড়াইয়াছে। পাশাপাশি জাতীয়তাবাদ যুক্ত হইয়া গণতন্ত্রের গা থেকে সকল নৈতিকতা বিদূরিত হইয়াছে। নিজস্ব স্বার্থ, নিজ দেশের স্বার্থই নৈতিকতার মানদণ্ড হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

তাই দেখিতে পাই পৃথিবীর বড় বড় দেশ যাহারা নিজেদেরকে গণতন্ত্রের বড় ধারক-বাহক দাবী করিয়া থাকে এবং বহির্দেশে গণতন্ত্রের রপ্তানি করিয়া থাকেন তাহারাও সকল নিয়ম-নীতি, জনমত, গণভোট উপেক্ষা করিয়া ভিন্ন দেশের সার্বভৌমত্ব, সীমানা লঙ্ঘন করিয়া অস্ত্র নিয়া হামলা করিয়া থাকে শুধুমাত্র ক্ষমতার জোরে। তাই প্রশ্ন আসে গণতন্ত্র কি আমাদেরকে শান্তি দিয়াছে কিংবা আমাদের স্বস্তি দিতে পারিয়াছে?

এতো গেল বহির্দেশের কথা। এই বাংলায় গণতন্ত্র আসিয়া আরো ব্যাপক কিম্ভুতকিমাকার রূপ লাভ করিয়াছে। ১৯৬৯ সালে যুক্ত পাকিস্তানে নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে বিজয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের জান্তা শাসকগোষ্ঠি এদেশীয়দের হাতে ক্ষমতা না ছাড়িয়া টালবাহানা শুরু করে। এই টালবাহানার সর্বশেষ পরিণতি ১৯৭১ সালের একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। অর্থাৎ গণতন্ত্র ব্যর্থ হইলে বাঙালিকে প্রাচীন নিয়ম যুদ্ধকেই বাছিয়া লইতে হয়। অতএব স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর হাত ধরিয়া আবার আসে বাকশাল। কিন্তু তাহা দীর্ঘস্থায়ী হইতে পারে নাই।

নামিয়া আসে ’৭৫ এর ভয়াবহ পরিণতি। অতপর অন্ধকার চোরাগলি ধরিয়া পথ হারায় বাংলা। ইতোমধ্যেই মেজর জিয়ার হাত ধরিয়া বাংলা ঘুরিয়া দাঁড়াইলেও গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো অর্থাৎ বহুদলীয় গণতন্ত্রের নাম নিয়া আবার শুরু হয় গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা। এরপরে আসে এরশাদের নয় বছরের স্বৈরশাসনকাল। স্বৈরতন্ত্রের যাঁতাকল হইতে মুক্তি পাইয়া বাঙালি আবার অল্প হইতে গভীর জলে পড়িয়া খেই হারাইয়া ফেলিল। বিস্তর বিশৃঙ্খলা ঘিরিয়া ধরিল প্রশাসনের প্রতিটি বাঁকে। রাজনীতি হারাইয়া ফেলিলো তার উদ্দেশ্য, কর্পোরেট মালিকগণ কিনিয়া নিলেন রাজনীতির সকল উঁচু উঁচু পদবী। রাজনীতিতে পানি না পাওয়া দলগুলি দুইটি বৃহত্তর জোটের সাথে জোট বাধিয়া পুরো দেশকে দুইটি শিবিরে বিভক্ত করিয়া উভয় পক্ষই সেই গণতন্ত্রকে বাঁচাইয়া তুলিবার জন্য নিজেদের জান-মাল বিনিয়োগ করিয়া নামিলেন। এই মল্লযুদ্ধে পড়িয়া জনগণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এরা পালা করিয়া একবারের ব্যবধানে ক্ষমতায় আসিয়াছে।

প্রথমবার ক্ষমতায় আসিয়া তাহারা বিরোধী দলকে নির্মূল করিবার জন্য যতটা সম্ভব ততটাই করিল। আর বিরোধী দলও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দোহাই দিয়া অরাজকতা করিয়া চলিল। ক্ষমতার পালা বদলে ক্ষমতায় থাকা দল বিরোধী দলে পরিণত হইলো এবং বিরোধী দল ক্ষমতা লাভ করিল। ক্ষমতায় গিয়া পূর্বতন সরকার যাহা করিয়াছে তাহাই তাহারা চালাইতে লাগিল শুধু তা বহুগুণে বাড়াইয়া। আর বিরোধী দলও পূর্বতন বিরোধী দল যাহা করিত তাহাই করিতে লাগিল অনুরূপ বহুগুণে বাড়াইয়া। উভয়ই উভয়ের কর্মকাণ্ডের দোষারোপ করিতে লাগিল, যদিও তাহারা নিজেরাই মাত্র কিছুদিন আগে এই কীর্তিগুলি করিয়া আসিয়াছে।

ইহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সা¤প্রতিক নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়া ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী পক্ষের যথাক্রমে না এবং হ্যা লইয়া বিস্তর মতভেদ। এখন যাহারা যে অবস্থানে রহিয়াছেন তাহার বিপরীত অবস্থানে থাকিয়া তাহারাই দেশে নৈরাজ্য ডাকিয়া আনিয়াছিলেন মাত্র কয়েক বছর আগে। এখন উভয়পক্ষই মধ্য বিরতির পর নিজের গোল পোস্টে গোল দিয়া যাইতেছেন। আবার ক্ষমতাসীন দল আসন্ন ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগেই খালি মাঠে বিপক্ষের বিরুদ্ধে ১৫৩ টি গোল দিয়া একতরফাভাবে আগামীতে দেশ শাসন করিবার জন্য বৈধতা লাভ করিয়া বসিয়াছে। আর এই নির্বাচন ঠেকাইতে গিয়া বিরোধী জোট হরতাল অবরোধের মাধ্যমে দেশ অচল করিয়া দিতেছে, মানুষ পোড়াইয়া মারিতেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদেরকে টলাইতে না পারিয়া সর্বশেষ গণতন্ত্রকে বাঁচাইতে রাজধানী অভিমুখে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র ডাক দিয়াছে।

অন্যদিকে গণতন্ত্রের গোষ্ঠি উদ্ধার করিতে গিয়া হরতাল-অবরোধের বিরোধিতাকারী সরকারি দলই বিরোধী দলের কর্মসূচী ঠেকাইতে দুই দিনের হরতাল ডাকিয়া বসিয়াছে। হায় গণতন্ত্র! তোমার এইরকম বহুরূপী রূপ দেখিয়া আমরা নির্বাক হইয়া যাইতেছি। আমাদের মুখের ভাষা হারাইয়া যাইতেছে। তোমার প্রশংসা করিতে করিতে সুশীল সমাজের চাপায় খিল ধরিয়াছে। দলকানা ভণ্ড মিডিয়াও মনে হয় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। জানি না গণতন্ত্রের এই ভণ্ডামী আর কত কাল দেখিতে হইবে, জানি না আর কত প্রাণ বিসর্জন দিয়া তোমার প্রকৃত মাজেজা আমরা উপলব্ধি করিতে পারিব? ৪২টি বৎসর অতিক্রান্ত করিয়াছি, তোমার বহুরূপী চরিত্র অবলোকন করিয়াছি বহুবার। এখনো কি তোমাকে নির্বাসনে পাঠানোর সময় হয়নি? বাঙালি জাতি কি বলে? এখনো কি সময় হয়নি এই গণতন্ত্র পরিহার করার?

বিষয়: বিবিধ

১০৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File