একজন বাবার গল্প : আমি ভালবাসতে পারিনি আমার বাবাকে
লিখেছেন লিখেছেন প্যারিস থেকে আমি ১৪ মার্চ, ২০১৩, ০৩:২৮:২০ দুপুর
গ্রামের সহজ সরল একজন মানুষ।কারো প্রতি কোন হিংসা নেই,নেই কোন বিদ্বেষ,কিংবা কোন অভিযোগ।গ্রামের সবাই যেন তার খুব আপন।তিনি যেভাবে গ্রামের সবাইকে আপন করে নিয়েছিলেন তেমনি গ্রামের ছোট বড় সকলেই তাকেও খুব আপন করে নিয়েছিলো,খুব।বিশেষ করে গ্রামের হত দরিদ্র মানুষগুলো।
টাকা পয়সা দিয়ে গ্রামের মানুষকে খুব বেশি সাহায্য করতে পারতেন এ রকম অবস্তা তাঁর ছিলোনা।কিন্তু যা ছিলো এর মধ্য থেকেই চেষ্টা করতেন।তবে টাকা পয়সার বাইরে তিনি এলাকার মানুষকে নানারকম সহযোগিতা দিতেন।
এলাকার গরীব ফ্যামেলি গুলোর মধ্যে কারো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়েছে, এক প্রতিবেশি অন্য প্রতিবেশির সাথে ঝগড়া হয়েছে এমন অবস্তায় বিচার সালিশের জন্য ডাকা হত তাঁকে।
কারো ফ্যামেলিতে কেও অসুস্হ হলো কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্য দশার কারনে একজন ডাক্তার দেখিয়ে যে ঔষোধ খাবে সে অবস্তা নাই, এমন পরিস্তিতে তিনিই যেন ওদের ডাক্তার।
বিশ্বাস করুন, তাঁর একাডেমিক কোন সার্টিফিকেট ছিলোনা।তিনি কাওকে কোন প্রেসক্রিপশন লিখেও দিতেন না। কাওকে বলে দিতেন ঔষোধের নাম, আবার কাওকে নিজেই কিনে এনে দিতেন। তাঁর চিকিৎসায় আল্লাহর রহমতে গরীব মানুষগুলো সুস্হ্য হত।
আমাদের ডাকবাংলো জামে মাসজিদের তিনি ছিলেন একজন দায়েমি ৫ ওয়াক্ত জামায়াতের সহিত নামাজ আদায় কারি মুসল্লি। এমনও হয়েছে ফজরের নামাজে তিনিই মাসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনকে প্রায়ই ডেকে দিতেন।তাইতো তাঁর মৃত্যুর পর জুমার খুৎবায় মাসজিদের খতিব একটি হাদীস শুনালেন, হাদীসটি হচ্ছে-
"রাসুলে করিম (সঃ) বলেছেন, যে ব্যাক্তিকে ফজর এবং এশার নামাজে মাসজিদে দেখা যায় তাকে মুমিন হিসাবে স্বাক্ষ দাও।" এই হাদীস শুনিয়ে ইমাম সাহেব সকল মুসল্লিদের সাথে নিয়ে স্বাক্ষ দিলেন যে তিনি একজন মুমিন।
তাঁর কান্নার আওয়াজ শুনে সন্তানদের ঘুম ভাংতো। প্রায় ভোরেই তিনি নফল ইবাদত করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাঠি করতেন।কোন কোন দিন ফজর নামাজ পড়ে এসে কিছুক্ষন কুরআন তেলাওয়াত করে তিনি তাঁর মনিবের দরবারে হাত তুলতেন। মনিবের দরবারে তাঁর চাওয়ার মধ্যে অন্যতম ছিলো সন্তানদের সফলতা।
তিনি তাঁর সন্তানদের খুব ভালোবাসতেন।কোন সন্তান অসুস্হ হলে তিনি খুব পেরেশান হয়ে যেতেন। ১২/১৩ বছরের একটা ছেলেকে কুলে করে তিনি হাটতেন।যাতে করে তাঁর ছেলেটি আরাম বোধ করে।
অনেক দিন এমন হত যে কোন সন্তান ঘুম থেকে দেরী করে উঠেছে, মা তাদেরকে আর নাস্তা দিচ্ছেন না বা তাদের জন্য নাস্তা রাখেন নি এমন অবস্তায় তিনি বাইরের কোন রেষ্টুরেন্ট থেকে নিজে কিনে নিয়ে এসে তাঁর সন্তানকে খাওয়াচ্ছেন।
এক সময় তিনি ও তার ভাই মিলে যৌথ ফ্যামেলি ছিলো, বিধায় তিনি কোন কাজ কর্মে এ্যাকটিভ হতে পারেন নি।তাঁর ছোট ভাই বিদেশ থেকে টাকা পয়সা দিতেন আর তিনি দেশে বাড়ির দেখা শুনা করে কাঠিয়ে দিতেন। একদিন তারা দুই ভাই আলগ হয়ে গেলেন।এখনতো মহা সমস্যা। ৪টি ছেলে ও একটি মেয়ে নিয়ে তিনি কিভাবে সংসার চালাবেন। তার উপর সাথে আরোও একজন পালক পূত্র।
কি আর করা। আলগ হওয়ার সময় জমি জমা যা পেয়েছিলেন তা বিক্রি করে সংসার চালাতে লাগলেন। সন্তানদের পড়াশুনাও চলতে থাকলো।সন্তানরা খুব যে পড়াশুনা করতে পেরেছে তা না কিন্তু।
এর মধ্যে সন্তানরা কিছু বড় হলে ২য় ছেলেকে সৌদি আরব পাঠিয়ে দিলেন। তার কিছুদিন পর ৩য় ছেলেকে দুবাই।আর বড় ছেলেকে মধ্য এশিয়া পাঠালেননা। তাঁর ধারনা ওখানে এত গরমের মধ্যে তাঁর ছেলেটি কাজ করতে পারবেনা,কষ্ট বেশি হয়ে যাবে।কিন্তু দুই সন্তানকে বিদেশ পাঠিয়েও তাঁর মন ভরেনি। তাঁর সখ সন্তানরা ইউরোপ আমেরিকা যাবে।
এজন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে কত কান্নাকাটি।
যাকে তাকে ধরে তার বড় ছেলের জন্য একটি লন্ডনি কনে চাইতেন।লন্ডনি কনের জন্য তিনি দেদারছে টাকাও খরচ করতে লাগলেন।এভাবে কত ঘটক কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।কিন্তু কোন ঘটকই তাঁকে লন্ডনি কনে দিতে পারেননি।
এই সখ নিয়েই তিনি ২০০৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ইহজগত ত্যাগ করে তাঁর মনিবের ডাকে সাড়া দিলেন।
তিনি মারা যাওয়ার মাত্র কিছুদিন পর অর্থাৎ ৬ জুন ২০০৫ ইং তারিখে তাঁর বড় ছেলে যার জন্য লন্ডনি কনে খুজতে ছিলেন সে ফ্রান্সে চলে যায়। ফ্রান্সে যাওয়ার জন্য কোন কনে লাগেনি।আজ তার বড় ছেলে ফ্রান্সে থাকে স্ত্রী সহ।২য় ছেলেও আজ ফ্রান্সে আছে।এমনকি তাঁর মেয়েও ২টা বাচ্ছা সহ ফ্রান্সে বসবাস করছে।
প্রিয় পাঠক, এতক্ষন যার গল্প বললাম তিনি আর কেও না। তিনি আমার জন্মদাতা পিতা।আমি তাঁর হতভাগা বড় সন্তান।
আমরা আমাদের পিতাকে বাজি বলে ডাকতাম। কত স্বপ্ন ছিলো আমাদের বাজি র। আজ তাঁর ছেলে মেয়েরা ইউরোপে আছি অথচ তিনি দেখে যেতে পারেননি।
তিনি আমাদের কে যতটা ভালবাসতেন আমরা তাকে ততটা ভালবাসতে পারিনি।পারিনি তার সখ আহলাদ পুরো করতে।নিশ্চয়ই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের বাজি র দোয়া কবুল করেছেন, বিধায় আজ আমরা ইউরোপে। অথচ তিনি আজ আমাদের পাশে নেই।
অনেক অনেক ভালবাসতেন আমাদের বাজি। তিনি যতটা ভালবাসতেন আমরা ঠিক ততটা ভালবাসতে পারিনি শুধু খামখেয়ালীপনার কারনে।
আজ মনের মাঝে একটা কষ্ট অনুভব করি বাজি র জন্য। কেন তিনি এ দুনিয়ায় থাকতে আমরা ইউরোপ আসতে পারিনি। কেন তাকে আমরা তার মত করে ভালবাসতে পারিনি।
সকল পাঠকের কাছে আমার সবিনয় অনুরুধ , আপনারা আমার বাজি র জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাঁর জীবনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়ে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন।
"রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগিরা"
বিষয়: বিবিধ
২৪৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন