সাভার ট্রাজেডি ও একটি সাক্ষাতকার
লিখেছেন লিখেছেন সাইদুল হোসেন ০৩ মে, ২০১৩, ১২:৩৭:৫৯ দুপুর
গতকাল সাভারে গিয়েছিলাম । রানা প্লাজা ট্রাজেডির ভিকটিম এক মহিলার সাথে কথা হল । ইনজুরি খুব সিরিয়াস না তার , কারণ ইতিমধ্যে অনেকটা কামব্যাক করেছেন । কিন্তু তার বেঁচে ফেরার গল্প কিছু সময়ের জন্য আমাকে করে দিয়েছিল স্তম্ভিত ।
তিনি ছিলেন খুব সম্ভবত ৭ তলায় । ৮ তলার ছাদ ভেংগে পড়ে । মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা যায় তার আশেপাশের প্রায় সবাই । কিন্তু তিনি বেঁচে যান । কারণ তার শরীরের উপরে ছিল লাশের স্তুপ , বিশেষত তার হাতের উপর । তাই ছাদ তার মাথার কিছু উপর পর্যন্ত এসে থমকে যায় । সহকর্মীরা লাশ হয়ে দিয়ে যায় তাকে জীবন । কিন্তু সে জীবন যেন মৃত্যুর নামান্তর মাত্র । হাতের উপর লাশের মিছিল , তার উপর পড়ে আছে ভারী পিলার । কোনভাবেই ৮ ঘণ্টায় একদণ্ড নাড়াতে না পারা ব্যথায় কাতর আপনার হাত হয়েছিল তার আপনারই শত্রু । অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলতে থাকলেন আমাকে - " ভাই , বিশ্বাস করবেন না ৮ টা ঘণ্টা একটুকুও নড়তে পারি নাই । শুধু চিল্লাইছি - আমারে কেউ বাঁচান । ডাক শোনার কেউ নাই । অসহায়ের মত শুধু খুঁজে গেছি কেউ আসে নাকি । এরপর এক লোক আসল । আমাকে টানতে লাগল বের করার জন্য । কোনভাবেই একবিন্দু নড়াতে পারল না । লাশের মিছিলে শুধু আরেকটি লাশ হবার অপেক্ষা মাত্র । লোকটি ওই পাশে কোন রকমে গিয়ে আমার হাত আর পায়ের উপরের লাশগুলো সরানোর চেষ্টা করল । কিন্তু লাশগুলো প্রতিবাদী মূর্তি হয়ে রইল , নড়ল না এক ফোঁটাও ! আমি তাকে বললাম , ভাই আপনি একটা চাপাতি নিয়া আসেন । আমি আমার হাত কাটব , তাও জীবনটা নিয়া বের হই । আমি বাঁচতে চাই ভাই !"
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লাশের মিছিলে একজন মানুষের বেঁচে থাকার সে তীব্র আর্তনাদ যেন শ্রবণভ্রম হয়ে ফিরে আসছিল আমার দুকানে । কল্পনায় ভেসে উঠছিল - আমি যদি সেখানে থাকতাম ! মহিলার মুখের দিকে তাকানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম । পাশে দাঁড়ানো নোভেলকে দেখলাম শুধু নির্বাক স্তব্ধ বদনে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরের বিস্তৃত আকাশে । একজন মানুষ কোন পরিস্থিতিতে নিজের হাত নিজে চাপাতি দিয়ে কেটে ফেলার জন্য অন্যের কাছে আকুতি করতে পারে তা বোঝার শক্তি ছিল না আমার । পরবর্তীতে ওই লোকটি চাপাতি না পেয়ে ফিরে আসে বটি নিয়ে । তিনি উদ্যত হন বটি দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলার । ভাবতেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল । একজন মানুষ বটি দিয়ে নিজের হাড় নিজেই কোপাচ্ছেন ! আহ ! কি ভয়ংকর ! শেষবারের মত লোকটি মহিলাকে বললেন , একটু অপেক্ষা করুন, দেখি লাশ সরাতে পারি কিনা । লোকটি মহিলার হাতের উপরের লাশটিকে এইবার জোরে টানতেই লাশের শরীর থেকে পা ছিঁড়ে বের হয়ে এল পিলারের রডে হিপ জয়েন্ট আটকে থাকায় । এরপর লাশটা সরিয়ে ফেললেন । সরু পথে জীবন নিয়ে ফিরে এল একটি জীবন্ত উপাখ্যান , একটি মহাকাব্য !
নির্নিমিষ তাকিয়ে থেকে পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ালাম । রোড এক্সিডেন্ট করে ব্যথার তীব্র যন্ত্রনায় কাতরিয়েছি ৭ টি মাস । তবুও কোনদিন পা কেটে ফেলার কথা কল্পনা করতে পারিনি । অথচ আরেকজন মানুষের নিজের হাত কাটতে কমতি ছিল না সাহসের । এত সাহস কোথায় পেয়েছেন তিনি ? উপরওয়ালা এত শক্তি কিভাবে দিয়েছেন ওদের ? আজ নজরুল বেঁচে থাকলে কি কবিতা লিখতেন আমার জানা নেই । একজন রানা টাকার পাহাড় জমিয়ে কেড়ে নিয়েছে এতগুলো জীবন । একটি গণতান্ত্রিক সরকার তৈরি করেছে হাজারো রানা । আর আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি প্রতিবাদহীন হয়ে ! শুভ কামনা জানিয়ে মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অধোবদনে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে এলাম একবুক চাপা আর্তনাদ নিয়ে আর নিজের অজান্তেই বলে উঠলাম -
"দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ !!"
বিষয়: বিবিধ
১৪৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন