গল্প: মায়ের পালকি (পর্ব এক)
লিখেছেন লিখেছেন প্যারিস থেকে আমি ০৮ আগস্ট, ২০১৫, ০৫:২৪:৫২ বিকাল
দু'বারই আমি আমার মা'য়ের পালকির পিছু পিছু দৌড়িয়েছি।কিন্তু আমি আমার মাকে ছুতে পারিনি। ধরতে পারিনি তার কোমল হাতখানা। বলতে পারিনি,মা তুমি আমায় ছেড়ে যেওনা। দু'বারই আমি কেঁদেছি, অনেক কেঁদেছি। আমার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হলেও আমার মায়ের মন ভারী হয়েছে কি না আমি জানিনা। প্রথমবার, তা ও না হয় পালকিতে দেয়া পর্দা সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার, একটিবারের জন্যও পর্দা সরিয়ে আমার দিকে তাকান নি। কেন তাকান নি তা ও জানি না।
আমার বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন আমার বাবা কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে সরকারী হাসপাতালের বেডে শুয়ে ডাক্তারের অবহেলা আর ভুল চিকিৎসায় কাতরাতে কাতরাতে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর দাদার বাড়িতে আমার ও আমার মায়ের ঠাই হয় মাত্র একমাস। বাবার চল্লিশা হওয়ার আগেই তলপি তলপা সহ আমার মাকে স্বামীরবসতভিটা ছেড়ে হতদরিদ্র তার বাবার গৃহে চলে আসতে হয়,সাথে আমাকেও। ওখানে আমাকে কে রাখবে । বাবার সৎ ভাইয়েরা আমাকে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। তাছাড়া আমি বিদেয় হলেই তাদের জন্য ভালো। যেটুকু জমি জমা আমার বাবার রয়েছে তারা সেগুলো ভাগ-ভাটোয়ারা করে নিতে পারেন।
আমার নানার দুই ছেলে। অর্থাৎ আমার মামা দুইজন। দু'জনই আমার মায়ের বয়সে ছোট। তারা তাদের বোনকে খুব ভালবাসে। ভালবাসেন বলেই জমি বিক্রি করে তাদের থেকে অপেক্ষাকৃত ধনি পরিবারে তারা তাদের বোনকে বিয়ে দেন।যাতে করে তাদের বোন আরামে আয়েশে জিন্দেগী পার করে দিতে পারে। বিয়ের পর সেভাবে চলছিলোও। আমার বাবা মা কে খুব ভালবাসতেন,মা'ও। বাবা মায়ের ভালবাসা আর সুখে শান্তিতে দিন যাপন দেখে আমার নানা,মামুরাও খুব খুশি। তারা খুশি, অন্তত তাদের জমি বিক্রি করে মেয়ে- বোনকে বিয়ে দিয়ে তারা ঠকেন নি।
আমার বাবা আহামরি ধনি ছিলেন না।কিছু জমি জমা ছিলো ।আর ছোটখাট ব্যাবসা করেই চালাতেন তার মায়া মমতাময় ছোট্ট সংসারটি।তার বুকে ভালবাসাও ছিলো অফুরন্ত।তাই তার যা ছিলো এই সামান্য থেকে সৎ ভাইদের সাহায্য সহযোগিতা করতেন।কিন্তু মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া একমাত্র সন্তানের ঠাই হয়নি তার হাতে গড়া বাড়িতে।
বলেছিলাম,বাবা মায়ের ভালবাসার কথা। আমার বাবা মা দুজনই দুজনকে খুব ভালবাসতেন। তাদের বিয়ে ও ভালবাসাবাসির মাখামাখির একবছরের মাথায় আমার জন্ম হয়। খুব খুশি আমার বাবা।জন্মের দিনই কয়েক কেজি জিলাপি পাড়াপ্রতিবেশিদের খাইয়েছেন। সাতদিন হতে না হতেই ঘটা করে দুইটা ছাগল জবাই করে আমার নামে আক্বিকা করেছেন।আমার বাবা আবার খুবই ধর্মপরায়ন ছিলেন। আমাদের নবী মুহাম্মদ (স)বলেছেন, মেয়ে হলে একটা ছাগল আর ছেলে হলে দুইটা ছাগল জবাই করে আক্বিকা করতে। তাই আমার বাবা নবীর কথানুযায়ি দুইটা ছাগল জবাই করেছেন। মসজিদের হুজুর খাইয়েছেন, আমার জন্য দোয়া করিয়েছেন। বাবার খুশিতে মা'রও খুশি যেন আর ধরছেনা।খুশি আমার নানা ও মামুরাও।
আমার জন্মের বছর বাবার জমিতে ভালো ফলন হয়। বাবার ব্যাবসায়ও আয় উন্নতি হতে লাগলো।সবাই বললো, আমি নাকি খব লক্ষি। এমন লক্ষি সন্তান নাকি সচরাচর জন্ম নেয় না। আমার বাবা তার সফলতার কেন্দ্রবিন্দু আমাকে বানিয়ে ফেললেন। আমার প্রতি আদর মহব্বতও দিনদিন আরো বাড়তে লাগলো। প্রতিদিনই আমার বাবা আমার জন্য নতুন নতুন জামা কাপড় কিনে নিয়ে আসেন। আমার মা আমাকে নতুন জামা কাপড় পরিয়ে দেন। আমার হাতে,গায়ে,মাথায় তেল মাখিয়ে দেন।মুখে ক্রীম লাগিয়ে,মাথার চুল আছড়িয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে কপালে একটা চুমো দেন। তারপর বাবার সামনে নিয়ে গেলে বাবা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।কি যেন পড়ে আমার শরীরে ফু দিয়ে তার বুকের সাথে লেপটে ধরেন। আমার মা কে বলেন,বড় হলে আমার বেটা সাহেবদের মত হবে। আমাকে এটা সেটা খেলনাও কিনে দেন। নতুন কোন খেলনা দেখলে তা আমার জন্য কিনে আনবেনই। সারাদিন কাজের শেষে রাতে বাড়ি ফেরে আমাকে কিছুক্ষণ আদর যত্ন না করলে, আমার সাথে খেলা না করে আমার বাবা ভাত পর্যন্ত মুখে দেন না।
চলবে........
বিষয়: সাহিত্য
১৪৯৪ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন