মহামানব

লিখেছেন লিখেছেন সাইদুল হোসেন ০৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:২০:১৩ রাত

মানুষ অনেকটা ফুলের মত । পৃথিবীতে ফুল ফোটে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে , একটা সুন্দর মনন নিয়ে । পুষ্পের বিকাশ প্রকৃতির শোভাবর্ধক, প্রস্ফুটিত পুষ্প বিচ্ছুরিত সুগন্ধে বিমোহিত হয় সবাই । এখানেই পুষ্পের জন্মের সার্থকতা । প্রকৃতির শোভাবর্ধন আর সুগন্ধের মাতম সৃষ্টির মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই পৃথিবীতে পুষ্পের আগমন । মহাজগতের ইতিহাসে পুষ্পকে আলো প্রদানকারীরূপে অথবা বহমান স্রোতস্বিনীস্বরূপ কুলুকুলু ধ্বনি উৎপাদনকারীরূপে প্রত্যক্ষ করা যায়নি কখনও । একটিমাত্র ক্ষমতা বিধাতা তাকে প্রদান করেছেন । হয় সে তার সেই বিধাতা প্রদত্ত স্বরূপ প্রকাশ করে অথবা ইহলোক ত্যাগ করে । আপন স্বরূপ উন্মোচন ব্যতিরেকে বিকল্প স্বরূপে পুষ্পের আগমন ঘটেনি কখনও, ঘটবেও না । যদি কোন কারণে পুষ্প তার নিজস্ব স্বরূপ প্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়, ধরাধাম ত্যাগের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত সে শুধু চেষ্টা চালিয়ে যায় ।

পৃথিবীর বুকে প্রত্যেকটা মানুষেরই তেমনি জন্ম হয় আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে, আপন ভাললাগা নিয়ে । আর পুষ্পের মতই স্বীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশে উন্মুখ প্রতিটি মানুষ । পার্থক্য শুধু এই, পুষ্পের নিজের সাথে পুষ্পের মনের সম্পর্ক গুগল স্বরূপ, সে তার মনের সকল চাওয়াকে সার্চ করতে পারে, তাই কলি ফোটে ফুল হয়ে; কিন্তু মানুষের মনের সাথে মানুষের যোজন যোজন ব্যবধান । তাই মানুষ সর্বদা তার মনকে পড়তে না । মৃতপ্রায় ঝিনুকটিও জানতে পারে না তার অন্তঃস্থ গহ্বরে কি মুক্তা লুকিয়ে আছে!

কিন্তু, বাকি সব মানুষই আপন স্বকীয়তা সম্পর্কে সম্যকজ্ঞাত । সৃষ্টিকর্তা মানুষ ভেদে প্রতিভার রকমারি মুক্তো বিলিয়ে দিয়েছেন অকৃপণভাবে । আর সুনির্দিষ্ট প্রতিভাই হল মানুষের সুনির্দিষ্ট স্বকীয়তা, তার স্বরূপ । বহতা নদী আপন স্বরূপ বিমুখ হয়ে যেমন কখনও স্রোতের গতিরোধ করে না, পালতোলা ময়ূরপঙ্খী যেমন এগোয় বাতাসের দিকমুখী হয়ে, আপন স্বরূপ বিদ্রোহীরূপে চাতক যেমন আসে না ভূপৃষ্ঠবারির স্বাদ পরখ করতে, তেমনি বিধাতা প্রদত্ত স্বরূপবিমুখ হয়ে অন্যের জমিতে বর্গা চাষও মানুষের জন্য অকল্যাণকর । প্রতিটি মানুষেরই উচিৎ তার হৃদয়ের সন্নিকটে গমনের চেষ্টা করা । একজন ব্যক্তি যখন তার হৃদয় অন্তঃস্থলে গমন করবে, তখনই সে বিধাতা প্রদত্ত ম্যাসেজ রিসিভ করবে – “তোমার মনন, মেধা ওইখানে নিহিত, কাজেই তুমি তোমার ট্রেজার লব্ধ করতে ওই সুড়ঙ্গপথে গমন কর” । কেননা, সৃষ্টিকর্তা মানুষের নিকট তাঁর বাণী পৌঁছানোর মাধ্যম করেছেন হৃদয়কে । যে মানুষ তার হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না , সে ব্যর্থ হয় বিধাতার ম্যাসেজ রিসিভ করতে , সমস্ত জীবন হাতড়ে বেড়ায় অন্ধকারে । আর যে তার আপন অন্তঃকরণের অন্তঃস্থলে পৌঁছে গুপ্তধনের সন্ধান পেল , সে যদি তাকে অবজ্ঞা করে ভুল পথে গমন করে, তবে তার মত অভাগা আর দ্বিতীয়টি নেই ।

এতো গেল দুই শ্রেণির মানুষের কথা, এবার আসি তৃতীয় শ্রেণির কাছে । এই শ্রেণির মানবসন্তান আপন জন্মপরবর্তী মস্তিস্কবিকাশ অভ্যুত্থানের পর হতে স্বীয় হৃদয়ের সাথে সুসম্পর্ক গঠনে সফলকাম হয়ে বিধাতাপ্রদত্ত ম্যাসেজ গ্রহণের গৌরব অর্জনপূর্বক স্বীয় স্বরূপমুখী পবনের দিকে মেলে দেয় পাল । আপন পথ অনুসরণ করে পদাঙ্ক এঁকে এঁকে এগোতে চায় আপন সাম্রাজ্যের দিকে । এখানেই পুস্পের সাথে তার মিল । পুস্প যেমন আপন স্বকীয়তার সাথে পরিচিত হয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রস্ফুটন আর ব্রাউনিয় গতিময় সুগন্ধ বিচ্ছুরনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলে , এরাও তেমনি আপন স্বকীয়তাকে লালন করে এগিয়ে চলে । আর তাতেই সৃষ্টি হয় প্রস্ফুটিত পুস্পের মত মৌলিকত্ব । এই রীতি ধরেই পৃথিবীর বুকে আজ প্রতিষ্ঠিত এই বিকশিত সভ্যতা , এই জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার স্বর্গীয় ফল্গুধারা , এই সকল সৃষ্টিশীল সৃষ্টিকর্ম । মানুষ শুধুমাত্র যখন তার হৃদয়ের দাবী রেখে কাজ করবে , তখনই তাতে হবে প্রাপ্তির সূর্যোদয় , ফুটবে সূর্যমুখী – একখানি হলেও । হৃদয়ের দাবী মানতে গেলে , আপন স্বকীয়তাকে মৌলিক ধরে এগোতে গেলে বাধা আসবেই । কিন্তু সে বাধাকে তুচ্ছজ্ঞান না করে যারা জাগতিক প্রয়োজন , চাহিদা কিংবা পরিপার্শ্বের অসহনীয় চাপে দুহাত ঊর্ধ্ব আসমানে উড্ডয়নরত কাকমুখী করে আত্মসমর্পণ করেছে , তারা প্রকৃতপক্ষে করেছে আত্মহনন । আর আত্মহনন মহাপাপ বলে তারা মহাপাপী । কেননা , আপন স্বকীয়তার পথ হতে সরে গিয়ে সে অনাগত সম্ভাবনাকে গলাটিপে হত্যা করে পৃথিবীকে করেছে বঞ্চিত । হতে পারে সে সম্ভাবনা ছিল ক্ষুদ্র , তুচ্ছ ; তবু সৃষ্টি সর্বদা সৃষ্টিই । সেই সৃষ্টিকে যে মানুষ পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার দরুণ পরিণত হতে দিল না বাস্তবে , সে মানুষ প্রায়লব্ধ মহামানবের খেতাব হতে ভূষিত হল কাপুরুষে । যে পুস্পকে আজ বাগানে হাসতে দেখ , সেই হাসি হাসতে গিয়ে ইতিহাসের কুৎসিত গহ্বরে ঠাই হয়েছে অনেক কলির , তার খোঁজ কেউ রাখে না । পতঙ্গ – বিহঙ্গের অভাবে পরাগায়ন বঞ্চিত হয়েছে কত , তার পরিসংখ্যান নেই । প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওষ্ঠাগত হয়েছে কত বীজ , চারা অথবা কলির , তবুও শত প্রতিকূলতার মাঝে আপন স্বরূপ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় নি কখনও , বরং পুস্প হয়ে ফোটার সংগ্রামে বিসর্জন দিয়ে গেছে প্রাণ । আপন স্বকীয়তাকে যে আমৃত্যু আঁকড়ে ধরে রাখতে জানে , সেই তো মহামানব ।

বিষয়: বিবিধ

১৩৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File